গল্প পড়ার গল্প
সমকালকে চিত্রিত করেন দিনেশচন্দ্র রায়
দিনেশচন্দ্র রায় স্বল্পদিনের জন্য লিখতে এসেছিলেন। ১৯৭০-এ শুরু করেন ৪০ বছর বয়সে। মাত্র সাত আট বছর লেখেন। হয় তো আরো লিখতেন, ১৯৭৮-এ মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণ। ওই ক’বছরেই তাঁর লেখার প্রতি আমাদের মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল। সাত-আট বছরে দিনেশচন্দ্র পাঁচটি গল্প ও পাঁচটি উপন্যাস লিখেছিলেন। আমি বছর বারো আগে দিনেশচন্দ্রের ‘লিপ ইয়ারের মৃত্যু’ ফিরে পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমাদের প্রশাসন, আমাদের আমলাতন্ত্র, সরকার, দলনেতা, আমাদের এই দেশের জনজীবনের সঙ্গে সরকার আর শাসন ক্ষমতায় থাকা দলের ও দলীয় নেতার ক্ষমতার অধিক ক্ষমতা অর্জনের যে জটিলতা, যা ছিল অচেনা, তা চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর দেখা ছিল অতি আধুনিক, ভাবনা ছিল মৌলিক। আর এই উপন্যাসের সময় ছিল জরুরি অবস্থার দিনগুলো।
দিনেশচন্দ্র তাঁর ‘কুশপুতুল’ উপন্যাসেও তাঁর সমকালকে চিত্রিত করেছিলেন। আমি তাঁর কুলপতি গল্পটিতে তাঁকে দেশভাগ ও দেশত্যাগের সেই প্রায় দুঃখময় ইতিবৃত্তকে যেভাবে ভাবতে দেখেছি তা আমাদের বাংলা সাহিত্যে বিরলই। পার্টিশন নিয়ে বাংলা ভাষায় গল্প লেখা হয়েছে, আমি যা পড়েছি, দিনেশচন্দ্র রায়ের কুলপতির তুল্য গল্প পড়িনি। এই গল্প নিশ্চিত ভাবে আমাদের অন্যভাবে ভাবতে শেখাবে। কুলপতি এক গৃহদেবতা। সেই কুলদেবতা এক কষ্টিপাথরের বংশীবাদনরত কৃষ্ণমূর্তি। কালাচাঁদ তার নাম। তার চোখদুটিতে হিরে বসান, সমস্ত গা সোনায় মোড়া, হাতের বাঁশিটিও সোনার। মুকুটে মণিমুক্তো। তার কৃপায় এই পরিবারের যত সমৃদ্ধি। দেবোত্তর স্থাবর সম্পত্তি সব সেই কালাচাঁদের নামে। আর আস্থাবরও কম নয়, অঙ্গের অলঙ্কার ব্যতীত সিন্দুকভরা হিরে জহরত, সোনাদানা, মনি মানিক্য। অতুল বৈভব। বছরজুড়ে কালাচাঁদের সেবা। দিনেশচন্দ্র সেই গৃহদেবতা কালাচাঁদের সেবার অসামান্য বর্ণনা দিয়েছেন। ঋতুতে ঋতুতে তাঁকে ঘিরে উৎসবের কথা বলেছেন অনুপম গদ্যে। এই গল্প ওই কূলপতির সেবায়েত জমিদার পরিবারটি, কুলপতির নামে যে বিপুল ভূ-সম্পত্তি তার ভোগদখলকার পরিবারটির গৃহবধূর আত্মকথা। শাশুড়ির মৃত্যুর একবছর বাদে সে ওই বাড়ির বউ হয়ে আসে। আর তাকে সেই কালাচাঁদের নিত্য সেবার ভার দেওয়া হয়। ওই বাড়ির রীতিই তাই। যেন কালাচাঁদের সঙ্গে বেনারসি পরিহিতা সর্বাঙ্গ সোনার গয়নায় মোড়া বধূটির বিবাহ হলো আর একবার। তার স্বামী অতি রূপবান, কিন্তু ব্যক্তিত্বহীন। শ্বশুর হলো বাড়ির সবর্ময় কর্তা। গল্প পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায় গৃহদেবতার আড়ালে, দেবোত্তরের নামে সিলিং বহির্ভূত নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি ভোগের কী বিচিত্র আয়োজন। কত দেবতার নামে সেই আমলে অবিভক্ত বঙ্গে কত যে স্থাবর সম্পত্তি। দেশভাগের সময় এই নিষ্কর সম্পত্তি ভোগের অবসান হয় ওপার বাংলায়। ছিল কত না গৃহদেবতা, বোরামারার বালেশ্বর, নলখোলার রাধামাধব, কালুখালির জামাইগোপাল ... এঁদের সামনে রেখেই সম্পত্তি ভোগের বন্দোবস্ত। কালাচাঁদের নিত্য সেবায় জুড়ে গিয়ে সেই নতুন বউটি যেন বন্দিনী হয়ে যায়। তার স্বামী তাকে পায় না। সেই কালাচাঁদের সেবায়, ভোগ রান্নায় তার সমস্তদিন যায়। পরিবারের সম্পত্তিভোগের জন্যই কালাচাঁদকে যেন প্রাণপুরুষ করে তুলতে হয় তাকে। কালাচাঁদই তো সবকিছুর মালিক। খাজনা আসে, কলসিভরা প্রণামী... সে মনে মনে মুক্তি চায়। কিন্তু তাকে জোয়ালই যেন টানতে হয় কালাচাঁদের।
