উপন্যাস থেকে
বিজয়ের মুহূর্তখানি
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে থাকে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন ঘটতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা তাড়া খাওয়া শেয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালাতে চায় গর্তে। সে গর্ত আর পাবে কোথায়? সব একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছোট ক্যাম্পগুলোর দখল হারিয়ে তারা বড় ক্যাম্পে জড়ো হতে থাকে। আক্রমণ দূরে থাক, প্রাণের ভয়েই অস্থির তারা। এরই মধ্যে বুঝে গেছে যে কাঠখড় পুড়িয়ে আর লাভ বিশেষ নেই। এখন কোনোমতে প্রাণটা বাঁচিয়ে টিকে থাকতে পারলে হয়। সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে এ সময় আত্মসমর্পণের ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায় ভেতরে ভেতরে। গুলির মুখে মরার চেয়ে অস্ত্র জমা দেওয়া ভালো। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দি হয়ে প্রাণে বাঁচার অন্তত এই একটাই তরিকা তখন সামনে।
ওদিকে চারদিকে উচ্ছ্বসিত জনতা বিজয়ের প্রহর গুনছে অধীর অপেক্ষায়। দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা বীরবিক্রমে দখল করে নিচ্ছেন পাকিস্তানি সেনাঘাঁটি। স্থানীয় ঘাঁটি দখল শেষে তাঁরা দোর্দণ্ডগতিতে অগ্রসর হচ্ছেন ঢাকার দিকে। পথে বাধা দেওয়ার কেউ তেমন নেই। যারা পড়ছে সামনে, তারা দাঁড়াতেই পারছে না। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। রীতিমতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা তাদের। রাজধানী ঢাকা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর সদস্যরা।
পাকিস্তানি সমরাধিনায়ক আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ঘামছে রীতিমতো। একেবারে গলদঘর্ম যাকে বলে। স্থির হতে পারছে না কিছুতেই। ওঠবস ওঠবস করছে। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা হচ্ছে তার। বাচ্চা ডেলিভারির আগে যেমন ব্যথায় কাতরাতে থাকে প্রথম বাছুর দিতে যাওয়া গাভী, নিয়াজির অবস্থা হয়েছে সে রকম। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। একটু আগে জগভর্তি করে পানি দেওয়া হয়েছিল সামনে। আবারও তিনি পানির জন্য টেবিল চাপড়াল। পানি বেশি খেলে বাথরুমের বেগ বাড়ে। নিয়াজি একটু পরপর যাচ্ছে আর আসছে।
ঢাকার আকাশে ক্রমাগত চক্কর দিচ্ছে মিত্রবাহিনীর জঙ্গিবিমান। আকাশে-বাতাসে কম্পন তুলে চক্কর খেতে থাকা এসব বিমান থেকে ছাড়া হচ্ছে শত শত প্রচারপত্র। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান। এই আহ্বান এ দেশের মুক্তিকামী জনতার জন্য ছিল চরম আনন্দের পূর্বভাগ, অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য চরমতম লজ্জার। যুদ্ধ করতে এসে অস্ত্র সমর্পণ অনেকটা লুঙ্গি খুলে রাখার মতো ব্যাপার। আমজনতার ইজ্জত লুঙ্গির নিচে হলেও সেনাবাহিনীর ইজ্জত তাদের কোমরের বেল্টে! এইটাই খুলে রাখার আহ্বান করা হচ্ছে তাদের। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু সেই কায়দাও নেই এখন। নিয়াজির পেটে ব্যথা না হয়ে উপায় কী! ঘন পেচ্ছাব না হয়েই বা উপায় কী!
১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ভারতীয় বাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধীন ৯৫ ও ১৬৭ মাউন্টেন ব্রিগেড দুটি ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সান্ট সিংহের নেতৃত্বে দ্রুততার সঙ্গে জামালপুর-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-মির্জাপুর-জয়দেবপুর-টঙ্গি অ্যাক্সিস ধরে উত্তর দিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল। ১৬৭ মাউন্টেন ব্রিগেড সাভার এলাকায় আসার পর তাদের সঙ্গে যোগ দেন ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি জেনারেল নায়াগ্রা। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও কিছুক্ষণ পর এসে মিলিত হন তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকেন ঢাকার দিকে। ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে এই বাহিনী মিরপুর ব্রিজে এসে পৌঁছালে জেনারেল নায়াগ্রা নিয়াজিকে আবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান।
ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! মাত্র কয়েক দিন আগেই পূর্ব বাংলার এই অঞ্চলে রীতিমতো খুন-ধর্ষণের রাজ্য কায়েম করা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধানরা, সবুজ শ্যামল এই মাটিকে মৃত্যুর বিভীষিকায় পরিণত করা পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর সেনাপতিরা আত্মসমর্পণের আয়োজন করতে বসছেন আলোচনায়! পাকিস্তানি বাহিনীর হম্বিতম্বি সব খতম! শ্বাস আটকে আছে গলার ভেতর। কোনোরকমে সেটা খালাস করতে পারলে বাঁচা। লেজ গুটিয়ে টেবিলের আলোচনায় বসার জন্য এখন উদগ্রীব তারা। নিয়াজি একা নয়। তার সঙ্গে আছে সেনাবাহিনীর বাঘা বাঘা সব অফিসার। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদ, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফসহ আরো কয়েকজনকে নিয়াজি জড়ো করেছে এই মাথায় ঘোল ঢালা কার্যক্রমের আলোচনায়।
নিয়াজির ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা! উপস্থিত মানুষের শ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রাতের বেলায় অন্ধকারে এমন পরিবেশকে ভুতুড়ে বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়া পড়ে শোনানো হচ্ছে! খসড়া দলিল পড়ার শব্দ ছাপিয়ে কানে আসছে একটা ফোঁস ফোঁস আওয়াজ। নিয়াজি কাঁদছে! ফ্যাচফ্যাচে কান্না! বাচ্চা ছেলেপেলে নিজের খেলনা-পুতুল নিজের হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেলে একা একা যেমন ফিচফিচে কাঁদে। কেউ একজন কিছু জিজ্ঞেস করলেই সেই কান্না শুরু হবে প্রবল বেগে। নিয়াজি কাঁদছে সে রকম করে নাক টেনে টেনে। তাকে কেউ টোকা দিচ্ছে না, তাই ঘর মাতিয়ে কাঁদতে পারছে না!
