সালভাদর দালি
শিল্পী অথবা উন্মাদ
চিত্রকলার ইতিহাসে এমন কিছু প্রতিভাবান চিত্রকরের সন্ধান বিশ্ববাসী পেয়েছে, যাঁরা কেবল চিত্রকর্মের জন্যই আলোচিত নন, তাঁরা আলোচিত তাঁদের অদ্ভুত কার্যকলাপের জন্যও। এই খেপাটে শিল্পীদের মধ্যে যিনি প্রথম সারির প্রধানতম, তিনি স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি। তিনি সচেতনভাবেই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য সব কাজ নির্দ্বিধায় করে বেড়াতেন। সে জন্যই তিনি বলতেন, ‘আমার সাথে পাগলের মাত্র একটি পার্থক্য রয়েছে। পাগল মনে করে সে সুস্থ আছে; কিন্তু আমি জানি আমি পাগল।’ দালির খেপাটেপনার মূল কারণ, তিনি সাধারণ মানুষের মনোযোগ দাবি করতেন। তিনি সব সময়ই চাইতেন মানুষ তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করুক, তাঁকে নিয়ে কথা বলুক। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের এই মোহটি শৈশব থেকেই শুরু হয়েছিল।
দালির জবানিতে পাই তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের বহুবিধ ঘটনা। দালি লিখেছেন : ‘একবার মাছের কাঁটা খেতে গিয়ে আমার শ্বাসরোধ হওয়ার জোগাড়। তা দেখে আমার বাবা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দুই হাতে মাথা ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। শুধু বাবার ওই প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এরপরে আরো কয়েকবার আমি শ্বাসরোধ হওয়ার অভিনয় করেছি। বলাই বাহুল্য, আমার নিজের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ পাওয়ার জন্যই এই কাজ করা।’এই মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মানুষকে নানাভাবে হয়রানিও করতেন দালি। যৌবনে দালি যখন আমেরিকায়, বলাই বাহুল্য তখন শিল্পী দালি খুব পরিচিত মুখ ছিলেন না। নিউইয়র্কবাসীর কাছে নিজেকে তুলে ধরতে দালি রাস্তায় হাঁটার সময় হাতে ঘণ্টা রাখতেন। যখন মনে হতো পথচারীরা তাঁর ওপর দৃষ্টি দিচ্ছে না, অথবা বেশি মানুষের সমাগম যেখানে, সেখানে তাঁর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে তিনি একটানা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন। যাতে তাঁর দিকে জনসাধারণ দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর এমন কাণ্ডের সুবাদে অল্প কদিনেই দালি হয়ে উঠলেন শহরের পরিচিত মুখ। দালি লিখেছেন—‘আমি যখন বাইরে যেতাম কিংবা ঘরে ফিরতাম, বহু উৎসুক মানুষ জড়ো হতো। আমাকে দেখার জন্য তারা কৌতূহলী হয়ে উঠত।’ মানুষ যখন দালিকে রাস্তায় হাঁটতে দেখত, তারা আশঙ্কা করত এবং সঙ্গে সঙ্গে উদগ্রীব থাকত অদ্ভুত, পাগলাটে কোনো ঘটনার জন্য। কারণ ততদিনে তারা জেনেছে, দালি মানেই বেখাপ্পা কিছু ঘটবে অথবা ঘটতে চলেছে...। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই মানুষের এই মনোভাবে দালি খুব আনন্দিত হতেন।
