গল্প
উচ্চতা
হুইসেলটা কানে এলো। এখনো একটু দূরেই বোধহয়। রান্না করতে করতে কান খাড়া রাখল। দেরি হলেই চলে যাবে। আরো একদিনের অপেক্ষা তখন।
শিবালয় ফ্ল্যাটের দোতলার বাসিন্দা বিয়াস। বাড়ির সদস্য সংখ্যা আদতে চার। সে ছাড়া শাশুড়ি মা, মেয়ে, আর স্বামী। সংখ্যাটা অবশ্য প্রায়শই বেড়ে যায়, তবে এ বাড়ির কর্তা শিলভদ্র থাকে না বললেই চলে। তিনি আজ দিল্লি তো কাল লন্ডন. . .
বিয়াস যখন বিয়ে করে এ বাড়িতে এল তখন শ্বশুর মশাই বেঁচে ছিলেন। দোকান, বাজার, গ্যাস বুকিং, ব্যাঙ্ক, প্রভৃতি কাজগুলো তিনিই সামলাতেন। শিলভদ্র বাড়ির ছোট ছেলে। দুই দিদির পর একমাত্র ভাই, সংসারের সব কিছুতেই তার প্রধান অধিকার ।আদরে আদরে আর না বলতেই দিদিরা সব কাজ করে দেওয়ায় নিজের কাজের বাইরে আর কিছুই তার শেখা হলো না।
এ সংসারে এসে সবচেয়ে বিপদে পড়ল বিয়াস। বুড়ো শ্বশুরবাজার করে আনছেন, হাতে তার ভারি ব্যাগ দৃশ্যটা তাকে বড়ই উতলা করে তুলত। তার বাবাও বাজার করতেন, কিন্তু সেটা কালেভদ্রে। সংসারের যাবতীয় কাজ মা সামলেছেন আর তারা তিনবোন একটু বড় হওয়ার পর থেকে একেক করে অনেক দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছিল। বৃদ্ধ বাবা বাজার যাচ্ছেন এটা তার কল্পনার বাইরেই ছিল।
যাহোক, সময় এভাবেই বয়ে যায়, গেল, যাচ্ছে। শ্বশুর চলে গেছেন, ১৫ বছর হলো। তখন থেকেই মেয়ে, শাশুড়ি , দোকান বাজার, মিস্ত্রি , ডাক্তার, হাসপাতাল. . . সবকিছু একা হাতেই সামলাচ্ছে বিয়াস ।
এখনো মেয়ে বাপ কারোর ঘুম থেকে ওঠার সময় হলো না । ১১ টা বাজতে যায়, কী করে যে এত ঘুমোয়! নিজের মনেই গজরাচ্ছিল সে।
হুইসেলটা আবার বেজে উঠল ।এবার মনে হল একদম কাছাকাছি। গ্যাসটা আস্তে করে দিয়ে ময়লার বালতি নিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগল। সে ছাড়া এই ফ্ল্যাটের মাত্র তিনজন মহিলা জঞ্জাল ফেলতে নিচে নামে। বাকি ফ্ল্যাটের এই দায়িত্ব পালন করেন দাদারা। অর্থাৎ স্বামীরা।
প্রতিদিন তাদের সঙ্গে দেখা হয় বিয়াসের। তিনতলার অরুণ দা, সবসময় হাসি মুখে নিচে নামেন। অধিকাংশ সময় তার পরনে লুঙ্গি, উঁচু করে বাঁধা , গায়ে একটা গামছা, দেখা মাত্রই বলেন, কর্তা কই? দিল্লি না অন্য কোথাও? ভালোই আছেন, হাওয়া লাগিয়ে বেরচ্ছে বেশ, আর আমরা. . . বাকি কথা অসম্পূর্ণই থেকে যায় । হুইসেল তখন গেটের সামনে।
তিনতলার পার্থদা আগেই নামিয়ে দিয়ে যান বালতি, কদাচিৎ দেখা হলে অল্প হাসেন।
চারতলার আশিষ দা, বিয়াসের ননদাই, তিনিও বালতি রেখে থলে ঝুলিয়ে বাজার যান।
চারতলার বৌদি , আর অনুরাগ হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসে , ম্যাক্সি আর ওড়না জড়িয়ে।
সারাদিনে এই মুহূর্তটুকুই কেবল এদের সকলের সঙ্গে দেখা হয় বিয়াসের। একটু হাসি, কাজের মেয়ের খবর কিংবা মেয়ের স্কুলে, নাতনী দিদা বলছে কিনা . . . এই সব টুকটাক কথা বলতে বলতে যে যার ঘরে ফিরে যায় ।
বিয়াসের মাঝে মাঝে মনে হয় এইটুকু সময়ই আসলে এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের মিলন ক্ষেত্র।
বিয়াস আগে হুড়মুড় করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতো।তার বিশ্বাস ছিল সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার একটা মজা আছে।দুটো তিনটে সিঁড়ি বাদ দিয়ে লাফিয়ে নামার মধ্য দিয়ে যেন জীবনকে সতেজ করে তোলার বা তুমি যে এখনো বুড়ো হয়ে যাওনি সেটা অনুভূত হয়।
এ যেন স্কুলে পড়া অঙ্কের বইয়ের বাঁদরের লাঠি ধরে ওপরে ওঠা আর নিচে নামার জটিল অঙ্ক। যার উত্তর মেলেনি কোনোদিন।
