নিরীশ্বরবাদী ঈশ্বর, মানবতাবাদী ঈশ্বর
জন্মের পর পিতামহ বড় সাধ করে পৌত্রের নাম রেখেছিলেন ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরই কি না ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না? এও কি মানা যায়? তার ওপর কুলীন ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম। হতে পারে ঘরে চাল নেই, চুলো নেই। ধনসম্পদের কৌলীন্য নেই। মাসিক ছয় টাকা বেতনের সওদাগরি অফিসের এক কেরানির ছেলে। তাই বলে এমন অধর্ম কে মানবে শুনি? সমাজটার কথাও তো একটু ভাবতে হবে, নাকি? সতীদাহ তখন খানিকটা রোধ করা গেছে। আড়ালে আবডালে যদিও তা চলছিল এখানে ওখানে। ধর্মের হাজারো রকম ফিরিস্তি। ওমুক মত, তমুক পথ। দিশা থাকুক আর নাই থাকুক নিয়মনীতির অন্ত নাই। আর একজন বেটে, কালো, রোগা-পাতলা মানুষ নাকি বলেন, ‘মানি না’। বললেই হলো?
প্রশ্ন আসতে পারে, এমন আপাত অক্ষম এ পুরুষটি কী করে পারলেন সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের কণ্ঠস্বরটি তুলে ধরতে? এই ফাঁকে একটু ইতিহাস ঘেঁটে আসি। হতে পারেন তিনি বেটে, কিন্তু হিমালয় সমান ছিল তাঁর উচ্চতা। হতে পারেন তিনি কালো, কিন্তু বুকের ভেতর ছিল তাঁর অগ্নিমশাল। হতে পারেন তিনি রোগা, কিন্তু তাঁর মতো লৌহমানব কজনই বা দেখেছেন তখন? সংস্কৃত শিক্ষাকে পুঁজি করে আর ইংরেজির ব্যবহারিক জ্ঞানের পারদর্শিতা দিয়ে একসময় সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতি আন্দোলনের শীর্ষে আরোহণ করেন ঈশ্বর। শাস্ত্রীয় শিক্ষাকে সম্বল করে হয়ে ওঠেন মানবতাপ্রেমী ও যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক। কেন এমনটা হলো, তা গবেষণার বিষয়, প্রাবন্ধিকের কাজ তা নয়। তবে এ কথা কী করে অস্বীকার করি, কট্টর ধর্মীয় গোঁড়া নীতি-নির্ধারকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, তাঁদের শত বাধা-বিপত্তি ও নিন্দা-মন্দ সত্ত্বেও জীবদ্দশাতেই বিক্রি হয়েছে রক্তমাংসের ঈশ্বরের ছবি।
নিরীশ্বরবাদিতা প্রসঙ্গে
পরিবারদত্ত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথম জীবনেই সেই বাহ্মণীয় ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ পদবিখানা ঘুঁচে যায়, সেখানে বসে ‘বিদ্যাসাগর’। একসময় তো নামেই পরিণত হয়। এ তো আর এমনি এমনি হয়নি। হালআমলে হলে না-হয় কথা ছিল। নামের আগে-পরে উপাধি-অলংকরণ দিয়ে নিজের নামখানাই ঢেকে ফেলেন। নয়তো ওরকম অলংকারের ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকে যে, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না। নিজের ঢাক নিজেই পেটানো আর কি! কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষেত্রে তো সে ব্যাপার ঘটেনি। আর তা ঘটলেও পাটকাঠির মতো কবেই টুকরো টুকরো হয়ে যেত! এমনকি এ প্রজন্মের অনেকে তো ঈশ্বরচন্দ্রের পারিবারিক পদবিটিই জানেন না। তারা বরং চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন পায় : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বংশ-পদবি কী?