দালির অদ্ভুত অসংখ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি ছিল তাঁর গোঁফ। প্রাবন্ধিক সুমন রহমান এ ব্যাপারে একটি মজার মন্তব্য করেছেন, ‘বিংশ শতকে হিটলার, স্ট্যালিন ও চ্যাপলিনের মৃত্যুতে পৃথিবীর গোঁফ সাম্রাজ্যে যে শূন্যতা দেখা দিতে শুরু করেছিল, দালির গোঁফ যেন সেই শূন্যতার ওপর সুররিয়াল প্রলেপ হয়ে এলো।’ দালি যে ধরনের গোঁফ রাখতেন, সম্ভবত বিশ্বের কেউ এর আগে এমন অদ্ভুত সরু গোঁফ দেখেনি। অবশ্য মানুষ যা করত না, দালি তা করতেন হরহামেশাই। দালির ছবির মতোই তাঁর গোঁফ ছিল জনপ্রিয়। গোঁফ ছিল খুবই সরু, আর নানা ঢঙে বাঁকানো। তাঁর এই গোঁফের ব্যাপারে মানুষজনের আগ্রহ ছিল প্রচুর। দালি একবার দর্শনার্থীদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তারা কি আমার ছবি দেখতে আসে? মোটেও না! তাদের সবার আগ্রহ আমার গোঁফের ব্যাপারে। মহৎ চিত্রকল্প সাধারণ মানুষের দরকার নেই। দরকার খালি একটা জম্পেস গোঁফ।’ দালি নিজেই বলতেন, কোনোদিন মানুষ হয়তো এই গোঁফজোড়ার মতোই অদ্ভুত আরেকটা সত্য আবিষ্কার করবে ও হ্যাঁ, সালভাদর দালি? ওই গোঁফঅলা? সম্ভবত ছবিটবি আঁকত।
দালির ব্যক্তিগত জীবন যেমন উদ্ভটতা ও পাগলামিতে ভরপুর ছিল, তেমনি খামখেয়ালির কমতি পড়েনি পেশাগত জীবনেও। শিল্পী জীবন তথা পেশাগত জীবনেও দালি যেখানে গেছেন, যে কাজ করেছেন মানুষের মাঝে বিস্ময় সৃষ্টি করে গেছেন। একবার মরিস নামে এক ব্যবসায়ী তাঁর নতুন শোরুম সাজসজ্জা করার জন্য দালিকে নিয়োগ করলেন। মরিসের উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত কাউকে দিয়ে শোরুমের সাজসজ্জা করতে পারলে মানুষজন তাতে আকৃষ্ট হবে। তার ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রচার হবে। তাই তিনি দালিকে ঠিক করেছিলেন। কারণ দালি ততদিনে জনপ্রিয়, বিশ্বের মানুষের কাছে আগ্রহের অন্যতম বিষয়। কিন্তু শোরুম উদ্বোধনের দিন যতই এগুচ্ছে, মরিস দেখলেন দালি কোনো কিছুই করেননি। মরিস জানতে চাইলে দালি বলেন, উদ্বোধনের দিনই তাঁর কাজ সুসম্পন্ন হবে। শোরুম উদ্বোধনের দিনে আবারও সেই দালিচিত কাজটি হলো। সবাই এসে দেখলেন সুররিয়ালিজমের মহান শিল্পী শোরুমের একটি কাচের পাত্রে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর এ খবর পেয়ে সাংবাদিক, কৌতূহলী মানুষজন ছুটতে লাগলেন মরিসের শোরুমের দিকে। হাজার হাজার মানুষ সেদিন এলো দালির এই কাণ্ড দেখতে। দালি মরিসকে হেসে বললেন কেমন হলো সাজসজ্জা। পেশাগত জীবনে দালি এমনই ছিলেন।
‘মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব’-এর জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে সালভাদর দালির দেখা হয়েছিল। দালি তাঁর নিজের লেখা মস্তিষ্কবিকৃতি বিষয়ক একটি প্রবন্ধ ফ্রয়েডকে পড়তে দিয়েছিলেন। দালির ভাষ্যে : ‘বিদায় নেওয়ার আগে ভাবলাম, মস্তিষ্কবিকৃতি বিষয়ক আমার প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ তাঁকে দিই। যে ম্যাগাজিনে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, পাতা বের করে তাঁকে সবিনয় অনুরোধ জানালাম, সময় পেলে তিনি যেন তা পড়ে দেখেন। পত্রিকাটির দিকে কণামাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে ফ্রয়েড আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি আগ্রহী হবেন এই ভেবে আমি বললাম, লেখাটি কোনো পরাবাস্তববাদী চালাকি নয়, বরং অতি উচ্চাশাপূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ। ...সম্পূর্ণ অমনোযোগী ফ্রয়েডের সামনে আমার গলা ক্রমশ উচ্চকণ্ঠ হয়ে আসছিল। তারপর, আমার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ অভিনিবেশ পরিবর্তন না করে স্তেফান জিভিগের দিকে তাকিয়ে ফ্রয়েড মন্তব্য করলেন, ‘স্পেনীয়দের মধ্যে এমন ফ্যানটিক আমি আর দেখিনি!’ অবশ্য যে যাই বলুক, যতই সমালোচনা করুক সেদিকে দালির বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তিনি গর্ব নিয়ে বলতেন, ‘প্রতিদিন সকালে আমি যখন জেগে উঠি, আমি আমার সেই সর্বোচ্চ আনন্দ লাভ করি, সালভাদর দালি হওয়ার আনন্দ।’
