চিত্রকলা
ইমপ্রেশনিজমের ক্যানভাস
শিল্পের জগতে নতুন একটি ধারা তখনই সৃষ্টি হয় যখন প্রচলিত চিন্তা, চেতনা ও উপস্থাপন থেকে সরে এসে শিল্পীরা স্বাতন্ত্র্য একটি ঢংয়ের আলোয় নিজেদের উদ্ভাসিত করেন। এই উপস্থাপন শিল্পের দুনিয়ায় কেবল নতুনত্বই যোগ করে না, পাশাপাশি এটি শিল্পের প্রবাহকে হাজার হাজার বছর ধরে গতিশীল রাখতে সবচেয়ে অর্থবহ ভূমিকাও পালন করে। বিশ্ব চিত্রকলার যে বৈচিত্র্য, সহ চিন্তার বর্ণিল প্রকাশ তার উৎসমূলে খোঁজ করতে গেলে আমরা ধারা ভেঙে নতুন ধারা সৃষ্টি করার সমগ্র প্রক্রিয়াটি দেখতে পাব। চিত্রকলার প্রতিটি ইজমই প্রথমে একজনের চিন্তার ফসল হলেও পরবর্তী সময়ে বহুল চর্চার কারণে ওই ধারাটির একটি নিজস্ব বলয় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন শিল্পীদের চিন্তায় ও চর্চায় মতবাদের বিকাশ ঘটে এবং সমৃদ্ধ হয়। ঊনিশ শতকের চিত্রকলায় যেসব মতবাদ গতানুগতিক চিন্তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো তার মধ্যে ‘ইমপ্রেশনিজম’ অন্যতম।
শিল্পের রাজধানী প্যারিসে ১৮৭৪ সালে (১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) প্রথমবারের মতো ইমপ্রেশনিস্টদের আঁকা নিয়ে মাসব্যাপী একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এ প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত ক্লদ মনের ‘Impression, Sunrise’ ছবিটিকে ইমপ্রেশনিজম ধারার প্রারম্ভলগ্নের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৭৪ সালে ছবিটির প্রদর্শনী হলেও ক্লদ মনে এটি এঁকেছিলেন ১৮৭২ সালে। মনে তাঁর জন্মশহর ল হাভরে গিয়ে এই ছবিটি এঁকেছিলেন। ‘Impression, Sunrise’ ছবিটি থেকেই পরবর্তীতে ‘Impressionism’ শব্দটি নেওয়া হয়। ওই প্রদর্শনীতে ৩০ জন শিল্পী তাঁদের ২ শতাধিক কাজ প্রদর্শন করেছিলেন। ক্লদ মনে ছাড়াও শিল্পের ইতিহাসের উজ্জ্বল এ প্রদর্শনীতে অ্যাডগার দেগা, কামিল ফিসারো, পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলি প্রমুখরা অংশ নেন। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রচলিত রীতি-নীতি ভেঙে দিয়েছিলেন। এ ভাঙন কেবল ছবি আঁকায় ফর্মের পরিবর্তন কিংবা রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম থেকে দূরে সরে নয়, এ পরিবর্তন সামাজিকও।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে না গিয়ে, সরকারি সহযোগিতা না নিয়ে শিল্পীরা একজন ফটোগ্রাফারের বাড়িতে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়ে তাঁরা ছিলেন আপসহীন। যেহেতু প্রথা ভেঙে, প্রথার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা ছিল শিল্পীদের তাই স্বাভাবিকভাবে সমালোচকদের নিষ্ঠুর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে ইমপ্রেশনিস্টদের। প্রথমবারের মতো আয়োজন হলেও ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ছবি দেখতে চার হাজারের বেশি দর্শনার্থী প্রদর্শনীতে এসেছিলেন।
ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের চিন্তার জগতে একবার ডুব দিয়ে আসা যাক। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা উপলব্ধি করেছিলেন সময় ও আলোর পরিবর্তনে রঙের পরিবর্তন হয়। আলোর তারতম্যের কারণে রং একেক সময় একক রূপ লাভ করে। এ ধারার শিল্পীরা জীবন ও প্রকৃতির সংবেদনশীল মুহূর্তগুলোকে ক্যানভাস-বন্দি করতে আগ্রহী ছিলেন। ফলে তাঁরা চার দেয়ালের স্টুডিওকে বাদ দিয়ে বেছে নিলেন খোলা আকাশ। কেননা, স্টুডিওর বদ্ধ কক্ষে জীবন ও প্রকৃতির মুহূর্তের দৃশ্য অবলোকন করা সম্ভব নয়। যেহেতু মুহূর্তের তারতম্য, রঙের পরিবর্তনকে তুলিতে প্রকাশের ইচ্ছে রাখেন ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা—তাই তাঁদেরকে বিপুল মনোযোগ সহকারে জীবন ও জগতের মুহূর্তের দৃশ্যকে দেখতে হতো, উপলব্ধি করতে হতো মুহূর্তের পরিবর্তনগুলোকে। আলো ও বিশুদ্ধ রঙের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল এ ঘরানার শিল্পীদের। তাঁরা উজ্জ্বল রঙে ছোট ছোট আঁচড়ে ছবি আঁকতে আগ্রহী ছিলেন।
