শওকত আলীর সুস্থতা কামনা
৬ জানুয়রি (২০১৮) থেকে গুরুতর অসুস্থ কথাসাহিত্যিক শওকত আলী। তাঁকে ঢাকার একটি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগে থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ। ৮১ বছর বয়সী শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর দিনাজপুর জেলার থানা শহর রায়গঞ্জে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ছাত্র জীবনে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন শওকত আলী। সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও কিছুদিন পরে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ভূতপূর্ব জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। বামপন্থিদের ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন শওকত আলী।
এছাড়া দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, ইত্তেফাকে তাঁর গল্প, কবিতা ও শিশুতোষ লেখা প্রকাশিত হয়। তবে উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে একুশে পদক পান শওকত আলী। পরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার পান। ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোতে’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ উপন্যাসত্রয়ীর জন্য তিনি ‘ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, ‘যাত্রা’, ‘অপেক্ষা’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘অবশেষে প্রপাত’, ‘জননী ও জাতিকা’, ‘জোড় বিজোড়’। ‘উন্মূল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’সহ বেশ কয়েকটি মূল গল্পগ্রন্থ প্রকাশ ও সম্পাদনা করেছেন তিনি। শওকত আলী অসুস্থ কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে তাঁর সৃষ্টি স্মরণ করতে হবে যতদিন বাংলা ভাষা টিকে থাকবে। কেবল ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোতে’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ উপন্যাসত্রয়ীর একটি আলোচনা করলেই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্তমানসের বিচিত্র প্রবণতা সুবৃহৎ সময়-প্রবাহের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে শওকত আলীর ট্রিলজি-দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫), কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬) এবং পূর্বরাত্রি পূর্বদিক (১৯৮৬)-এ। মধ্যবিত্তমানসের ‘স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও আত্মরতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসন্ধান এবং রাজনীতিসজ্ঞানতার’ অঙ্গীকারে শওকত আলী স্বাধীনতা-উত্তর কালপর্বে প্রতিকূল ও অবরুদ্ধ পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও তাই সমকালীন নয়, বরং ১৯৬৫-১৯৬৯ কালপর্বের ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে মধ্যবিত্তমানসের রাজনৈতিক জীবনের দীর্ণ, রক্তাক্ত এবং রূপান্তরকামী চেতনাকে উদ্ঘাটন করেছেন। ঔপন্যাসিকের ‘মধ্যবিত্ত জীবনের কুণ্ডলায়িত সময়ের চালচিত্র’ অঙ্কনের পশ্চাতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অস্থির ও দ্বন্দ্বময় রাজনৈতিক জীবনজিজ্ঞাসা বহুলাংশে সক্রিয় ছিল। কারণ ‘পাক আমলের রাষ্ট্রদর্শের পুনরুজ্জীবন, রাষ্ট্র ও জনতার দূরতিক্রম্য ব্যবধান, জনকল্যাণের পরিবর্তে দলের স্বার্থরক্ষার প্রবণতা, সদর্থক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের বাধাদান, প্রতিবাদের পরিণামে জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা প্রভৃতি রাজনৈতিক মত প্রকাশের পথকে স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত করে তোলে। এই জটিল পরিস্থিতিতে ঔপন্যাসিকরা রাজনৈতিক জীবনজিজ্ঞাসাকে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। বর্তমানের প্রতি অবিশ্বাসে তাঁরা পরিভ্রমণ করেছেন ভাষা-আন্দোলনের চেতনাবীজে, ঊনসত্তরের গণমিছিলে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘ জীবনাবেগে।’