হুইসেলটা আবার বাজলো। রতন বিয়াসকে দেখেই হাসলো। বিয়াসও হাসল। রতন তার হাত থেকে বালতিটা নিয়ে নিল। এ ফ্ল্যাটের সকলেই নিজের বালতি বা ময়লার প্যাকেট নিজেরাই ফেলে, হয়তো ভাবে রতনের সঙ্গে হাতের ছোঁয়া লেগে গেলে স্নান করতে হবে ।
এটা হয়তো বিয়াসের ভুল ধারণা ।এরা হয়তো নিজের কাজ নিজে করে নিতেই ভালবাসেন।
অন্যাদিকে বিয়াস বালতিটা রতনের হাতে তুলে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কারণ ময়লার ওই গাড়ির গন্ধে তার বমি আসবেই। তার থেকে রতনের হাতে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তার পক্ষে ভালো।
বিয়াস অধিকাংশ দিনই একটা ম্যাক্সি পরেই নেমে আসে, ওড়না বা হাউসকোট জড়াবার কোনো সময়ই তার থাকে না। সে নিচে নেমেই খোলা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রতনের উদ্দেশে ডাক ছাড়ে
-দাদা নিয়ে যাও । আমি আর যেতে পারছি না।
রতন হাসিমুখে ভেতরে এসে নিয়ে যায় বালতি।
রতনকে কোনোদিনই খুব বেশি কথা বলতে শোনা যায় না। সবেতেই তার হাসি, বড়জোড় চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় সে আসছে, বালতি রেখে দিন।
বর্ষাকালে রতন আসে ভিজে জবজব হয়ে, বিয়াসের মন খারাপ হয়ে যায়, আহারে, এত ভিজে গায়ে ঘুরলে শরীর খারাপ করবে।
রতনের কোনো হেলদোল নেই। বিয়াস কোনো কোনো দিন শিলভদ্রের শার্ট আর একটা পাজামা নিয়েই নিচে নামে। বালতির সাথে এটাও সে ধরায় রতনকে। একদিন মেয়ের রেনকোটটা দিল। রতন কোনো কথা না বললেও বিয়াস বোঝে রতনের এগুলো দরকার। কিন্তু ও কাকে বলবে! তাই নীরব চোখ দিয়েই কৃতজ্ঞতা জানায় ।
বিয়াস আর রতনের এই না বলা অথচ অনেক বলা শব্দগুলো ফ্ল্যাটের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না সেটা বিয়াস নিজেও বোঝে। তবু কী যেন এক বোধ কাজ করে এই শ্রেণির মানুষগুলোর প্রতি।
শুধু তো রতন নয়, তার কষ্ট হয় রিকশা চালকদের প্রতিও। বৃষ্টির দিনে কোনো রিকশায় বাড়ি ফিরলে রিকশাওয়ালাকে নিচে দাঁড়াতে বলে এক দৌড়ে নিয়ে আসে লুঙ্গি , পাজামা , শার্ট, ফতুয়া। তার খালি মনে হয় এরা অসুস্থ হলে, কাজে না এলে শুধু যে এদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, সমাজেও বিশাল ভাবে প্রভাব পড়বে, হয়তো পুরো অঞ্চলটাই জঞ্জালে পরিণত হবে, আর বহু মানুষ তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না।
রিকশাওয়ালারাও তাকে খুব ভালবাসে, রাতবিরেতে যখন তারা অন্য যাত্রীদের অনায়াসে ফিরিয়ে দেয়, গাড়ি গ্যারেজ হয়ে গেছে বলে, তখন বিয়াসকে তারা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, পৌঁছে দেয় বাড়িতে, বাড়তি ভাড়া না নিয়েই।
বিয়াসের কাছে এগুলোই বেঁচে থাকার রসদ।
নিচে নেমে বিয়াস বালতি দেওয়ার সময় লক্ষ করল, রতন বারবার হাতটা ঘোরাচ্ছে, গেটের সামনে রাখা বালতিগুলো খুব ধীরে ধীরে তুলে গাড়িতে ফেলছে। বিয়াস জিজ্ঞেস করল -কী হয়েছে হাতে এবং যথারীতি উত্তর পেল না। সে বালতিটা নিচে নামিয়ে রতনকে একটু দাঁড়াতে বলে দৌড়ে উপরে উঠে এলো। ড্রয়ার থেকে বের করে নিল ব্যথা উপশমের মলম, দৌড়ে আবার নিচে নেমে এলো। রতন এখনি এটা হাতে লাগাও, আর রেখে দাও কাছে, দুপুরে আবার লাগাবে। রতন বিয়াসের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু আজ যেন কী একটা হলো। তার চোখ হঠাৎ করে ভরে গেল জলে। গাল বেয়ে নেমে এলো কোনো বারণ না মেনেই। কোনোমতে হাত দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে সে এগিয়ে গেল সামনে।
বিয়াস এবার খুব আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগল। হঠাৎ যেন আজ সে উপলব্ধি করল, নিচে দৌড়ে দৌড়ে নামা খুব সোজা, উপরে ওঠার সময় তাড়াহুড়ো করলে যেকোনো মুহূর্তে পরে যাওয়ার সম্ভাবনা। তখন সে আর প্রাণ ভরে আকাশটা দেখতে পারবে না।