পর্ব ৪
শিল্পকথা
প্রা ক্ ক থ ন ( শেষাংশ)
শিল্প ও শিল্পী প্রসঙ্গে
আমার মনে হয় আমরা যদি আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার সাহায্য নিই তাহলেই কেবল ব্যাপারটা বোঝার আশা করতে পারি। আমরা অবশ্য শিল্পী নই; হয়তো কখনোই কোনো ছবি আঁকার চেষ্টা করিনি আমরা, কখনো যে করবো সে-রকম ইচ্ছেও নেই হয়তো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে শিল্পীর জীবন যেসব সমস্যায় পরিকীর্ণ সে-ধরনের সমস্যার মুখোমুখি আমরা কখনোই হই না। সত্যি বলতে কী, এধরনের সমস্যার — তা সে যতোই সাধারণ হোক না কেন — অন্তত খানিকটা আভাসও পায়নি এমন লোক যে নেই বললেই চলে সেটাই বরং প্রমাণ করতে উৎসুক আমি। যিনি একগুচ্ছ ফুল সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, রঙে অদল-বদল ঘটাতে চেয়েছেন, এখানে খানিকটা যোগ করে ওখান থেকে খানিকটা সরিয়ে নেবার প্রয়াস পেয়েছেন তিনিই আকার এবং রঙের মধ্যে ভারসাম্য আনার এই অদ্ভুত সংবেদনটি উপলব্ধি করেছেন, যদিও ঠিক কোন ধরনের ঐকতান তিনি অর্জন করার চেষ্টা করছেন সেটা বলতে পারেননি। আমাদের শুধু মনে হয় এখানে লালের একটা ছোপই হয়তো বিরাট একটা পরিবর্তন এনে দেবে। কিংবা, এমনিতে নীল রঙটা ঠিকই আছে, কিন্তু ওটা অন্য রঙগুলোর সঙ্গে ঠিক ‘যাচ্ছে’ না, এবং হঠাৎ সবুজ পাতাঅলা ছোট্ট একটা ডালই মনে হয় যেন ব্যাপারটাকে ‘ঠিক’ বলে মনে হতে সাহায্য করে। ‘আর হাত দিয়ো না ওটায়,’ বলে উঠি আমরা। ‘একেবারে নিখুঁত আছে ওটা এখন।’ স্বীকার করছি, প্রত্যেকেই ফুল সাজানোর ব্যাপারে এতোটা সতর্ক নয়, কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেরই এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেটাকে তিনি ‘ঠিক ঠিক মতো’ দেখতে চান; হতে পারে সেটা স্রেফ একটা বিশেষ পোশাকের সঙ্গে মানানসই একটা কোমরবন্ধনী খুঁজে পাওয়া, বা এই যেমন কারো প্লেটে কাস্টার্ড বা পুডিং-এর ভাগটা ঠিকমতো পড়ল কিনা এরকম কোনো মামুলি বিষয় নিয়ে উৎকণ্ঠা। এ-ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা সে যতোই তুচ্ছাতিতুচ্ছ হোক না কেন, আমাদের মনে হয় স্রেফ একটা অতি বেশি বা খুব কম শেড পুরো ভারসাম্যটাই নষ্ট করে দেয়, এবং মাত্র একটাই সম্পর্ক রয়েছে যেটা আসলে সঠিক, অন্য কোনোটি নয়।
যেসব মানুষ ফুল, পোশাক বা খাবার নিয়ে এরকম উৎকণ্ঠায় ভোগেন তাদেরকে আমরা হয়তো খুঁতখুঁতে বলতে পারি, কারণ আমাদের মনে হতে পারে যে এ-ধরনের জিনিস এতোটা মনোযোগ দাবি করে না। কিন্তু বাস্তবে যা একটা বদঅভ্যাস বলে গণ্য, আর কাজেই সেটাকে চেপে বা লুকিয়ে রাখাটই দস্তুর, সেটাই শিল্পরাজ্যে স্বমহিমায় প্রকাশিত হয়। বিষয়টা যখন ফর্মের সমন্বয়সাধন বা বর্ণবিন্যাস সংক্রান্ত, একজন শিল্পী তখন অবশ্যই সদা খুঁতখুঁতে হবেন, বা হবেন চূড়ান্ত রকমের রুচিবাগীশ। শেড এবং বুনোটের মধ্যে তিনি এমন কিছু পার্থক্য লক্ষ করতে পারেন যা হয়তো আমরা খেয়ালই করব না। তাছাড়া, আমাদের সাদাসিধে জীবনে যেসব কাজের অভিজ্ঞতা হয় তার যে-কোনো একটির চাইতে তাঁর কাজ যারপরনাই রকমের বেশি জটিল। তাঁকে কেবল দু’তিনটে রঙ, আকার বা রুচির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হয় না, লোফালুফি খেলতে হয় যে-কোনো সংখ্যক জিনিস নিয়ে। তাঁর ক্যানভাসের ওপর হয়তো শত শত শেড আর আকার থাকে যেগুলোর মধ্যে ভারসাম্য না এনে তাঁর উপায় থাকে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলেকে ‘ঠিক’ দেখায়।
