মোহাম্মদ রফিকের গদ্য
কবি সুনীল সাইফুল্লাহকে নিয়ে এলিজি
‘পিতৃপরিচয় মুছবো বলে শেষাবধি মুছি নিজেকে’
[ দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে, ১/১৯৮১ ]
সমস্ত মৃত্যুই স্বাভাবিক। বিশেষত আমাদের এই পোড়া দেশে, এমন অকল্পনীয় বিতিকিচ্ছিরি আর্থসামাজিক পরিবেশে, যেখানে বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক, বলা যায় প্রায় অসম্ভব, সেখানে মৃত্যুই একমাত্র নিদারুণ নিয়তি। মৃত্যু দ্রুত এসে পড়ে; কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন প্রায় অসাধ্য সাধনের মতো, বিদ্রোহের অন্তঃশীল আবেগ। তাই মৃত্যুইচ্ছা যেমন অপ্রয়োজনীয় বিলাস-বাহুল্য, ঠিক তেমনি বাঁচার ইচ্ছা সৃষ্টির অদম্য অনুপ্রেরণা যা অবশেষে কুরে খায় সৃষ্টিকর্তাকে।
আর সৃষ্টির জন্যে এমনি অদম্য অনুপ্রেরণা ছিল সুনীল সাইফুল্লাহর অন্তর্গত রক্তধারায় নিরন্তর সক্রিয়। তার এই জেগে ওঠার প্রক্রিয়া, জীবন, জগৎ ও কর্মের সঙ্গে সংযোগ সেতু ছিল তার কবিতা। যে বয়সে সে মৃত্যুকে বেছে নিল, বলা যায় মৃত্যু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সে বয়সের তুলনায় তার কবিতার সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে একদম কমও নয়; নয় এড়িয়ে যাবার মতো সাধারণ, সাদামাটা শুকনো ঘাসের স্তূপ। তার কবিতা সম্পর্কে যে গুণবাচক শব্দটি অবশ্যই অনিবার্যভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা হলো, তার কবিতা একান্ত তার নিজস্ব, তার আপন রক্তগন্ধমাখা। কবিতা, তার সংগ্রামের অঙ্গীকার, বল্লমের ফলা যা তার নিজের দিকেই তাক করা।
তার কবিতা ছিল তার নিজস্ব একদম নিজস্ব, তার একান্ত নিজের বৃত্তে বেঁচে থাকা। এইসব কবিতা কর্মের মধ্যে অন্য কারো, অন্য অগ্রজ কোনো কবির বা কোনো সতীর্থের প্রভাব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব যেমন, অন্য কোনো ব্যক্তিত্বের প্রভাব তার জীবন রচনায় ছিল অকল্পনীয়। এর একটি জঠিল কিন্তু সাধারণ কারণ হয়তো এই যে সে কোনো আশ্রয় খুঁজে পায়নি, না কাব্যে না জীবনে। এবং এই কারণেই তার দূর যাত্রা হয়ে পড়েছিল এত বন্ধুর, বিপদসংকুল।
পাহাড়ের সরু ধার বেয়ে চলতে গিয়ে, খাদে গড়িয়ে পড়ার ঘটনা, প্রায় অবধারিত। আলো-হাওয়া, আকাশ সূর্যস্তি রক্তে মাংস-মস্তিষ্কে ভাঙনের টানে তোলপাড় ঘটাবেই। তারপরও রয়েছে কত কানাগলি, রূপকথা, রাজারপুর, হারিয়ে যাওয়া সকাল, অন্তহীন দুপুর-রাত্রি; এমনি মায়াবী ধ্বংসের গহ্বর খুঁড়ে যাত্রাপথ তৈরি এতই কী সহজ? সে জীবনেই হোক আর কাব্যেই হোক। সাইফুল্লাহ সেই যাত্রার খাদ কেটেছে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বুনোট গদ্যধর্মী কাব্যরচনায় যা তার নিজের চলার ও চলার সংগ্রামের মতো নিজস্ব।