কেঁদেকেটে আর লাভ কী! মাথামুড়ে ঘোল ঢালা কার্যক্রমের সব বন্দোবস্ত সম্পন্ন। যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে তাতে কিছু আপত্তি জানিয়েছিল জেনারেল রাও ফরমান আলি। নিয়াজিরও ইচ্ছে ছিল সে রকম। তবে ওসব আর হালে পানি পেল না। বাধ্য হয়ে নিয়াজি খসড়া প্রস্তাব মেনে নিল। সে চাইল যা ঘটার অফিসেই ঘটুক। আত্মসমর্পণ অফিসেই করার ইচ্ছে পোষণ করল সে। নিয়তি খারাপ। তার এই ইচ্ছেও জলাঞ্জলি দিতে হলো। আবারও পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল। মনকে বোঝাতে চাইল কয়েক দিন ধরে বাথরুম ক্লিয়ার হয় না। তাই হয়তো ব্যথা হচ্ছে পেটে!
ঠিক হলো আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে।
১৬ ডিসেম্বর, বিকেল ৪টা। সেই রেসকোর্স ময়দান, সেই লাখ জনতার সমাবেশস্থল। যেখান থেকে মার্চ মাসের ৭ তারিখ শেখ মুজিব দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেখানেই প্রস্তুত করা হয়েছে মঞ্চ। এখানেই নত হবে উদ্ধত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মস্তক। রচিত হবে নতুন ইতিহাস। দলে দলে মানুষ হাজির হয়েছে সেই ইতিহাসের সাক্ষী হতে। এর আগে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সস্ত্রীক হাজির হয়েছেন ঢাকায়। দীর্ঘ নয় মাস চলতে থাকা নারকীয় এই নাটকের যবনিকা পতন অনুষ্ঠানের তিনি অন্যতম প্রধান কুশীলব। তাঁর কাছেই জমা পড়বে নিয়াজির রিভলবার। যদিও সেনাবাহিনীর রীতি অনুযায়ী আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে নিয়াজির তরবারি সমর্পণ করার কথা। নিয়াজি জানাল, তার কোনো তরবারি নেই। আপাতত রিভলবার দিয়ে তরবারির কাজ চালিয়ে নেওয়া হবে বলে ঠিক হলো।
সময় যত গড়াতে লাগল, বাড়তে লাগল জনতার স্রোতে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার জনতার ঢল নামল রেসকোর্স ময়দানে। ঢাকার আশপাশের অঞ্চলে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এসে হাজির হয়ে গেছেন। উত্তেজিত মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সামাল দিয়ে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিয়াজিকে নিয়ে রেসকোর্সে আসতে থাকা গাড়িতে বার কয়েক হামলা করার চেষ্টা করেছেন কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা। নিয়াজিকে ছিনিয়ে নেবেন তাঁরা। নিয়াজি কুখ্যাত অপরাধী। তাকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক বলে দাবি করেছেন তাঁরা। জেনারেল জ্যাকব দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন পরিস্থিতি। তিনি আগেই নিশ্চয়তা দিয়েছেন, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সামরিক অফিসাররা যথাযথ সুবিধা পাবে। প্রাণের নিশ্চয়তা সম্মানের সঙ্গে দেওয়া হবে তাদের। তবুও পরিস্থিতি ঘোলাটে। প্রবল জনতার চাপ। নয় মাস যুদ্ধ করে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে সকলে। সকলের রক্তচক্ষু নিয়াজির ওপর। এসেছেন মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। সমবেত জনতার ভেতর প্রবল উচ্ছ্বাস।
বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট। কনকনে শীতের দিন। সন্ধ্যা নেমে গেছে। অন্ধকারের চাদর গায়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে রেসকোর্স। কোনো আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি। গোধূলি অন্তের এই আবছায়া আলোয় একটা টেবিলে পাশাপাশি বসেছে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানি সমরাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। সামনে মেলে রাখা আত্মসমর্পণ চুক্তির বই। সেখানে সই করে নিজের পয়েন্ট ৩৮ রিভলবারটা হস্তান্তর করে নিয়াজি। তার চোখ ভিজে ওঠে! এই মুহূর্তে পৃথিবীতে তার চেয়ে পরাজিত আর কেউ নেই! ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করে সে! নিয়াজির এই নত মুখের সামনে হর্ষোল্লাসে নাচতে থাকে বিজয়ী জনতা। পৃথিবীর ইতিহাসে পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিল একটি একটি নাম। একটি দেশ। বাংলাদেশ!
(প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘জলপাই রঙের কোট’ থেকে)