সবুজ একটা ছোপ হয়তো হঠাৎ করে খুব বেশি হলুদ দেখাতে পারে, কারণ সেটাকে গাঢ় নীলের খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল — তো, তখন তাঁর মনে হতে পারে সব বুঝি গেল নষ্ট হয়ে; মনে হতে পারে, ছবির ওই জায়গাটা একটু বেসুরো বাজছে। এবং তখন তিনি হয়তো একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে পারেন আবার। যন্ত্রণায় ভুগতে পারেন এই সমস্যাটি নিয়ে। নির্ঘুম রাতে ভেবে ভেবে আকুল হতে পারে তিনি এ-নিয়ে; তাঁর ছবির সামনে সারা দিনমান দঁড়িয়ে থেকে তিনি এখানে ওখানে একটা রঙের ছোঁয়া দিয়ে আবার সেটা মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারেন, যদিও আপনি বা আমি হয়তো আগের বা পরের অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্যই লক্ষ করিনি। কিন্তু তিনি একবার সফল হওয়ার পর আমরা অনুভব করি তিনি এমন কিছু অর্জন করেছেন যার পরে আর কোনো কিছুই করার নেই, এমন কিছু যা সঠিক — আমাদের খুঁতযুক্ত পৃথিবীতে নিখুঁতত্বের একটি উদাহরণ।
১৭. রাফায়েল, তৃণভূমিতে কুমারী মেরী, ১৫০৫
রাফায়েল (Raphael)-এর বিখ্যাত মাদোনাগুলোর একটি তৃণভূমিতে কুমারী মেরী-র কথাই ধরুন (চিত্র ১৭)। সন্দেহ নেই, ছবিটি সুন্দর এবং দৃষ্টি আকর্ষক; ফিগারগুলো খুব চমৎকারভাবে আঁকা, এবং শিশু দুটোর দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকা মেরীমাতার অভিব্যক্তিও রীতিমত অবিস্মরণীয়। কিন্তু ছবিটির জন্যে রাফায়েল যেসব স্কেচ করেছিলেন (চিত্র ১৮) সেগুলোর দিকে তাকালে আমরা উপলব্ধি করতে থাকি যে তিনি যেসব বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছিলেন তা এসব নয়। এগুলো যে এরকম হবে সেটা তিনি ধরেই নিয়েছিলেন। বারংবার তিনি যা অর্জন করতে চাইছিলেন তা হচ্ছে ফিগারগুলোর মধ্যে সঠিক ভারসাম্য, সঠিক সম্পর্ক, যা সবচেয়ে ঐকতানিক সমগ্রর সৃষ্টি করবে। বাম কোনায় অবস্থিত দ্রুত-হাতে-আঁকা স্কেচটাতে তিনি ভেবেছিলেন শিশু যীশুকে তিনি মুখ ফিরিয়ে ওপর দিকে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে হেঁটে যেতে দেবেন। সেই সঙ্গে তিনি শিশুটির গতির প্রতিক্রিয়ায় মায়ের মাথার বিভিন্ন অবস্থানের ছবি আঁকারও চেষ্টা করেছিলেন।
এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিশুটিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে তাকে তার মায়ের দিকে তাকাতে দেবেন। আবার অন্যভাবেও চেষ্টা করেছেন তিনি, এবারে ছোট্ট জনের আবির্ভাব ঘটিয়ে, তবে যীশুকে তিনি তাঁর দিকে তাকাতে দেননি, বরং তার মুখটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন ছবির বাইরের দিকে। এরপর তিনি, স্পষ্টতই অধৈর্য হয়ে, শিশু যীশুর মাথাটিকে আঁকবার চেষ্টা করেছেন সেটাকে ভিন্ন ভিন্ন নানান অবস্থানে রেখে। তাঁর স্কেচ বইয়ে এ-রকম কয়েকটি পাতা ছিল। কিন্তু আমরা যদি এবার শেষ ছবিটির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে শেষ পর্যন্ত ঠিকভাবেই করতে পেরেছেন তিনি কাজটা। মনে হচ্ছে, ছবির প্রতিটি জিনিসই সেটার উপযুক্ত স্থানে রয়েছে, এবং রাফায়েল তাঁর কঠোর পরিশ্রমের সাহায্যে যে ভঙ্গি এবং সুসঙ্গতি অর্জন করেছেন সেটাকে এতোই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে যে সেটা আমাদের নজরে পড়ে না বললেই চলে। তারপরেও, এই সুসঙ্গতির কারণেই মাদোনার সৌন্দর্য আরো সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠে, এবং শিশু দুটির মিষ্টত্ব হয়ে ওঠে আরো মিষ্টি।