‘চুমু নাও ক্ষমাশীল মৃত্তিকা মহাদেশ-/ সামনে ক্রন্দনশীলা পথ’’। [ দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে, ১/১৯৮১ ]
ভালোবাসায় যেমন সামান্যতম ফাঁকির আশ্রয় নিয়ে পার পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি ঘটে সৃষ্টি কর্মের ক্ষেত্রে। সাইফুল্লাহ কখনো ফাঁকির দ্বারস্থ হয়নি যেমন কাব্যের, তেমনি জীবনে। আর কে না জানে, এই ধরনের সততা কতটা হননকারী। আর্শিতে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি প্রতিনিয়ত কী পরিমাণ রক্তস্রাব ঘটায়। সাইফুল্লাহ, স্বাভাবিক আত্মশক্তির কারণেই, সততাকে বরণ করে নিয়েছিল অজানা পথের সঙ্গী, বন্ধু ও পথদর্শক হিসেবে; এবং সে জন্যেই তাকে বিনিময়ে দিয়ে যেতে হয়েছেও প্রচুর, শেষ পর্যন্ত নিজেকেই। সে একজন সচেতন কৃষক যে ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়তে-লড়তে ভাঙনের জলেই ভেসে যায়, আর তার ফলনকে ঘরে তোলে বা ফলনের স্বাদ উপভোগ করে আমাদের মতোই অন্যেরা।
‘স্বপ্নশরীর, ছোঁবো না কণামাত্র নপুংশক মাটি/ ছোঁবো না পরাধীন সুষমা, নগ্ন হয়ে দেখাই রূপান্তরিত জন্মরূপ-/ পরান্ন প্রবাসে এই অধিকার’। [ দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে, ৮/১৯৮১ ]
মাথার ওপরে চাঁদ বা মেঘ, পায়ের নিচে অনুর্বর তাঁবু, কর্ষিত ক্ষেত, শরীরে খরার সংবাদবাহী হাওয়া; এইসব স্বদেশের, স্বজাতির, স্বজনের নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা কখনো আনে ক্লান্তি, পরাজয়ের বোধ বা গ্লানি; তবু চলার দুঃসাহস কিছুতে থামে না। কখনো নিজের চুল ছিঁড়ে নিজে, মাথা ঠোকে পাথরে, নিজের বিরুদ্ধে নিজে চিৎকার করে ওঠে ক্রোধে, আত্ম-উন্মোচনের অসহ্য ক্রন্দনে। সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতা ধারণ করেছে, এমনি বিস্ময়কর, কখনো কখনো অনিবার্যভাবে পরস্পরবিরোধী জগৎ, শারীরিক পঙ্গুতায়, অসামর্থ্যও লালিত্যে। সার্থকতা বড় কথা নয়; কতটা সততা ধারণ করতে পেরেছে তার কবিতা, সেটাই বিচার্য, ভেবে দেখার। তার অকালমৃত্যুর জন্য দুঃখ নেই, কর্মের অপূর্ণতার কারণে।
‘শ্রেষ্ঠতম উন্মোচন হবে আজ’। [দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে, ৭/১৯৮১ ]
