গপ্পো তক্ক যুক্তি
‘বাণিজ্যিক ছবি’ শব্দটায় বিশ্বাস করি না : সৃজিত মুখার্জি
কলকাতার বাংলা ছবি গত দশকে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য হাতেগোনা কয়েকজন পরিচালকের নাম চলে আসে। যেমন : অঞ্জন দত্ত, কৌশিক গাঙ্গুলী, সৃজিত মুখার্জি, অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী, কিউ। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যবসাসফল বোধ হয় সৃজিত। মাত্র পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে আটটি ছবি বানিয়েছেন তিনি। আগামী ১৬ অক্টোবর মুক্তি পাচ্ছে তাঁর নতুন ছবি ‘রাজকাহিনী’।
আজ ২৩ সেপ্টেম্বর সৃজিত পা রাখলেন ৩৮ বছরে। ১৯৭৭ সালে কলকাতায় জন্ম তাঁর। বাবা-মা দুজনেই অধ্যাপক। পড়ালেখাটা মনোযোগ দিয়েই করেছেন সৃজিত। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করে, জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনভায়রনমেন্টাল ইকোনমিকসে মাস্টার্স ও এমফিল করেন। এর পর পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু এক বছর যেতে না-যেতেই পিএইচডি বাদ দিয়ে চাকরিতে ঢুকে পড়েন। অর্থনীতিবিদের চাকরিটা ভালোই চলছিল, কিন্তু এরই মধ্যে মাথায় ঢোকে থিয়েটারের ভূত।
চাকরি বাদ দিয়ে শুরু করেন অভিনয়। দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে থিয়েটার গ্রুপগুলোর সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন সৃজিত। এসব থিয়েটার গ্রুপগুলো বাংলা ও ইংরেজি দুই ধরনের নাটকই মঞ্চস্থ করত। ২০০৯ সালে সিনেমার জগতে চলে আসনে সৃজিত। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন অঞ্জন দত্তের ‘ম্যাডলি বাঙালি’ এবং অপর্ণা সেনের ‘ইতি মৃণালিনী’ ছবিতে। এ ছাড়া এসব ছবির জন্য গানও লেখেন তিনি।
২০১০ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি ‘অটোগ্রাফ’। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। পরিচিতি পেয়ে যান পরিচালক হিসেবে। এর পর একে একে করেছেন আরো আধডজন ছবি। ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘মিসর রহস্য’, ‘জাতিস্মর’, ‘চতুষ্কোণ’ এবং ‘নির্বাক’। এর মধ্যে ‘জাতিস্মর’ ও ‘চতুষ্কোণ’ পেয়েছে ছয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘চতুষ্কোণ’ ছবির জন্য ভারতের ৬২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন।
‘চতুষ্কোণ’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাওয়ার পর গত এপ্রিলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৃজিত কথা বলেছেন সিনেমা নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রেমাঙ্কুর বিশ্বাস।
প্রশ্ন : ‘চতুষ্কোণ’-এর জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়ে কি অবাক হয়েছেন, নাকি এটা প্রত্যাশিত ছিল? আগের ছবি ‘জাতিস্মর’ যেখানে চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল?
সৃজিত : হ্যাঁ, ‘জাতিস্মর’ অবশ্য বেশ আওয়াজ তুলতে পেরেছিল। এই ছবিটার পর মানুষ আমার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু ‘চতুষ্কোণ’-এর জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কারটা পেয়েছি, কারণ এটা একটা লেয়ার্ড ফিল্ম। ছবির চিত্রনাট্যটাই আসল। তাই সেটাও সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার জিতে নিয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে। একটা পর্যায়ে এটা পোর্টমেনট্যু ফিল্ম, পরে ছবির বাকি গল্পগুলো এক হয়ে একটা লিনিয়ার ন্যারেটিভ তৈরি করে। আমার মনে হয়, গল্প বলার এই ঢংটার কারণেই ছবিটি প্রশংসিত হয়েছে। আমার কাছে ‘চতুষ্কোণ’ হচ্ছে এমন একটা ছবি, যেটা আমাকে আলাদাভাবে গল্প বলার স্বাধীনতা দিয়েছে। একভাবে দেখতে গেলে একটা ছবির মধ্যেই এখানে চারটা ছবির কাজ করেছি।
প্রশ্ন : ‘চতুষ্কোণ’ ছবিটার প্রি-প্রোডাকশনে প্রচুর সময় লেগেছে। সেটা কেন?
