চিত্রকলা
রঙের দুনিয়ায় সুখসন্ধানী ‘ফভিজম’
সময়কে খণ্ডিতভাবে যদি ‘শিল্পের সময়’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে শিল্প যে কালে কালে বর্ণিল হয়ে ধারণ করেছে বহুমুখী সময় ও প্রতিক্রিয়া, তার শেকড়ে রয়েছে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি মতবাদই শিল্পের জন্যে নতুন চিন্তা বহন করেছে এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোয় শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছে মানুষের দর্শন, অনুভব ও উপলব্ধির বিচিত্র রূপকে। স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কারণেই প্রেম, প্রতিবাদ, প্রকৃতি, কষ্ট, দহনসহ আরো নানা অনুষঙ্গকে একেক শিল্পী একেকভাবে শিল্প মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এতে কেবল শিল্পের ভুবন প্রসারিতই হয়নি, সমৃদ্ধও হয়েছে। বিগত মতবাদগুলোর মতোই ফভিজম শিল্পের জগতে ভিন্ন একটি চিন্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
ফরাসি ‘ফভ’ (fauves) থেকেই ফভিজম শব্দের উৎপত্তি। ফরাসি ভাষায় ফভ বলতে বন্য পশুকে বোঝায়। এ ঘরানার শিল্পীদের ফভিস্ট বলা হতো। ফভিজম আন্দোলনের অগ্রগামী শিল্পী ছিলেন হেনরি মাতিস ও আন্দ্রে ডেরাঁ। যদিও ১৮৯৮ সালে হেনরি মাতিস এ ধারার ছবি এঁকেছিলেন কিন্তু এ আন্দোলনের পরিপূর্ণ রূপটি প্রকাশিত হতে আরো কয়েক বছর সময় লেগেছিল। ফভিজম শিল্প আন্দোলনের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯০৫ সালে। এ প্রদর্শনী থেকেই ফভিজম শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। ১৯০৫ সালে হেনরি মাতিস, আন্দ্রে ডেরাঁ, আলবার্ট মারকোয়ে প্রমুখ শিল্পীরা প্যারিসের ‘সালো দ্য অটাম’-এ তাঁদের চিত্রকর্ম প্রদর্শন করেন। গ্যালারির চারদিকে চিত্রকর্ম টানানো হলেও মাঝখানে ইতালীয় রেনেসাঁসের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘দোনাতেলেস্না’ রাখা হয়েছিল। লুই ভকসেল নামের একজন সমালোচক সেই প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। সম্ভবত গ্যালারিতে নতুন ধারার অদ্ভুত চিত্রকর্মের মধ্যে নান্দনিক ভাস্কর্য ‘দোনাতেলেস্না’র উপস্থাপন তাঁর কাছে উদ্ভট মনে হয়েছিল। এ যেন চারদিকে অসংখ্য বাঁদরের মাঝে একটি মুক্তার মালা! লুই ভকসেল তখন এ প্রদর্শনী সম্পর্কে ‘গিল ব্লেস’ পত্রিকায় সমালোচনা করতে গিয়ে `cage aux fauves’ শব্দবন্ধটি লিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই fauves শব্দটি থেকেই ফভিজম শব্দটির প্রচলন হয়।
ফভিজমের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে কিন্তু বিস্তৃতভাবের একটি মন্তব্য করেছেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। তিনি লিখেছেন, ‘ফভিজম চিত্র আন্দোলনের মূল ভিত্তি হলো অমিশ্র রঙের উল্লাস। এই চিত্রমালার অবিমিশ্রিত রঙের ভেতর দিয়ে অভিব্যক্তির স্বাধীনতা ও পরিপ্রেক্ষিত দর্শককে প্রথম দর্শনে হতবুদ্ধি ও হতভম্ব করে দেয়। গতানুগতিক ও ক্লাসিসিজমের বিরুদ্ধে যেমন ইম্প্রেশনিস্টদের উপস্থিতি, তেমনি নিউ ইম্প্রেশনিস্টদের বিরুদ্ধাচরণ করে ফভ্বাদের প্রকাশ।’ এ জন্যই ফভিজম ধারার শিল্পীরা উজ্জ্বল রঙের প্রয়োগ করতেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা রঙের বৈপরীত্য মানেননি।