নামের থেকে কী করে নিজের ব্রাহ্মণত্ব মুছতে পেরেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, আসা যাক সেই কথায়। মূলত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যই তাঁকে দিয়েছিল এই ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি। সময়টা ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল। হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। সে পরীক্ষাতে সবাইকে রীতিমতো চমকে দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন ঈশ্বর। এরপর ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের পাশে লেখা হয় ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি।
পূর্বের প্রসঙ্গে আসা যাক, বাহ্যত ইস্পাত কঠিন পুরুষ ছিলেন ঈশ্বর। কিন্তু অন্তরে ছিল অপার দয়া ও অতল বিদ্যার সাগর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী। ধর্ম সম্পর্কে ছিলেন নিস্পৃহ। হয়তো এ কারণেই শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুতেই তাঁর মুখ থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো স্থির বিশ্বাস বা ভক্তির একটি কথাও আদায় করতে পারেননি। জীবনে কোনো ধর্মযাজককে সঙ্গী করেননি, পূজা-আর্চা তো দূরের কথা, কোনোদিন কোনো মন্দিরে পা পর্যন্ত রাখেননি। চরিত্রের এমন গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে একবার বলেছিলেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’
ধর্ম-সম্পর্কিত নিস্পৃহতার আরো কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি। পাঠ্য বিষয় দর্শন সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের উক্তিটি এমন: ‘কতগুলো কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত সে সম্পর্কে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই।’
এদিকে আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য লিখছেন : ‘ঐ বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, এ কথা বোধ হয় তোমরা জান না, যাঁহারা জানিতেন তাঁহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাঁহার সঙ্গে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না।’
‘দেশের লোক কোনও শাস্ত্র মানিয়া চলে না, লোকাচার ইহাদের ধর্মও।’ আজীবন এই ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের ধারণা। তাই তিনি লোকাচার স্বরূপ কুসংস্কার থেকে ধর্মকে মুক্ত করতে গিয়ে হয়ে ওঠেন সংশয়বাদী। ঈশ্বরচন্দ্রের কথায় : ‘শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। …শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে, তারা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে। বিজ্ঞানের জয় হয়নি।’
উত্তরকালের যুক্তিবাদীদের কাছে ঈশ্বরচন্দ্রের এ উক্তিটি অনুসরণযোগ্য: ‘ধর্ম যে কি তাহা মানুষের জ্ঞানের অতীত এবং বর্তমান অবস্থায় ইহা জানিবার কোনও প্রয়োজন নাই।’
নিজের জীবন আচারে তিনি তা মান্যও করে চলেছেন। ধর্মীয় অনুশাসনকে তোয়াক্কা করেননি। স্ত্রী দীনময়ী দেবী মারা যান বিদ্যাসাগরের আগেই। কিন্তু বিদ্যাসাগর সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার, কিন্তু নিজে শ্রাদ্ধবাসরে যাননি।
আসা যাক, ঈশ্বরচন্দ্রের ধর্ম-ভাবনা সম্পর্কে তাঁর জীবনীকাররা কে কী বলেছেন সেই আলোচনায়। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘তাঁহার (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) নিত্যজীবনের আচার-ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন অবস্থাবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না, অপরদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের পরিচয়ও কখনো পাওয়া যায় নাই।’
অন্যদিকে আরেক জীবনীকার বিহারীলাল সরকার অভিমানস্বরে লিখেছেন, ‘দুঃখের বিষয় অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখ কাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে। হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন।’
মানবতাবাদিতা প্রসঙ্গে
১৮৫১ সালের ২২ জানুয়ারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন ঈশ্বরচন্দ্র। এর অল্প কয়েক মাস পরে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কলেজে প্রবেশাধিকার পায় কায়স্থরা, যা ছিল অকল্পনীয়। আগে ওই কলেজে পড়ার অনুমতি ছিল কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের। এক বছরের মধ্যে যেকোনো হিন্দুর সন্তান কলেজে ভর্তি হতে পারবে। এই মর্মে নিয়ম জারি করেন বিদ্যাসাগর। এ বিষয়ে একটি কথা প্রাসঙ্গিক। বিদ্যাসাগর সব ভারতীয় দর্শন মন্থন করে ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে একটি শ্লোক উদ্ধার করেছিলেন, ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চা পতিতে পতৌ/পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে’ - বিধবা বিবাহ বিহিত ও কর্তব্য কর্ম। বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা শাস্ত্রীয় ও সামাজিক এই মর্মে ব্যাখ্যা করে ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন ১৮৫৬ সালে ‘Marriage of Hindu Widows’ । ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ বিল পাস হয়।
ঈশ্বর কতখানি দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তা তাঁর যাপিত জীবনের এই বাঁকে এসে প্রতীয়মান হয়। ১৮৭০ সালের ১১ আগস্ট, নিজের পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে পুত্র নারায়ণের সঙ্গে বিয়ে দিলেন ১৬ বছরের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর। স্ত্রী বা মা, কেউই সমর্থন করেননি এই বিয়ে। বিয়ে হলো মির্জাপুর স্ট্রিটে কালীচরণ ঘোষের বাড়িতে। নারায়ণের মা বা ঠাকুমা, কেউই আসেননি। নববধূকে বরণ করলেন তারানাথ তর্কবাচষ্পতির স্ত্রী। অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তখনো তিনি জানতেন না, এই পুত্রকে মাত্র দুই বছরের মধ্যে ত্যাজ্য করতে বাধ্য হবেন। আর এই পুত্র-বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই কার্যত পত্নী-বিচ্ছেদ ঘটেছিল তাঁর। পুত্রের প্রতি অনমনীয় মনোভাব মানতে পারেননি তিনি। উইলে ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন : ‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ তিনি চতুর্বিংশধারা নির্দিষ্ট ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা... এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।’
পাঁচ পুত্রকন্যার মধ্যে নারায়ণচন্দ্র জ্যেষ্ঠ ও একমাত্র পুত্র। তাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করার পেছনে গভীর বেদনা ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কোনো হঠকারিতা ছিল না। এই উইল লেখার পর বিদ্যাসাগর ১৬ বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু উইলের একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি।
পুনশ্চ কিংবা জিজ্ঞাস্য
অবাক হতে হয় বৈকি! প্রায় দেড় শতাধিক বছর আগে আজকের তুলনায় আরো আঁধার যুগে ভাববাদী দর্শনের বিষবৃক্ষের শিকড়ে ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগর যেভাবে আঘাত করার সাহস দেখিয়েছেন, একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে তাঁকে বা তাঁর সেই কৃতকর্মকে সামান্যতম স্মরণে রাখছি কি আমরা?