বই আলোচনা
ঐতিহ্যের গাঢ় পদাবলি
উপনিবেশ তার মতাদর্শ ও কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে উপনিবেশিতের মস্তিষ্ক বিনির্মাণ করতে চেয়েছে, করেছেও। এ জন্য তাদের মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে প্রাক-ঔপনিবেশিক চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের নিদর্শনসমূহ। প্রায় মুছে দিয়ে যে শূন্য সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে তারা শতাব্দী ধরে বপন করে চলেছে পাশ্চাত্যের মতাদর্শ, জ্ঞানকাণ্ড ও যুক্তি প্রক্রিয়া। তাই এ প্রজন্মের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও জীবিকার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হয়েছে ওই পশ্চিমই।
কিন্তু মুশকিল হলো, পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা চিন্তা-অভিজ্ঞতা একটা খিচুরি পাকিয়ে ফেলেছে উপনিবেশিতের মনোজগতে। আমরা হয়ে গেছি হাইব্রিড। তৈরি হয়েছে আমাদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিক আত্মপরিচয়ের সংকট। পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আজ কেউ ছুটছেন নয়া উপনিবেশিত জ্ঞানকাণ্ডে, আবার কেউ কেউ নানান পীরের দরবারে।
কী প্রক্রিয়ায় বহু কালব্যাপী এই বিচ্ছেদায়ন ঘটল, তার গবেষণাভিত্তিক দার্শনিক আলাপ হাজির করতে পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক সৈয়দ নিজার আলম তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন’ গ্রন্থে। তিনি দেখাচ্ছেন, আমাদের বিদ্যৎ সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাশ্চাত্যের মূলধারা-শিক্ষা-দর্শনের ভেতরেই উপনিবেশের রেখে যাওয়া জঞ্জাল থেকে মুক্তি খুঁজছেন। যেটা একটি নিবিড় স্ববিরোধিতা বা প্যারাডক্স।
দেখতে পাই, নয়া উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার শিক্ষা-দর্শন বিদ্যমান জ্ঞানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ বা দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে সৈয়দ নিজার টমাস কুন ও ফায়ারাবেনদের বিবেচনা উল্লেখ করে তাঁর গ্রন্থে বলছেন, ‘জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হয় না। বরং এর বিকাশ বিজ্ঞান বা অন্যান্য বিষয়ের স্ববিরোধিতা বা সমস্যাগুলো চিহ্নায়নের মধ্য দিয়ে আসে।’ এ কারণে লেখক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের মধ্যে আইনি পার্থক্য ছাড়া আর কোনো পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয় না।’
বইয়ের আলাপে দেখতে পাই, ‘আলোকায়ন প্রকল্পের’ মধ্য দিয়ে পশ্চিমের জ্ঞানকাণ্ডকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে হাজির করা হয়েছে। আর প্রাচ্যে সেই ‘সত্য জ্ঞানের’ পুনরুৎপাদন করতে গিয়ে যে গবেষণা চলছে, তা অনেকাংশে পাশ্চাত্য জ্ঞানকাণ্ডের ইতিহাস, বিশ্লেষণ এবং প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মনে রাখা দরকার, পুনরুৎপাদিত হলেই জ্ঞান নির্ভরযোগ্য বা সত্য হয়ে ওঠে না।
কার্যত, পাশ্চাত্য প্ররোচিত বিশেষায়িত জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ ও আড়ষ্টতানির্ভর। লেখক বলছেন, ‘যেকোনো বিষয়কেন্দ্রিক জ্ঞান অন্যান্য বিষয়ে অজ্ঞতা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করে। এমনকি বিশেষজ্ঞরা নিজের বিষয়ের বাইরে জগৎ-জীবনের অপরাপর বিষয়ে অজ্ঞ থাকার কারণে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এ ধরনের জ্ঞানবিভাজন মানুষকে আত্মবিশ্বাসহীন ও হীনমন্য করে তোলে।’ যে হীনমন্যতা থেকে আবার তৈরি হয় ‘অনুকরণ’, নকল করার প্রবণতা বা মিমিক্রি। উত্তর উপনিবেশি তাত্ত্বিক, হোমি ভাবা এবং ফ্রাঞ্জ ফানো এ ধরনের প্রবণতাকে মনোজগতের বিকার বলে চিহ্নিত করেছেন।
আর এই সমগোত্রীয় বিকার থেকে যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও মুক্ত থাকতে পারেনি তা নিজার সাহেবের আলোচনায় প্রচ্ছন্নভাবে উঠে এসেছে। মঞ্জুরি কমিশন নিজেদের কর্ম উপযোগিতা বাড়াতে গিয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানকাণ্ডের অনুকরণ তো করেছেই। এ জন্য তারা দিশা খুঁজেছে নয়া উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার প্রধান উপদেষ্টা, খোদ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শকদের ওপর। এ রকম জনবিচ্ছিন্ন এবং ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে মঞ্জুরি কমিশন হয়তো প্রমাণ করতে চাইছে, ধূর্ত শিয়ালের কাছে ছাগল শাবক পাহারা দেওয়ার দায়িত্বও দেওয়া যায়!