এই উন্মোচন, বেঁচে থাকার জন্য যে সংগ্রামের প্রয়োজন, তার। আমাদের জন্যে রয়ে গেল, সাইফুল্লাহর কবিতা, মৃত্যুর বিরুদ্ধে তার রুখে দাঁড়াবার অদম্য অনুপ্রেরণা ও প্রয়াস। অনিবার্য কিন্তু স্বাভাবিক ও সাধারণ বলা যায় প্রায় গতানুগতিক ক্ষয় ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম যত দীর্ঘজীবী হয়, ততই প্রসারিত হয় আমাদের উত্তরাধিকার। সাইফুল্লাহর মধ্যে এমন একটি সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও জাগরণের প্রত্যাশা ও প্রত্যাশার উদ্গম পেয়েও হারালাম। সেখানেই আমাদের দুঃখ ও দুঃখবিনাশী অনুরণন।
‘ফুটপাতে গলিত সংসার অন্ততঃ স্থিতিহোক সামান্য চলায়/সঞ্চিত হোক কমলাগন্ধ, কচি লেবু পাতায় প্রভাতী সূর্যের সৌরভ।’ [দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে, ৩০/১৯৭৯ ]
দীর্ঘায়ু হোক তারঁ বেঁচে থাকার আত্মধ্বংসী প্রয়াস, তার কবিতা। তার কর্মই বহন করুক তার পিতৃপরিচয়, শোধ করুক তার জন্মঋণ।
(জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র সংসদের উদ্যোগে লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৮২ সালের জুন মাসে, জাকসুর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। এখানে লেখাটি নেওয়া হয়েছে সচলায়তন কর্তৃক প্রকাশিত পিডিএফ বই থেকে। কবি সুনীল সাইফুল্লাহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়, ১৯৮১ সালে, মীর মশাররফ হোসেন হলে নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেন সুনীল। সাতক্ষীরার দেবহাটায় জন্মগ্রহণ করেন সুনীল। তাঁর আকস্মিক প্রস্থানের পর সতীর্থরা সুনীলের লেখা কবিতা সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ করেন। কবি মোহাম্মদ রফিক সুনীল সাইফুল্লাহকে নিয়ে এই ছোট্ট আলোচনায় চারটি কবিতার কয়েকটি লাইন ব্যবহার করেছেন। সুনীল সাইফুল্লাহ’র লেখা সেই চারটি কবিতাসহ কয়েকটি কবিতা নিচে দেওয়া হলো।)
০১
চলে যাবার সীমারেখায় আজ বৃত্তায়িত সবকিছু,
আর একটু ভালো করে দেখে নিই আকাশ, সূর্যস্তি-সুর
নিথর পানা পুকুর, বৃত্তায়িত আনন্দস্বরূপা উন্মোচিত রাজার পুর
খেলাঘরে কার কণ্ঠহার পড়ে আছে নিরবধিকাল
সেই পরিচিত খুঁজে খুঁজে শেষাবধি আজ দাঁড়াত...
চলে যাবার সীমারেখায় আজ বৃত্তায়িত সবকিছু,
আর একটু ভালো করে দেখে নিই আকাশ, সূর্যস্তি-সুর
নিথর পানা পুকুর, বৃত্তায়িত আনন্দস্বরূপা উন্মোচিত রাজার পুর