তবে শওকত আলী কেবলমাত্র ১৯৬৫-১৯৬৯ কালখণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি, তিনি বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশের দ্বন্দ্বময়, জটিল ও ক্ষতবিক্ষত জীবনাদর্শ উন্মোচন করতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন মহাকাব্যিক শিল্পসুষমাময় বিশাল সময়পর্বকে। এজন্য আপাত দৃষ্টিতে এই ত্রয়ী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও উপন্যাস-কাহিনীর প্রধান প্রবাহ রোকেয়া আহমদ রাখীর আত্মজীবন, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত মনে হলেও এ-ট্রিলজির কেন্দ্রীয় নায়ক মূলত প্রবহমান সময়খণ্ড। যে সময়খণ্ডের ভেতর ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল আবর্তিত, যে কালখণ্ডের ভেতর জাতিসত্তা অন্বেষণে তরুণসমাজ মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায়, আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে বিচলিত, সেই সময় ও কালের ‘বস্তুময় জীবনদৃষ্টি; সমাজ-অভিজ্ঞান ও ইতিহাসজ্ঞান’ এই ট্রিলজির অন্তঃশীল রহস্য।
দক্ষিণায়নের দিনে মূলত ১৯৬২-১৯৬৬ কালপরিসরের রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে রাখীর ব্যক্তিকথা, রাখীর সরকারী চাকরিজীবী পিতা রাশেদ আহমদের অতীত জীবনের সুখস্মৃতিমন্থর করা, বড় বোন বিলকিস-হাসান ভাইয়ের দাম্পত্য সংকটে চিত্রালেখ্য এবং ‘রাজনীতির প্রচণ্ড ঝড়’ ও ‘উত্তাল অস্থির সময়ের নির্মম আকর্ষণে বড়ো ভাই মনির মৃত্যু প্রসঙ্গ প্রভৃতি অনুষঙ্গে ষাটের দশকের মধ্যবিত্তজীবনের সমগ্র প্যাটার্নটিকেই শনাক্ত করেছেন শওকত আলী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করা রাখীর ঢাকার রাজপথে দুপুর বেলা হাঁটার চলমানতায় ও আকস্মিক আকাশময় মেঘ জুড়ে বৃষ্টি নামার দৃশ্যের ভেতর দিয়ে উপন্যাসের কাহিনীর সূত্রপাত। ব্যবসা, ইন্ডাষ্ট্রি, চাকরি সর্বত্রই ঠিকাদারী সোসাইটির ভেতর রাখী আবিষ্কার করে নিঃসঙ্গ পিতা রাশেদ সাহেবকে। যে রাশেদ আহমদ ১৯৩০-১৯৬৫ এই দীর্ঘ সময় প্রবাহে দেখেছেন ‘জীবনের অভাবনীয় রূপবদল’। এই রাশেদ সাহেবের জীবনবৃত্তে ঔপন্যাসিক বিধৃত করেছেন ‘মধ্যবিত্তমানসের ব্যর্থতাবোধের ক্রমবর্ধমান ইতিবৃত্ত’ : তাঁর মতো সুখী কেউ হয়নি-আবার তাঁর মতো সর্বস্ব কেউ হারায়ওনি। জীবনকে ইচ্ছে মতো গড়ে তুলেছিলেন, মনোমত সাজাচ্ছিলেন। আর সেজন্যেই হয়তো বা শেষপর্বে এসে জীবন তাঁর ওপর দারুণ প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করেছে। রাশেদ সাহেব তারপর থেকে আরও সজাগ হয়েছেন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। যাদের জন্য সজাগ হবেন, তারাতো সবাই তাঁর আয়ত্ত্বের বাইরে।’
‘জীবন ও রাজনীতি’র মধ্যে সঙ্গতি সন্ধান করতে গিয়ে একমাত্র পুত্র মনির মৃত্যুর পর রাশেদ সাহেব জীবন সম্পর্কে সজাগ হতে চেয়েছেন কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেন নি। বড়ো মেয়ে বিলকিস আহমদের স্বামী হাসান চাকরি ছেড়ে ‘ডেল্টা কর্পোরেশন’ গঠন করে কনস্ট্রাকশন-ক্যারিয়িং-এর কাজ করার জন্য। এই ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি হাসানের অন্তর্গত সত্তাকে ব্যবচ্ছেদ করে দেয়। এজন্য অধিক অর্থের প্রত্যাশায় হাসান এক সময় নিজ স্ত্রী; যাকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, তাকেও