সৃজিত : ছবিটা আরো চার বছর আগেই করার কথা ছিল। আমার প্রথম ছবি ‘অটোগ্রাফ’-এর পরই এই ছবিটার কাজ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু বারবার বাধা পাওয়ায় কাজটা পিছিয়ে যাচ্ছিল। ‘চতুষ্কোণ’-এ পরমব্রত যে ছবিটা করেছে, প্রথমে সেটা করার কথা ছিল পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের। ছবিটার চিত্রনাট্য লেখার সময় ঋতুদা অনেক কিছু শুধরে দিয়েছিলেন। ওই সময়ে ঋতুদার মৃত্যু ছিল আমাদের জন্য একটা ধাক্কা। তাই ছবিটা ওকেই উৎসর্গ করেছি। এর পর অঞ্জন দত্তেরও একটা চরিত্র করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সরে গেলেন। এর মধ্যে আমিও খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সব মিলিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল কাজটা।
প্রশ্ন : ছবিতে পরমব্রতের চরিত্রে একটু মেয়েলি ভাব আছে। ঋতুপর্ণ ঘোষকে চিন্তা করে লেখা বলেই কি চরিত্রটি এ রকম?
সৃজিত : পরমব্রত ছবিতে যে চরিত্রটা করেছে, সেটাই কিন্তু ছবিটার সবচেয়ে জটিল চরিত্র। আমি চরিত্রটা ঋতুদাকে মাথায় রেখে লিখেছিলাম। আমি এটাকে অশুভ একটা চরিত্র বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঋতুদা চেয়েছিল চরিত্রটার ধাপগুলো স্পষ্ট করতে। আমি খুব খুশি যে চরিত্রটার জটিল দিকগুলো পরমব্রত খুব সহজে ফুটিয়ে তুলেছে।
প্রশ্ন : ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর পর বাংলা ছবিতে একটা অভাব তৈরি হয়েছে। ভালো গল্পের ছবি এবং বাণিজ্যিক ছবির মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ণ সম্পর্ক ঋতু তৈরি করেছিলেন, সেটা হারিয়ে গেছে। আপনার কি মনে হয়, ঋতুপর্ণকে ছাড়া কলকাতার ছবিগুলো দিশেহারা অবস্থায় পড়েছে?
সৃজিত : একটা জিনিস পরিষ্কার করি, ‘বাণিজ্যিক ছবি’ শব্দটায় আমি বিশ্বাস করি না। এ ধরনের ছবিকে আমি বলব জনপ্রিয় ধারার ছবি। এবং জনপ্রিয় বলার মাধ্যমে আমি কিন্তু এ ধরনের ছবিকে অপমান করছি না বা ছোট করে দেখছি না। আর হ্যাঁ, ঋতুদাকে আমরা সবাই খুব মিস করি। ওকে ছাড়া আমাদের আসলেই দিশেহারা অবস্থা। ও যে শুধু একজন মেধাবী নির্মাতা ছিলেন তা শুধু নয়, সমসাময়িক পরিচালকদের কাজ নিয়ে ওর খুব আগ্রহ ছিল। তবে এখন ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ কিছু ভালো কাজও হচ্ছে। কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘ছোটদের ছবি’ যেমন। খাটো মানুষদের প্রেমের গল্প নিয়ে তৈরি ছবিটা।
প্রশ্ন : কিন্তু সাধারণ দর্শকের ধারণা হচ্ছে, এ ধরনের ছবির মূল দর্শক তরুণরা। এর চেয়ে বরং দক্ষিণের ছবির ইন্ডাস্ট্রি অনেক গোছানো এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল।