প্রকৃতি ও জীবনে যে রং স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এ ধারার শিল্পীরা স্পষ্টত তার বিরুদ্ধাচরণ করলেন। বাস্তবতার রঙের জগৎ থেকে তাঁরা নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। কেন না তাঁরা মনে করতেন, অনুভূতির সঙ্গে রঙের সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। অনুভূতির পরিবর্তনের কারণেই রঙের মধ্যে তারতম্য দেখা দেয়। বাহ্যিক রংকে উপেক্ষা করে নিজেদের অনুভূতি ও চেতনার পরিবর্তনশীল রঙের ওপর দাঁড়িয়ে শিল্পীরা তাঁদের ক্যানভাস রাঙাতে আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে অন্যসব শিল্পীর তুলিতে বৃক্ষ, ফুল, নদীসহ পরিচিত বিষয়-আশয় যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, ফভিজমে এমন দৃশ্যাবলি সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি। মূলত পরিচিত রঙের পৃথিবীকে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন ফভিজমের শিল্পীরা।
ফভিজমের নেতৃত্বদানকারী শিল্পী হেনরি মাতিস তাঁর চিন্তা সম্পর্কে বলেছেন, ‘বর্ণ যেহেতু আমাদের চেতনার সারথি এবং তার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে তবে তাকে আমরা ভিন্ন পথে চালিত করি না কেন। আমাদের দেহে ও অবয়বে তো সাদা, বাদামি, কালচে, ঈষৎ গোলাপি ছাড়া কোনো রং নেই। এতকাল তাহলে আমরা লাল, হলুদ, নীল আর সবুজের অমিশ্র ছোপে এবং আরো কত বিমিশ্র বর্ণযোজনে মানুষকে এঁকেছি কেন। তার অর্থ বর্ণের সত্য হচ্ছে চিত্রকলার মর্মকথা। আমি যদি পরস্পরবিরোধী রঙের বিন্যাস মানুষের মুখে চাপাই, তাহলে তার অন্তর্লীন সংক্ষুব্ধতা আরো জর্জর ভাষা পাবে।’
ফবিজমের চিত্রকর্ম সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আন্দ্রে ডেরাঁর ‘Charing Cross Bridge’ চিত্রকর্মটি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। তাহলে এ ধারা সম্পর্কে সহজে উপলব্ধি করা যাবে। ডেরাঁ ছবিটি এঁকেছিলেন ১৯০৬ সালে। এ ছবি কোনো ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী আঁকলে নিঃসন্দেহে প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বভাব বজায় থাকত। চেষ্টা থাকত মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করার। কিন্তু আন্দ্রে ডেরাঁ ছবিতে প্রচলিত রঙের ব্যবহার করেননি। এ ছবিতে রঙের ব্যবহার খুব তীব্র। ব্রিজের নিচের প্রবাহমান পানির কিছু অংশকে হলুদ, কিছু অংশকে নীল রং দিয়ে আঁকা হয়েছে। ঢেউ বোঝাতে আলাদা রঙের আঁচড় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দূরের বাড়িঘর, বৃক্ষসম্ভার অর্ধেক সবুজ, অর্ধেক নীল রঙে মোড়ানো। আকাশকে আঁকা হয়েছে লালচে আভায়। তবে পুরো ছবিতেই লাল রঙের আধিপত্য বেশি। নিঃসন্দেহে প্রচলিত যে রঙের ধারণা, তার তোয়াক্কা করেননি আন্দ্রে ডেরাঁ। যার ফলে ‘Charing Cross Bridge’ চিত্রকর্মে তিনি অনুভূতির পরিবর্তনশীল রংকে ব্যবহার করেছেন। প্রচলিত রং দিয়ে ক্যানভাস না রাঙিয়ে তিনি অন্তর্গত চেতনার রঙে ক্যানভাসকে সাজিয়েছেন। শুধু ডেরাঁ নন, ফভিস্ট সব শিল্পীই রং ব্যবহারের এই স্বাধীনতা উপভোগ করেছিলেন।