উপেক্ষা প্রদর্শন করে। পুঁজির কাছে বিক্রি হয় বিলকিসের নারীত্ব। রাশেদ সাহেব এসব পারিবারিক ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে নিজেকে আবিষ্কারের জন্য স্মৃতির দ্বারস্থ হন। রাশেদ সাহেবের স্মৃতিমন্থনে বাঙালি মুসলমানমধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতার ইতিহাস বিবৃত; তাঁর স্ত্রী সালমা-কেন্দ্রিক ঘটনার বিবরণও উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। তিনি দেখেছেন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার ভেতর সালমার ভালোবাসার অবিচল দৃঢ়তা, বিশ্বাসের আস্থা। কিন্তু মনির বিশ্বাস অন্বেষণ ও তার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, আত্মস্থ হতে চেয়েছেন। এজন্য রাখীর এম. এ. ডিগ্রির পর মাজহার খানের ওভারসিজ অফিসে চাকরি গ্রহণ সম্পর্কে রাশেদ সহেব নীরবতাকে শ্রেয় জ্ঞান করেছেন। অবশ্য তিনি তাঁর মতামত জানাতে ভুল করেন নি। তাঁর ছিল আত্মবিশ্লেষণের ক্ষমতা। সমগ্র জীবন ব্যাপী তাঁকে যে অভিজ্ঞান প্রদান করেছে তাতেই তিনি পারিবারিক পরিমণ্ডলে দেখতে পেয়েছেন ক্রমভগ্ন, স্বপ্নব্যবচ্ছেদময় আপনজনদের করুণ পরিণতি।
অন্যদিকে মনির ‘বিশ্বাস রাখতে’ না পারার ইতিবৃত্তের পাশ্চাতে নিহিত রয়েছে তৎকালীন দ্বিধাবিভক্তি বাম রাজনীতির অন্তর্সংঘাত। এই বামরাজনীতির সম্পৃক্ততার সূত্রে মনির বন্ধু সেজানের উপন্যাসে আবির্ভাব। সেজান ও মনি বামপন্থী রাজনীতির অন্তর্মুখ দ্বন্দ্বের বিনষ্টির শিকার হয়েছে। কারণ ‘শওকত আলীর বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মরাই একমাত্র আদর্শবাদী, সর্বত্যাগী, সংসারবিমুখ এবং রাজনৈতিক পরিশ্রমজনিত কারণে সদাই অসুস্থ থাকে।’ এজন্য উপন্যাসে মনির মৃত্যু আসন্ন হয়ে উঠেছে ঢাকা থেকে দূরে রংপুরের কোন এক গ্রামে দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। মনির মৃত্যু, রাখীর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন পরবর্তী চাকরিজীবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জামানের সঙ্গে তার আকস্মিক বিবাহ-বন্ধন ও সেজানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্বিধাদীর্ণ লেখ্যচিত্র অঙ্কনের ভেতর দিয়ে দক্ষিণায়নের দিন সমাপ্ত হয়।
কিন্তু রাশেদ সাহেব এসব ঘটনার দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন নি। এজন্য মনির মৃত্যুর পর তাঁর ভেতর জীবন সম্পর্কে অবিশ্বাসের যে জিজ্ঞাসা ও দুর্ভাবনা জেগেছিল তারই ঔপন্যাসিক-বিবরণ পাওয়া যায় বিশ পরিচ্ছেদে : ‘রাশেদ সাহেবকে তাই অপেক্ষা করতে হবে। হ্যাঁ শুধুই অপেক্ষা, বিপর্যয় এসে কখন তাঁকে আঘাত করার, তারই জন্য অপেক্ষা। হ্যাঁ শুধুই অপেক্ষা, ১৯৬৬ সালে এসেও শুধুই অপেক্ষা। কিছুই কারণ নেই তোমার, শুধুই সংশয় আর অবিশ্বাস, গোঁজামিলের ফাঁকে ফাঁকে সন্দেহ আর সংশয় শিকড় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, সেই ১৯৬২ সাল থেকেই, ১৯৬৬ সাল থেকে ধ্বসে পড়তে লাগলো স্তম্ভ আর দেয়াল। যারা ঐক্যের ডাক দিয়ে রাজনীতিতে নেমেছিলো, এক সময় দেখা-গেলো তারা মত পাল্টাচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাচ্ছে। পার্লামেন্টারী রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু করণীয় নেই, ক্ষমতায় না গেলে কিছু করা যাবে না। এই সব তত্ত্ব তারা সামনে আনলো। যারা বিপ্লবের জন্যে রাজনীতিতে এসেছিলো-তারা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নামতে চাইলো। তাদের মধ্যেই আবার নানা দৃষ্টিভঙ্গী।... কিন্তু একজন সৎকর্মী এই মত ও পথের জটিল বিতর্কে কোথায় দাঁড়াবে! তার কী করণীয়?’