খেলাঘরে কার কণ্ঠহার পড়ে আছে নিরবধিকাল
সেই পরিচিত খুঁজে খুঁজে শেষাবধি আজ দাঁড়াতে হবে পুনর্বার
হিম কুটিরে টেমির অন্ধকারে- কুনির্শ করি ছেঁড়া মাথায় রেখে
মর্মরহাত
এবার তো প্রস্তুত রথ, ওঠো জয়দ্রথ;
পেছনে রেখে যাই অযোগ্য শরীর, আর কিছু নয়
শিথিলতায় স্তব্ধ শ্বাসরোধী গ্রাম, একজন্ম কুকুরী-কোলাহলে
নিমগ্ন থেকে তুলে আনি এই অমৃত-পাত্র, রক্ত ঢালো স্বেচ্ছাশরে
মুক্তি পাবে, বৃত্তায়িত জন্মবন্ধন পাপিষ্ঠ আকুতি
পিতৃপরিচয় মুছবো বলে শেষাবধি মুছি নিজেকে-
নিস্তব্ধ আবর্তনে নীলাক্ত শিশু, পরাধীন শপথ
এবার তো প্রস্তুত রথ ওঠো জয়দ্রথ;
এতোদিন সকল জাগরণে জ্বলন্ত খুঁড়ি মাটি ও পাথর
নীচে তার বয়ে যায় আজো ফনাবিদ্ধ আগ্নেয় সাগর
একটু শুই পারলে উঠবো না পারলে এই শেষ
চুমু নাও ক্ষমাশীল মৃত্তিকা-মহাদেশ-
সামনে ক্রন্দনশীলা পথ
এবার তো প্রস্তুত রথ ওঠো জয়দ্রথ।
১৯৮১
০৭
শ্রেষ্ঠতম উন্মোচন হবে আজ- এসব নদীতীরেই মানায়
সারি সারি রিক্ততা ও হিম সমারোহ, ভেতরে স্রোতধারা-
জন্মের অক্ষরে অকম্পিত চিত্রলিপি ছোঁয়াচে চুম্বনে অবিরত
খোঁড়ে আমুন্ডু ব্যর্থ অহমিকা, এক জীবনে লক্ষ জীবাণু সংক্রমণ
তাদের যৌক্তিক খাদ্যসংস্থান রাত্রিদিন অভ্যাসবশে
পালন করি জন্মনফর-আপন শরীরে এইসব আত্মভূক্ত কৃষিকাজ
প্রথম শ্যামশ্রী নদীতীর পেরিয়ে আসার পর
শুনেছি সামনে দেখা যাবে অনন্ত তরমুজ ক্ষেত, ছোট্ট চালাঘর
সর্বশেষ আত্মদহন শেষে শেষ অগ্নিবিন্দু পান করে যাই
কৃষ্ণের কথায় প্রবোধহীন অর্জুনআমি প্রতিটি বাহ্যিক হত্যায়
হত্যা করি নিজেকে,
আমিহীন কিভাবে চলবে সংসার তার দায় নাও উন্মোচিত অন্ধকার
আমি যাই এই সত্য ললাটে শেষ রাত্রির চাঁদ
হিম-আক্রোশে ছড়ায় হননেচ্ছা ঘরে ঘরে-
বেঁচে থাকা মর্ত্যমুখী আততায়ী আকাশে
সপ্তর্ষি সীমারেখায় অবোধ্য কথাবার্তা অশ্বখুরে অতিষ্ঠ
স্ফীত উদরে নামে অনিবার্য জন্মধারায়-
বর্ণালী উৎসবে প্রাত্যহিক প্রণতি বিশ্বাসঘাতকের
ভেঙে পড়লো আজ অপরাহ্নে ক্ষয়রোগী আলোর শবাধারে
শ্রেষ্ঠতম উন্মোচন হবে আজ- শেষাবধি এটুকু পুরস্কার
ফেলে যাবো তুচ্ছ বসবাসে ক্ষয়শীল মাটি ও আকাশ;
মাংসজ গভীরে আন্দোলিত ফুলমালা, কোনো অঙ্গেই আমি
পৌঁছুতে পারি নি অতদূর, ওই পাপড়ি আবর্তনে
প্রাত্যহিক সূর্যোদয় ও আলোকসংক্রমণ বিলয় অবধি-
অনাথ সংসারে মাটি স্থির দাঁড়াও।
১৯৮১
০৮
আত্মহত্যার আগে শেষকথা কী লিখে যাবো এই প্রশ্ন
করে শেষ রাত শেষ আকাশ মাধুরী; শেষকথা কী বলে যাবো
সেই ককর্শ বিদ্যুৎ সর্বশরীর ঢেকে আছে, মেঘাচ্ছন্ন দিন-