ফভিজম ধারার শিল্পীরা শিল্পের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আন্দ্রে ডেরাঁ বলতেন, `Art must not be intelligent; art is a jouisance, an enjoyment.’ হেনরি মাতিস তাঁর আঁকাআঁকি নিয়ে বলেছেন, আমি কখনো কোনো জিনিসপত্র আঁকি না। আমি কেবল জিনিসপত্রের মধ্যে পার্থক্য আঁকি।
প্রত্যেকটি মতবাদকেই প্রতিষ্ঠা পেতে প্রতিকূল পরিবেশকে অতিক্রম করতে হয়েছে। যেহেতু এ ধারার শিল্পীরা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন—স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ তাঁদের আঁকাকে গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯০৫ সালের প্রদর্শনীতেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে হেনরি মাতিসের আঁকা ‘ওমেন উইথ এ হ্যাট’ ছবিটি। সে সময়ে কোনো এক বিক্ষুব্ধ দর্শনার্থী রাগে-ক্ষোভে এ ছবিটিতে নখের আঁচড় পর্যন্ত দিয়েছিলেন। হেনরি মাতিস প্রথম দিনে এ প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। প্রথম দিনের আগত দর্শনার্থীরা মাতিসকে সমালোচনার বাণে জর্জরিত করেছিলেন। এ বাণ এতই তীব্র ছিল যে, মাতিস আর গ্যালারিতে যাননি। কিন্তু বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ শিল্প আন্দোলন থেমে থাকেনি। যার ফলে ফভিজম পরবর্তীকালে শক্তিশালী একটি মতবাদে পরিণত হয়। হেনরি মাতিস, আন্দ্রে ডেরাঁ, ডেনেন, মেটজিঙ্গার, ব্রাক, রাওল ডুফি, ম্যানগুয়িন, আলবার্ট মারকোয়ে, এলিস বেইলি, জর্জ রুয়ো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ফভিস্ট শিল্পী।
ফভিজমের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হলো : হেনরি মাতিসের Woman with a Hat, Blue Nude II, Luxury, Calm, and Desire, The Green Stripe, A Glimpse of Notre-Dame in the Late Afternoon, The Joy of Life; আন্দ্রে ডেরাঁর ‘Portrait of a Young Girl, Self-portrait, The Drying Sails, Charing Cross Bridge; ভ্লামিনকের The River Seine at Chatou, Barges on the Seine; জেন মেটজিঙ্গারের Colored Landscape with Aquatic Birds, কিস ভেন ডেনেনের Woman with Large Hat ইত্যাদি।
ফভিস্টরা শিল্প আন্দোলনে নতুন দৃষ্টি ও চিন্তা যুক্ত করেছিলেন। পাশাপাশি রঙের উপস্থাপন নিয়েও তাঁরা সমকালে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফভিজম একটি প্রভাবশালী শিল্প আন্দোলন হলেও এটির জোয়ার দীর্ঘস্থায়ী ছিল। ১৯০৪ সাল থেকে প্রভাব বিস্তার করা এ মতবাদটি ১৯১০ সালের দিকে এসে স্তিমিত হয়ে পড়ে। যদিও এর পরবর্তী সময়েও ফভিজমের চর্চা জার্মানি, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের চিত্রকর্মে লক্ষ্য করা যায়।
সূত্র :
ক) শিল্পকলার ইতিহাস/ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
খ) ফভবাদ/ মুর্তজা বশীর
গ) Fauvism Movement, Artists and Major Works
ঘ) ফিলাডেলফিয়া : শিল্পের গল্প/মইনুদ্দীন খালেদ
ঙ) অন্তর্জাল