১৮. রাফায়েল, ‘তৃণভূমিতে কুমারী মেরী’ ছবির চারটি স্টাডিসহ স্কেচবুকের একটি পাতা
একজন শিল্পীকে এভাবে সঠিক ভারসাম্য আনার সংগ্রামে রত থাকতে দেখাটা খুবই আকর্ষণীয় একটি বিষয় সন্দেহ নেই, কিন্তু আমরা যদি তাঁকে জিগ্যেস করতাম কেন তিনি এটা করলেন বা ওটা বদলালেন, তাহলে হয়তো সেকথার জবাব তিনি দিতে পারতেন না। কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তিনি অনুসরণ করেন না। তিনি কেবল তাঁর মতো করে অনুভব করেন। একথা সত্যি যে, বিশেষ বিশেষ কোনো সময়ে কোনো কোনো শিল্পী বা সমালোচক তাঁদের শিল্পের রীতিনীতি তৈরি করতে চেয়েছেন; কিন্তু সবসময়ই দেখা গেছে যে এসব রীতিনীতি প্রয়োগ করে অপ্রতিভাবান শিল্পীরা কোনো কিছুই অর্জন করতে পারেননি, অন্যদিকে মহৎ শিল্পীরা সেসব নিয়ম লঙ্ঘন করেও এমন এক নতুন ধরনের সুসঙ্গতি অর্জন করেছেন যার কথা আগে কেউ কখনো চিন্তা করেনি। মহান ইংরেজ চিত্রকর স্যার জোশুয়া রেনল্ডস (Sir Joshua Reynolds) যখন রয়্যাল একাডেমিতে তাঁর ছাত্রদের বললেন যে ছবির পুরোভূমিতে (ফোরগ্রাউন্ডে) নীল রঙ ব্যবহার করা উচিত নয়, বরং সেটাকে দূর পশ্চাদ্পটের জন্যে, দিগন্তে অপসৃয়মান পাহাড়-পর্বতের জন্যে তুলে রাখাই শ্রেয়, তখন — লোকে বলে — তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী গেইন্সবারো (Thomas Gainsborough) নাকি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে এসব সারস্বত (একাডেমিক) রীতিনীতি সাধারণত অর্থহীন। অতঃপর তিনি আঁকলেন তাঁর বিখ্যাত ব্লু বয়, ছবির মাঝের পুরোভূমিতে যার নীল পোশাক উষ্ণ বাদামি পশ্চাদ্পটের বিপরীতে সগৌরবে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করছে।
আসল কথা হচ্ছে, এ-ধরনের কোনো নিয়ম জারি করা অসম্ভব, তার কারণ আগে থেকে কারো পক্ষে একথা জানার কথা নয় একজন শিল্পী ঠিক কোন ধরনের ফল (এফেক্ট) অর্জন করতে চাইতে পারেন। তিনি এমনকি একটা বেখাপ্পা সুরও চাইতে পারেন যদি ঘটনাক্রমে তাঁর মনে হয় যে সেটাই ঠিক হবে। একটি ছবি বা ভাস্কর্য ঠিক কখন সঠিক সে-ব্যাপারে যেহেতু কোনো নিয়ম-রীতি নেই তাই সেটা যে কখন একটি মহান শিল্প সে-কথা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একটি কাজ ঠিক আরেকটির মতোই ‘উচ্চমান সম্পন্ন’, বা, রুচি সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে উচ্চবাচ্য করা যাবে না। এসব আলোচনা আর যাই করুক না কেন, আমাদেরকে ছবির দিকে তাকাতে বাধ্য করে, আর যতোই আমরা সেগুলোর দিকে তাকাই ততোই আমরা এমন কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি যা আগে আমাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি প্রজন্মের শিল্পীরা যে-ধরনের সুসঙ্গতি অর্জন করার চেষ্টা করেছেন সেটার প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি হতে থাকে আমাদের মধ্যে। এসব সুসঙ্গতির প্রতি আমাদের অনুভূতি যতোই প্রগাঢ় হবে ততোই ভালো করে সেসব কাজ উপভোগ করতে পারব আমরা, আর শত হলেও, সেটাই মূল বিষয়। রুচি নিয়ে তর্ক করা যায় না, এই পুরনো প্রবাদটি হয়তো অনেকাংশেই সত্য, কিন্তু তাতে এই সত্যটি আড়াল করা যায় না যে রুচির উন্নতি ঘটানো সম্ভব। এটাও সাদামাটা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার একটি বিষয় যা সাধারণ কোনো