দিনেশচন্দ্রের গদ্য অনুপম। দিনেশচন্দ্র কত গভীর থেকে দেখেছেন ভূস্বামীদের এই ভোগের ব্যবস্থাটিকে। দেবোত্তর তদন্তে আসে সরকারি হাকিম। তখন আইন বাঁচাতে কত সেবা তাদের। বউটির জীবনে কালাচাঁদ যেন বিভীষিকা হয়ে আসে। সাতচল্লিশের আগস্টে দেশ দুখণ্ড হলে সেই কুলপতিকে নিয়ে বউটি আর তার স্বামী শ্বশুর হিন্দুস্থানের উদ্দেশে যাত্রা করে। সেই যাত্রার সময় নিরাভরণ, আর সাজসজ্জাহীন কালাচাঁদ হয়ে যায় পুতুলের মতো। এত দিন সে ছিল যেন শক্তিমান পুরুষ। দিনেশচন্দ্র লিখছেন,‘সেদিন রাতে বাতাস রাখাল বালক হয়ে গিয়েছিল। দূর গ্রামে বনের ধারে সে তার হারানো গাভীর নাম ধরে ডাকছিল।’ ...কী অসামান্য অনুভূতির কথা উচ্চারিত হয়েছে এখানে! দেশভাগ যেন মুক্তি হয়ে দাঁড়াল সেই গৃহবধূর কাছে। ভাঙল কারাগার। কালাচাঁদের প্রতাপ। সামন্তপ্রভুর চিরস্থায়ী ভোগের ব্যবস্থা।
গৃহবধূ বুকের ভিতরে কালাচাঁদকে নিয়ে যে যাত্রা শুরু করে, আনসার বাহিনী, ঘাতকদের এড়িয়ে সেই যাত্রা শেষে স্বামীর সঙ্গে উন্মুক্ত আকাশের নিচে ঘনিষ্ঠতায় যাওয়ার সময় বুকের ভিতরে লুকোনো কালাচাঁদই হয়ে ওঠে যেন বাঁধা। কুলপতিকে বনের ভিতরে ছুঁড়ে ফেলে সে তার স্বামীতে লগ্ন হয়। এ এক আশ্চর্য গল্প। এমন গল্প যে কোনো ভাষার সম্পদ। দিনেশচন্দ্র যেভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, দেবোত্তর প্রথা আর ভুসম্পত্তি ভোগের সেই অদ্ভূত কৌশলকে উন্মোচন করেছেন দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে, তা আমাকে কতবার যে মুগ্ধ করেছে। দিনেশচন্দ্রের আর এক গল্প ঐরাবতের মৃত্যুর কথা না বললেই নয়। নাটোর পাবনা হয়ে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বড় হয়ে ওঠা দিনেশচন্দ্র ডুয়ারসের বনাঞ্চলকে চিনতেন যতটা চেনা যায়। ঐরাবতের মৃত্যু গল্পে রাভা জনগোষ্ঠীর প্রধান এক আদিম পুরুষের সঙ্গে বন আর বনের প্রাণী আর নিজের অস্তিত্বের গভীর সম্পর্ককে এক অকল্পনীয় বিস্তার দিয়েছেন দিনেশচন্দ্র অন্তিমে পৌঁছে গিয়ে।
জয়ন্তীয়া পাহাড় রায়ডাক নদীর অধিত্যকায় মহাকালগুড়ি গ্রাম। সেই গ্রামের পান্ডা সর্দার, রাভা উপজাতিদের প্রধান। পান্ডা সর্দার অরণ্যের বিশুদ্ধতা এবং প্রাণিজগতের সংরক্ষণে বিশ্বাসী। এই গল্পে দেখা যায় উপজাতি সর্দার তার জনগোষ্ঠী থেকে ক্রমশ তার অধিকার হারাচ্ছে। তার পুরোনো প্রতাপ ভেঙে যাচ্ছে। যে সব রীতিনীতি তার কথায় মান্য করত ওই গোষ্ঠী, তা ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। সেই সময় রায়ডাক নদীর সন্নিহিত বনে এসে পৌঁছায় এক ঐরাবত, সে তার মৃত্যুর জন্যই এসেছে। একা নিঃসঙ্গ সেই ঐরাবতের আসার খবর পৌঁছে যায় পান্ডা সর্দারের কাছে। তার মতো জঙ্গল আর জঙ্গলের প্রাণীকে কেউ চেনে না। ফরেস্ট রেঞ্জার খবর দেয়, রায়ডাকের তীরে হাতিঘাসের জঙ্গলে যে এসেছে তাকে রক্ষা করতে হবে। পোচাররা সক্রিয়। জঙ্গলের মূল্যবান প্রাণী বিপন্ন। সেই রাভা সর্দার রায়ডাকের তীরে রাতে গিয়ে পাহারা দেয় ঐরাবতকে। তার পিঠে বন্দুক, সে খুব দক্ষ শিকারী। কিন্তু পোচারদের হাত থেকে হাতিটিকে যখন বাঁচাতে পারবে না, টের পায়, খবর দিতে রওনা হয় রেঞ্জ অফিসের দিকে। মাঝপথে শুনতে পায় হস্তির মরণ আর্তনাদ। পোচাররা হত্যা করে গজদন্ত কাটা শুরু করেছে স্পষ্ট। রাভা সর্দার আত্মহত্যা করেছিল, হাতিটিকে না বাঁচাতে পারার গ্লানিতে। দিনেশচন্দ্রের এই গল্প আমাদের ভাষার সম্পদ।