কাঁদে বাসভূমি, ছিন্ন চালাঘর
সাম্রাজ্যশাসন কোনদিনই হবে না আমার
মাঝেমধ্যে যেটুকু দায়িত্ব পাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাই
অলস নিয়মকানুন, ব্যাভিচার, দিগন্ত ছোপানো ভঙ্গুর মায়াজাল;
আশৈশব অনিবার্য অনাচারে আনত শরীর ভাসে
শীতকালীন শীতলক্ষ্যা স্রোতে, সময়ে পঁচে, মেশে নির্বিকার
পবিত্র জলে- জন্ম কেন কথা বলে চোখে এই বিরোধ
তীরে তীরে কম্পমান হিম সংহারে, মর্ত্যধারায়;
আত্মহত্যার আগে শেষ চিত্রলিপি কী দেখে যাবো
এই প্রশ্ন করে জন্মভূমি, নগ্ন হয়ে দেখাই রূপান্তরিত জন্মরূপ
বিকলাঙ্গ-প্রবাহে শিথিল যৌনাঙ্গ-বিষ, শৈশবে অমল প্রাসাদে
দায়িত্বহীন রাজত্বসুখ, স্বপ্নসন্ধ্যায় বয়ে যায় সুর্যাস্ত সুষমা
বুকে হেঁটে শেষাবধি এই নদী তীরে, অনাদি মায়াকানন
এখানে একটু বসি যাবার আগে শেষ দেখি রঙে রঙে
কতোটুকু কম্পমান
স্বপ্নশরীর, ছোঁবো না কণামাত্র নপূংশক মাটি
ছোঁবো না পরাধীন সুষমা, নগ্ন হয়ে দেখাই রূপান্তরিত জন্মরূপ-
পরান্ন-প্রবাসে এই অধিকার।
১৯৮১
৩০
সঞ্চিত হোক মাতৃত্ব মেশা কামুকতা
সঞ্চিত হোক সঞ্চিত হোক মাটি, যথাসাধ্য মৌসুমী হাওয়া
তরল রাত্রির বিষে জ্বলন্ত পাথারে
মুমুর্ষু মাছেদের নতুন আবাসভূমি
ফুটপাতে গলিত সংসার অন্ততঃ স্থিতি হোক সামান্য চালায়
সঞ্চিত হোক কমলাগন্ধ, কচি লেবু পাতায় প্রভাতী সূর্যের সৌরভ
তবেই তুমি হবে সঞ্চিতা, যথাযোগ্য নারী।
১৯৭৯
১৫
কাল রাতে একটা তারায় আগুন লেগেছিলো।
দুগেলাশ তারার ফুলকি পান করে
সারারাত নিদ্রাহীন
চিৎকারে চিৎকারে চৌচির ফাটিয়েছি
কার্তিকের গর্ভিনী ফসলের মাঠে
হে রমণী বৃক্ষ নদী
দ্যাখো দ্যাখো আমার আর কোনো পিপাসা নেই।
মাংসের কারাগরে পিঠমোড়া বাঁধা কোথায় লুকিয়ে থাকে
পদ্মপ্রেম- তার সন্ধানে শিশ্নাঘাতে যারা অনবরত
রক্তমাংস খোঁড়ে
তাদের কান ঘরে টেনে এনে দেখিয়েছি আমি
এক ঘুমের পর মানুষের মুখের দুর্গন্ধে
দাম্পত্যশয্যায় কুষ্ঠজীবাণু আর চৌচির মাটির মাতাল শৃঙ্গারে
কাল রাতে একটা রজনীগন্ধায় আগুন লেগেছিলো
আমি দুগেলাশ জ্বলন্ত ফুলের শরবত পান করে
ভোর হবার আগেই পৃথিবীর সমস্ত পানপাত্র ভেঙে
চলে এসেছি সামুদ্রিক কঙ্কালদ্বীপে যেখানে
একটি মাত্র হাড়ের আঘাতে
তামাম সৃষ্টির বোঁটা ছিঁড়ে
ফোটায় ফোটায় রক্ত ঝরে-
আমার আর কোনো পিপাসা নেই।
২৪
আমার কপালে বুলেটের মতো ঢুকে গিয়েছে তোমার মুখ।
ক্ষতচিহ্নের রক্তপাত আঙুলে মুছে নিয়ে
আমি নগরের দেয়ালে দেয়ালে বৃক্ষের বাকলে
লিখছি তোমার নাম,
তোমার অধর-সুবাসের কথা বলে এসেছি