ইমপ্রেশনিজম সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘ইমপ্রেশনিজম বাস্তববাদের দৃশ্যমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই স্টাইলে প্রতিফলিত হয় দুই মনোভঙ্গি। প্রথমটি হচ্ছে স্থানিক রং সম্বন্ধে উৎসাহ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে পরিচিত দৃশ্য কিংবা বস্তুকে অপরিচিত ধরনে কিংবা অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে দেখার উত্তেজক মোহনীয়তা। বাস্তববাদের ক্যামেরা চোখে শিল্পীর ভূমিকা প্রকৃতির বর্ণনে পর্যবসিত। তাঁদের ব্রত ‘চোখ’ হয়ে ওঠা।’
যদিও সে সময়ে এ ধারাটি নতুন ছিল, তবু ক্লদ মনে বলতেন, ইমপ্রেশনিজম হচ্ছে সরাসরি সংবেদন। প্রত্যেক মহান শিল্পীই কম বা বেশি ইমপ্রেশনিস্ট ছিলেন। কেননা, এটি মূলত সহজাত প্রবৃত্তির প্রশ্ন। ইমপ্রেশনিজম ধারার প্রখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে থেকেও অ্যাডওয়ার্ড মনে আলাদা ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘প্রকৃতিতে কোনো রেখা নেই।’ রেখাবিহীন কেবল রঙের মিশ্রণে তিনি চিত্রকর্ম আঁকতেন। আবার ক্লদ মনে ভাবতেন চিত্রকর্ম হচ্ছে ‘বৈজ্ঞানিক মানসের প্রতিশ্রুতি’। অ্যাডগার দেগা মনে করতেন চিত্রের মধ্যে গতিময়তা থাকতে হবে। আবার ইমপ্রেশনিজমে তিনি শরীরী প্রতীক ব্যবহার করেছেন। শুধু অ্যাডগার দেগা কিংবা ক্লদ মনে নন, ফ্রেডরিক বাজিল, কামিল পিসারো, পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলি, গুস্তাভ ক্লাইলবট, মেরি ক্যাসাট, পল সেজান, বার্থ মরিসট প্রমুখ ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা প্রত্যেকেই পরস্পর থেকে আলাদা ছিলেন। রঙের ব্যবহারে, চিন্তায় ও উপস্থাপনে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যের কারণেই ইমপ্রেশনিজম শক্তিশালী মতবাদে রূপ লাভ করে। ফলে এ ধারার চিত্রকর্মের ভাণ্ডার খুব দ্রুতই সমৃদ্ধ হয়েছে।
অ্যাডওয়ার্ড মনের Luncheon on the Grass, আলফ্রেড সিসলির Fog, Voisins, বার্থ মরিসটের In a Park, অ্যাডগার দেগার The Absinthe Drinker, ম্যারি ক্যাসার্টের At the opera, পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়ার Girl with a Hoop, গুস্তাভ ক্লাইলবটের Paris Street, Raiû Day, ক্লদ মনের Vetheuil in the Fog, কামিল পিসারোর The Boulevard Montmartre, Afternoon ইমপ্রেশনিজম ধারার উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম।
আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে ইমপ্রেশনিজম প্রথম শিল্প আন্দোলন হলেও এ ধারাটির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। জীবনের অতলে ঘুরে আসা ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের উদ্দেশ্য নয়। অনেক শিল্পসমালোচক মনে করেন, ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা জীবনের সুখকে এঁকেছেন। বেদনা-বিদীর্ণতা, দুঃখ ও দহন তাঁদের তুলিতে তেমনভাবে উঠে আসেনি। অনেকদিকে বিষয়ের বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইমপ্রেশনিজম পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন ধারা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল। বলা হয়, ইমপ্রেশনিজম সব সকল আধুনিক চিত্রকলার উৎস। এ ধারাটির পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে নিউ ইমপ্রেশনিজম, পোস্ট ইমপ্রেশনিজম, ফবিজম ও কিউবিজম মতবাদের জন্ম নেয়।
প্যারিসে ইমপ্রেশনিজম ধারার যে শিল্প আন্দোলন শুরু হয় পরবর্তী সময়ে সেটি দেশ ও কালের সীমানা ভেঙে ফেলে। প্রায় শতবর্ষব্যাপী এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীরা ক্যানভাসে ঝড় তোলেন। চিত্রকলার এ ধারা পরবর্তীতে সাহিত্যসহ শিল্পের অন্যান্য শাখায় প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। যার কারণে এখনো ইমপ্রেশনিজম শিল্পীদের চর্চা ও শিল্পরসিকদের আগ্রহের বিষয়।