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সেজান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সুবিধাবাদী পার্টির তাত্ত্বিক কর্মী ও নেতাদের কাছ থেকে। নেতৃত্বের সংহত অবস্থানের অভাবে ‘বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব’ না ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’-এই দ্বন্দ্বে পার্টির কর্মীরা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। লক্ষ্মীবাজারের ৪২ নম্বর গোপীদত্ত লেনের বাসায় রাখীর দৃষ্টিকোণ থেকে সেজানের রাজনৈতিক স্বরূপ ঔপন্যাসিক উদ্ঘাটন করেছেন নির্মোহ বর্ণনায়: ‘সেজান বলেছিলো; ভুল তোমাদের ধারণা-থিয়োরেটিক্যাল কথাবার্তা যারা তোমাদের শোনাচ্ছে তাদের ফিল্ড এ কাজ করতে বলো আগে। বইপড়া তত্ত্ব দিয়ে রাজনীতি হলে অধ্যাপকরা বড় রাজনীতিবিদ হতেন, তোমাদের কাছে এখন ব্রড বেসডয়ুনিটির কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে জাতীয় বুর্জোয়া পার্টিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করার জন্য- তাতেই নাকি বিপ্লব হবে। এসব কথা ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়।... বিপ্লবের বিকাশ বুর্জোয়াদের শান্তির মধ্য দিয়েই হয় না; বিপ্লবের বিকাশ বিপ্লবী কাজকর্মের মধ্য দিয়েই ঘটে। এ ব্যাপারে আমার শেষ কথা এদেশে সত্যিকার অর্থে প্রলেতারিয়েত যদি কেউ থাকে তো সে হলো এদেশের কিষাণ-ওদের সংগঠিত যদি করা না যায়; ওরা যদি নেতৃত্বে এগিয়ে না আসে তাহলে কোনো বিপ্লবী আন্দোলনই সফল হবে না।’
সেজানের বাসস্থানে রাজনৈতিক কর্মীদের তর্ক-বিতর্ককে রাখীর ‘ডিবেটিং সোসাইটির মিটিং’ মনে হয়েছে। এজন্য সেজানের সিরিয়াস অসুস্থ রোগীর জন্য পঞ্চাশ টাকা দিতে এসে সে ভেবেছে: ‘কী জন্যে সে এসেছে? কী ছেলেমানুষীতে তাকে পেয়েছিলো যে এতোখানি পথ ছুটে আসতে হলো তাকে?’ এরপর তার আকস্মিক বিবাহ সংবাদ সেজানকে প্রদানের মধ্য দিয়ে সে যেন নিজের অজান্তেই সেজানের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে। ‘আবার কবে আসছো? সেজান রাখীর মুখের দিকে তাকায়। শিগ্গীর বোধহয় পারবো না, রাখী সহজ হয়ে উঠতে চাইলো, জানালো, আমার বিয়ের কথা শুনেছেন বোধ হয়। বিয়ে! সেজান আকাশ থেকে পড়ে, কই শুনিনি তো? হ্যাঁ শিগ্গীর হচ্ছে, য়ূনিভার্সিটিতে হিষ্ট্রী পড়ান, জামান সাহেবকে চেনেন? সেজান কিছু বললো না। বিমূঢ় ক্লান্ত চোখে শুধু তাকিয়ে থাকলো। আর রাখী যতো দ্রুত পারে সেজানের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।... ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পায়ে হোঁচট লাগিয়ে রাখী গলি থেকে বার হলো। কেবলি কেউ যেন তাকে ধিক্কার দিচ্ছে মনের ভেতরে। রাখী, কেন, এসেছিলি তুই? কে আসতে বলেছিলো এখানে তোকে? কেবলি মনে হতে লাগলো, সেজান তাকে নিদারুণ অপমান করেছে। এমন অপমান জীবনে কেউ তাকে কখনো করেনি।’
বস্তুত মহাকাব্যিক সময়সারণির স্বতন্ত্র চরিত্র-দর্পণে মধ্যবিত্তজীবনের অস্তিত্ব-সংকটের দ্বন্দ্বময় কথাচিত্র শওকত আলীর ত্রয়ী উপন্যাসের প্রথমটি- ‘দক্ষিণায়নের দিন’(১৯৮৫) এ রূপায়িত। এক্ষেত্রে তিনি সফল কথাশিল্পী, কারণ ‘তাঁর লেখায় ছোট্ট মফস্বল শহর এবং শহরের মধ্যবিত্ত চরিত্ররা তাদের সমস্ত সহমর্মিতা ও শঠতা, লোভ ও আদর্শবাদ নিয়ে আশ্চর্যরকম জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে।’