প্রাচ্যের মস্তিষ্কে ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড যে বিচ্ছিন্নতা ও অসংলগ্নতা তৈরি করে তার থেকে মুক্তি কিসে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই, জনাব নিজার প্রাক-ঔপনিবেশিক মহাবিহারে অনুস্মৃত জ্ঞানপদ্ধতিকে সমাধানসূত্র হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি এ আলোচনায় নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর ও ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে জৈন ও মাধ্যমিকদের জ্ঞানপ্রক্রিয়াকে উল্লেখ করে নিজার বলেন, ‘জৈনরা মনে করেন, প্রতিটি তত্ত্বই আংশিক সত্যকে উপস্থাপন করে। ...বৌদ্ধদের অবস্থান, বিশেষত মাধ্যমিকদের ভূমিকা আরেকটু বৈপ্লবিক। তারা মনে করেন, জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত সকল তত্ত্ব আংশিক সত্য নয়, বরং তা আপাত সত্য বা ব্যবহারিক সত্য।... পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডকে সার্বিক বা পরম সত্য ভাবার কারণে সেই জ্ঞানকে যে ছেদ করা প্রয়োজন আছে এবং সেটি সম্ভব তা আমরা মনে করি না।’
বলা দরকার, সৈয়দ নিজারের আলোচনায় এই অঞ্চলের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যে বর্ণনা উঠে এসেছে, তা এই নকলপ্রিয় ও মনোজাগতিকভাবে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহে ফেরার স্নিগ্ধ আহ্বান। পরিচয়-সংকটের বোধ থেকে টেনে তুলে ওঠাবার সামর্থ্য ও অঙ্গীকার দেখা যায় তাঁর লেখায়। তিনি উপনিবেশ কর্তৃক ঘটানো বিচ্ছেদায়নের পাল্টা প্রতিরোধও হাজির করেন তাঁর আলোচ্য গ্রন্থের মাধ্যমে। আর ওই প্রতিরোধের নাম দেন তিনি ‘বি-বিচ্ছেদায়ন’ (Dealienation)।
তিনি দেখাচ্ছেন, সপ্তম শতকে নালন্দা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। সে সময়ে দশ হাজার শিক্ষার্থী ও দুই হাজার অধ্যাপকদের চিন্তামুখরতায় আলোড়িত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ নানান দেশ থেকে জ্ঞানার্জনের জন্য এখানে আসতেন। সেখানে তিনটি গ্রন্থাগার ছিল, যার মধ্যে কমপক্ষে একটি নয় তলাবিশিষ্ট ছিল। এ ছাড়া ছিল বিতর্ক ও সভার জন্য পৃথক পৃথক কক্ষ।
পড়তে গিয়ে একটি বিষয় কিছুটা অমীমাংসিত থেকে যায়, পশ্চিমা জ্ঞানের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন বিকাশমুখী জ্ঞান সৃষ্টি করা কি আদৌ সম্ভব নয়? যদি না হয় তাহলে পশ্চিমে উৎসব করে জ্ঞানের যে প্রদর্শন চলছে, সে ব্যাপারে লেখকের আলোচনা থাকলে পাঠক আরো উপকৃত হতো। একই সঙ্গে বর্তমানে পশ্চিমে স্বাধীন জ্ঞান চর্চার হালহকিকত কী, সে ব্যাপারে কিছুই তেমন উল্লেখ করেননি লেখক। এ প্রসঙ্গে তিনি সমসাময়িক ‘স্কলার্স আন্ডার অ্যাটাক’, ‘সিস্টেমেটিক অ্যাটাক অন প্রগ্রেসিভ একাডেমিক আইডিয়ালস’ ইত্যাদি আলোচনা কে সামনে আনতে পারতেন।
বইটিতে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরূপ অনুসন্ধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি এবং কোন প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে গেলে যেসব আইনি ও জ্ঞানতাত্ত্বিক শর্ত অনিবার্য হয়, লেখক সে ব্যাপারে চমৎকার আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। বইটি আগ্রহী পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে চিন্তার আরো গভীরে।
উল্লেখ করা দরকার, বইটি তাড়াহুড়া করে বের করার কিছুটা ছাপ লক্ষ করা যায়। কারণ, এর কোথাও কোথাও রয়েছে কিছুটা মুদ্রণ প্রমাদ। পাঠকের যুক্তির প্রবহমানতা দু-এক জায়গায় হঠাৎ করে হোঁচট খেতে পারে। বইটিকে একাডেমিক বই বলা গেলেও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে আলোচনা এগোয়নি খুব একটা। তবে কোথাও কোথাও প্রশ্ন এবং পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে লেখক তার নিজস্ব যুক্তি বুনে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নান্দনিক শৈলীতে।
বইটির প্রচ্ছদে একটি ডানা-মেলা-উড়ন্ত পাখির গতিময়তা দেখিয়েছেন রাজীব দত্ত তাঁর নন্দন দক্ষতায়। পাঠক হৃদয়ে হয়তো এ পাখিটিই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুক্তি আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে থাকবে। আত্মপরিচয় প্রসবের প্রবল বেদনাও থেকে থেকে ছড়িয়ে যাবে তাঁদের বুক ও পাঁজরে।
বই পরিচিতি
বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন
সৈয়দ নিজার আলম
প্রকাশক : প্রকৃতি-পরিচয়
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত
দাম : ১৩৫ টাকা