নরোম রাত্রির মাথায় নক্ষত্রের আগুন জ্বলা অপরূপ মোমবাতির
কাছে
মুমুর্ষ আমি, তাই থাকতে চাই
কোনো চিকিৎসার নেই প্রয়োজন আপাতত
হিরন্ময় অসুস্থ আমি, তাই থাকতে চাই-
আজ সারারাত পরিপার্শ্ব স্পর্শ করে পাই নি
জীবনধারনোপযোগী উষ্ণতা-
বাহুবন্দী স্ত্রীর ধড়হীন মুন্ডু, তিনমাসের শিশুর নাড়িভুড়ি
ক্রমশঃ নিকটে অগ্রসরমান
আসন্ন পারমাণবিক যুদ্ধে ঝলসানো পৃথিবীর চিত্রলিপি সাঁটা
চার দেয়াল- এসবের ভেতর জড়োসড়ো
আজ সারারাত নিঘুর্ম উৎকন্ঠায়, বায়বীয় বিষপ্রবাহে
প্রাচীন রাজার সজ্জিত অশ্বের হ্রেষাধ্বনির ভেতর
আমার কপালে বুলেটের মতো ঢুকে গিয়েছে তোমার মুখ
আমার কোনো কর্তব্য নেই
শর্ষে ক্ষেতের ভেতর শুয়ে থাকা আমি সুবাসিত সবুজ মানুষ
শ্যামাঙ্গী মসৃণতায় মিথুনলগ্ন পাখি ও বাতাস-
আমার কপালের ক্ষতচিহ্ন ঢেকে আছে সমরাস্ত্র অন্ধকরা
তোমার চোখ
এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ।
১৯৭৯-১৯৮০
২৫
মধ্যরাতে দরোজায় কড়া নাড়ে
কবরের মাটি সরিয়ে উদ্ধত উঠে আসা আমার কঙ্কাল।
তড়িঘড়ি শয্যায় উঠে বসে আমি দেখি
বুকের মাংস যোনির আকারে ফেটে গিয়ে
তৈমুরের তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে
আর তার ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত
আমার চোখে দু’ হাজার রমণীমুখ
ঠাণ্ডা কঙ্কালফুল হয়ে ফুটে উঠলো।
পুতুলের মুখের মসৃণতায় হাত রেখে
একদিন তাকে মনে হয়েছিলো মানুষের অধিক মানুষ
আজ সে মিথ্যে মাটির প্রলেপ মুখে নিয়ে
ছুঁয়ে যায় ভূমধ্যসাগরে ভাসা নাবিকের লাশ।
আমি বুকে হাত রেখে অনুভব করি
অঙ্কুরিত সবুজের লাবণ্যে লজ্জাবতী ধরিত্রীর
প্রথম মাতৃত্ব অতিক্রম করে
চাঁদের সঙ্গমে আন্দোলিত দু’ফাঁক কোমলতায় জন্ম নিচ্ছে
অন্তরীক্ষে প্রবাহিত অগ্নিগিরি, নিহত ভ্রণের চোখ
আমার বুকে একি যোনি নাকি অর্জুনের ধনুক ?
যমজ ছিলায় উৎক্ষিপ্ত তীরের ঘর্ষণে
মহাকাশে অগ্নিরমণীর কপাল ফাটিয়ে বেরিয়ে আসা
সবুজ পায়রার হৃৎপিন্ড চিবিয়ে খেয়ে
ঠিক তিন বছর পর আমি আত্মহত্যা করে যাবো।
১৯৭৯
৩৯
ক.
সকাল হলে
একটি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো
আজন্ম পরিচিত মানুষ ছেড়ে চলে যাবো
মৃত্যুদন্ডিত
মৃত্যুদন্ডিতের মতো,
অথচ নির্দিষ্ট কোন দুঃখ নেই
উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি নেই
শুধু মনে পড়ে
চিলেকোঠায় একটা পায়রা রোজ দুপুরে
উড়ে এসে বসতো হাতে মাথায়
চুলে গুজে দিতো ঠোঁট
বুক-পকেটে আমার তার একটি পালক
১৯৭৮