ক্ষেত্রে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। চা পানে অভ্যস্ত নয় এমন লোকজনের কাছে একটি ব্লেন্ড-এর স্বাদ ঠিক অন্যটির মতোই মনে হতে পারে। কিন্তু এ-ধরনের যেসব যত বিশুদ্ধতা রয়েছে তার সবগুলো খুঁজে বের করার মতো অবসর সদিচ্ছা বা সুযোগ যদি তাদের থাকে তাহলে তারা হয়তো সেইসব খাঁটি সমঝদার-এ উন্নীত হতে পারে যাঁরা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারেন ঠিক কোন ধরন এবং মিশ্রণটি তাঁদের পছন্দ; আর তাঁদের এই বাড়তি জ্ঞানটুকু তাঁদের পছন্দের সেরা ব্লেন্ডগুলো উপভোগের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি মাত্রা যোগ করতে বাধ্য।
একথা স্বীকার্য যে, শিল্পরুচি, খাদ্য বা পানীয়-রুচির চাইতে যারপরনাই জটিল একটি বিষয়। এ কেবল বিভিন্ন সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফ্লেভার আবিষ্কারের বিষয় নয়, তার চাইতে ঢের বেশি সিরিয়াস ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। শত হলেও, মহান শিল্পীরা এসব কাজে তাঁদের সমস্তটা ঢেলে দিয়েছেন, সেগুলোর জন্যে তাঁরা যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, শরীরের রক্ত ঝরিয়েছেন। তাঁরা কী করতে চেয়েছেন সেটুকু যেন আমরা বোঝার চেষ্টা করি, অন্তত এটুকু আমাদের কাছে দাবি করার অধিকার তাঁদের রয়েছে।
শিল্প সম্পর্কে শেখার কোনো শেষ নেই। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করার সুযোগ আছে এখানে। মহৎ শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়ালে প্রতিবারই তা ভিন্ন রকম বলে মনে হয়। সত্যিকারের, রক্তমাংসের মানুষের মতোই অশেষ আর অনির্দেশ্য বলে মনে হয় সেগুলোকে। অদ্ভুত সব রীতিনীতি আর স্বকীয় অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে এ নিজেই এক উত্তেজনাকর জগৎ। কারোরই ভাবা উচিৎ নয় যে এ-জগতের সব কিছুই তার জানা হয়ে গেছে, কারণ কেউই তা জানে না। সম্ভবত কোনো কিছুই এই ব্যাপারটির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয় : এসব কাজ উপভোগ করতে হলে আমাদের দরকার একটি সজীব মন, এমন একটি মন যা প্রতিটি লক্ষণ বা ইঙ্গিত ধরতে পারে, এমন এক মন মোটের ওপর যা দীর্ঘ, উচ্চনাদী শব্দ আর চটজলদি তৈরি করা শব্দগুচ্ছের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। যে-অল্পবিদ্যা নাক-উঁচুভাবের জন্ম দেয় তার চাইতে চেয়ে শিল্প সম্পর্কে কিছুই না জানা হাজার গুণে ভাল। বিপদটি খুবই বাস্তব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এমন কিছু লোক রয়েছেন যাঁরা আমি এই অধ্যায়ে যেসব সাধারণ কথা বলতে চেয়েছি তা ধরতে পেরেছেন, এবং যাঁরা জানেন যে এমন কিছু মহৎ শিল্পকর্ম আছে যেগুলোর মধ্যে সৌন্দর্যের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতীয়মান গুণাবলী আর সঠিক চিত্রকুশলতা নেই, কিন্তু তাঁরা তাঁদের জ্ঞান নিয়ে এতোটাই গর্বিত যে তাঁরা কেবল সেই সব শিল্পকর্ম পছন্দ করার ভান করেন যেগুলো সুন্দরও নয়, সুন্দরভাবে আঁকাও নয়। তাঁরা সবসময় এই ভয়ে ভীত থাকেন যে, যে-কাজটি নিঃসন্দেহেই মনোরম বা অসাধারণ সেগুলো তাঁরা পছন্দ করেন বলে স্বীকার করলে লোকে তাঁদেরকে অশিক্ষিত বলে ভাববে। শেষ অব্দি উন্নাসিকে পরিণত হয়ে তাঁরা শিল্পকে সত্যিকারভাবে উপভোগে ব্যর্থ হন, এবং সেইসব লোকজনে রূপান্তরিত হন যাঁরা সবকিছুকেই দারুণ ইন্টারেস্টিং বলে, যদিও সেগুলো খানিকটা বিরক্তিকর বলেই তাদের ধারণা। এরকম কোনো অসমালোচনাপ্রবণ পদ্ধতিতে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার চেয়ে আমি বরং বিশ্বাসযোগ্য না হওয়াই পছন্দ করব।
পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমি আলোচনা করব শিল্পের ইতিহাস, অর্থাৎ বিভিন্ন ভবন, চিত্র-নির্মাণ এবং মূর্তি-তৈরির ইতিহাস। আমার মনে হয় এই ইতিহাসের খানিকটা জানা আমাদেরকে একথা বুঝতে সাহায্য করবে কেন শিল্পীরা একটি বিশেষ পদ্ধতিতে কাজ করেছেন, কিংবা কেন তাঁরা বিশেষ কিছু ফলাফল অর্জন করতে চেয়েছেন। মোদ্দা কথা, শিল্পকর্মের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে আমাদের নজর তীক্ষ্ণ করার এবং তার ফলে পার্থক্যের নানান রকমফের সম্পর্কে আমাদের সংবেদশীলতা বাড়াবার এটা একটা ভাল উপায়। সম্ভবত, ওগুলোকে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই উপভোগ করার এটাই সবচেয়ে ভাল পন্থা। কিন্তু কোনো পথই বিপদাপদ থেকে মুক্ত নয়। মাঝে মাঝে এমন কিছু মানুষ দেখা যায় যাঁরা ক্যাটালগ হাতে নিয়ে গ্যালারি ধরে হেঁটে যান, কোনো ছবির সামনে এসে দাঁড়ালে প্রতিবারই তাঁরা প্রবল আগ্রহের সঙ্গে সেটার নম্বর খুঁজতে থাকেন। দেখা যায় তাঁরা তাঁদের বইয়ের পাতা উল্টে বেড়াচ্ছেন, তারপর শিরোনাম বা নম্বরটা খুজে পাওয়া মাত্র হাঁটতে শুরু করেছেন। আসলে কিন্তু তাঁরা ঘরে বসে থাকলেও পারতেন, কারণ ছবিটির দিকে তাঁরা ভালো করে তাকাননি পর্যন্ত। তাঁরা ক্যাটালগটি পরীক্ষা করে দেখেছেন মাত্র। এটা একটি মানসিক সরলীকরণ, যার সঙ্গে চিত্র উপভোগের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে খানিকটা জ্ঞান অর্জন করেছেন এমন লোকজনের মাঝেমধ্যে এ-ধরনের ফাঁদে পড়বার বিপজ্জনক সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো শিল্পকর্ম দেখলে সেটার দিকে তাকাবার কষ্ট স্বীকার না করে তাঁরা বরং সেটার একটা উপযুক্ত তকমার জন্যে স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করেন। তাঁরা হয়তো শুনে থাকবেন রেমব্রান্ট Chiaroscuro-র জন্যে বিখ্যাত ছিলেন, যা কিনা আলো ও ছায়ার ইতালীয় পরিভাষা। কাজেই রেমব্রান্ট দেখামাত্র তাঁরা বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকান, বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠেন, ‘চমৎকার Chiaroscuro,’ তারপর হাঁটতে থাকেন পরের ছবিটার দিকে। এ-ধরনের অল্পবিদ্যা বা উন্নাসিকতার বিপদের ব্যাপারে আমি কোনো লুকোছাপা রাখতে চাই না, কারণ আমাদের সবারই এমন প্রবণতার কাছে পরাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এ-ধরনের একটা বই সে-সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। আমার চেষ্টা চোখ খুলে দেবার, জিভের রাশ আলগা করার নয়। শিল্প সম্পর্কে চাতুর্যের সঙ্গে কথা বলা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, কারণ সমালোচকেরা যে-সমস্ত শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করেন সেগুলো এতো বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়েছে যে সেগুলো তাদের যাথার্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সজীব দৃষ্টিতে একটি ছবির দিকে তাকানো বা আবিষ্কারের একটি সফরে নেমে পড়া আরো অনেক জটিল, যদিও সেই সঙ্গে লাভজনক একটি কাজ। এ ধরনের একটি ভ্রমণ শেষে লোকে যে কী নিয়ে বাড়ি ফিরবে তা আগেভাগে বলা কঠিন।
(চলবে)