দালি মনে করতেন খেয়ালিপনাই হলো তাঁর নিয়তি। তিনি ভাবতেন সব অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তিনি করেন না। তাঁর সঙ্গে যেন খেয়ালিপনা প্রকৃতি প্রদত্তভাবেই এসে পড়ে। তাই তিনি বলতেন ‘আমি চাই বা না চাই, খামখেয়ালিপনা আমার নিয়তি।’ দালি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ৪০০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী লেখেন। ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি’ নামের আত্মজীবনীটিতে তাঁর অসংখ্য পাগলামির নজির পাওয়া যায়। অন্যান্য বিষয়ের মতো দালির আত্মজীবনীও বিতর্ক থেকে বাদ যায়নি। অদ্ভুত ও উন্মাষিক মন্তব্যের জন্যে জর্জ ওরওয়েল এই বইটিকে ‘অসৎ ও বাগাড়াম্বরে পরিপূর্ণ কল্পকাহিনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দালির উন্মাদনা এত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলো যে অনেক সমালোচক মনে করতেন, ‘দালি প্রথমে তাঁর বিচিত্র, অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দ্বারা আগে জনপ্রিয় হয়েছেন, পরে হয়েছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী!’
অনেক পাগলামি ও অদ্ভুত কাজ করলেও শিল্প চর্চায় এই সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর কোনো ক্রটি ছিল না। যার কারণেই তাঁর হাত দিয়েই বিশ্ব চিত্রকলা ‘দ্য বাস্কেট অব বেড, দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি, দ্য ফেশ অব ওয়ার, টুনা ফিশিং, মেটামরফোসিস অব নার্সিসাস, দ্য বার্নিং জিরাফ, ভিলাবার্টিন, মর্ফোলজিক্যাল ইকো, স্টিল লাইফ মুভিং ফাস্ট, আন চিন এন্ডালু-এর মতো অসংখ্য বিখ্যাত চিত্রকর্ম পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। একথা অস্বীকার করার জো নেই বিংশ শতাব্দীর শিল্প আন্দোলনে সালভাদর দালি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দালি প্রায় বলতেন, যদি চিত্রকলাকে ভালোবাসতে না পারেন, তাহলে নিজ প্রেমিকার ভালোবাসাসহ সকল ভালোবাসা গুরুত্বহীন হয়ে ধরা দেবে আপনার কাছে। সালভাদর দালিই পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র চিত্রশিল্পী যাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে দুটি মিউজিয়াম রয়েছে। প্রথমটি ‘দ্য সালভাদর দালি মিউজিয়াম ফ্লোরিডা’ রয়েছে আমেরিকায় এবং দ্বিতীয়টি ‘দালি থিয়েটার অ্যান্ড মিউজিয়াম।’ একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, গ্রাফিক ডিজাইনার বিচিত্র মানুষ সালভাদর দালি ১৯৮৯ সালের ২৩ জানুয়ারি স্পেনে তাঁর জন্মভূমিতে মারা যান।
তথ্যসূত্র :
১। অন্তর্জাল, ২। দ্য সিক্রেট লাইফ অব দালি : ভাষান্তর : হাসান ফেরদৌস, ৩। ভিলবারট্রানের শতবর্ষ : আন্দালিব রাশদী, ৪। সুদূর অর্কেস্ট্রা : সালভাদর দালি/ফেরদৌস নাহার, ৫। বুনুয়েল-দালির পরাবাস্তব যাত্রা/রুদ্র আরিফ, ৬। সালভাদর দালি : গোঁফ নিয়ে বলা কথা/ সুমন রহমান, ৭। পাগলাটে চিত্রকরের গল্প/ আমির খসরু সেলিম।