সৃজিত : হয়তো আমাদের ছবি বানানোর প্রক্রিয়ায় ভুল আছে। কিন্তু আপনাকে এটাও বুঝতে হবে যে তেলেগু আর তামিল ছবির তুলনায় আমাদের ছবির বাজেট কিছুই না। আমাদের কাছে দারুণ দারুণ সব ছবির আইডিয়া আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় আমরা সেসব ছবি বানাতে পারি না। কলকাতায় এখন কিউ এবং কৌশিক গাঙ্গুলীর মতো পরিচালকরা কাজ করছে, যারা অন্য রকম গল্প নিয়ে ছবি বানায় এবং আরো নতুন কী করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : নতুন চিন্তাভাবনার কথা যখন এলোই, আপনি কি অন্য ধরনের কাজ করার কথা ভাবছেন? আপনার সমসাময়িক পরিচালকরা, যেমন কিউ ভিন্ন ধরনের ছবি নিয়ে কাজ করেন।
সৃজিত : আমার তো মনে হয়, আমি সব সময় আলাদা ধরনের গল্প নিয়েই কাজ করেছি। ‘জাতিস্মর’ ছিল প্রায় ভুলতে বসা কবিগানের সংস্কৃতি নিয়ে। ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছিল এক পুলিশ অফিসারের মানসিক সমস্যা নিয়ে। ‘হেমলক সোসাইটি’ ছিল সুইসাইড ক্লাব নিয়ে। ‘নির্বাক’ ও ‘রাজকাহিনী’ও আলাদা গল্প নিয়ে তৈরি।
প্রশ্ন : ‘নির্বাক’ ছবিতে সুস্মিতা সেন অভিনয় করেছেন। এটা মুক্তি পাওয়ার পর দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে। আবার ছবির যৌন বিষয়গুলো নিয়েও মানুষ কিছুটা বিব্রত।
সৃজিত : ‘নির্বাক’ হচ্ছে আমার সবচেয়ে গূঢ় ছবি। মানে এর মধ্যে যা বলতে চেয়েছি, তা সচরাচর বলা হয় না বা বেশি মানুষ এগুলো নিয়ে চিন্তা করে না। এই ছবিটা যদি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়, তাহলে সেটা হবে আমার জন্য চমক! যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে দালি মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েই এই ছবিটার আইডিয়া মাথায় আসে। দালির কাজে নৃতাত্ত্বিক একটা বক্তব্য আছে, সেটা আমাকে প্রভাবিত করেছে। ছবিটিতে নীরবতার মাধ্যমে ভালোবাসার ধরনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
প্রশ্ন : আপনার পরবর্তী ছবি ‘রাজকাহিনী’। যেটা দেশভাগের সময়কার একটি পতিতালয়ের কাহিনী নিয়ে তৈরি। গল্প শুনে মনে হয়, অনেকটা শ্যাম বেনেগালের ‘মান্দি’ ছবির মতো। আসলেই কি তাই?
সৃজিত : ‘রাজকাহিনী’ আমার ম্যাগনাম ওপাস। এই ছবির চিত্রনাট্য লেখার আগে আমি দেশভাগ নিয়ে লেখা প্রচুর সাহিত্য পড়েছি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান—এই তিন দেশের সহিংসতা ইতিহাস পড়েছি। এই ইতিহাস ধীরে ধীরে আমাদের মন থেকে মুছে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো জার্মানির শিশুরা নাজি কথাটি শুনলে শিউরে ওঠে। অথচ আমাদের শিশুরা দেশভাগের ইতিহাসই জানে না। ‘রাজকাহিনী’তে আমি দেশভাগের সময় নারীদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে, সেটা দেখাতে চেয়েছি। এবং সহিংসতা দেখানোর ক্ষেত্রে আমি কোনো কাপর্ণ্য করিনি।
প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কি আপনার বলিউডে যাওয়ার পথ সুগম করবে বলে মনে হয়? কারণ, ইয়াশ রাজ ফিল্মসও এখন দাম লাগাকে হাইসা এবং ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সির মতো ছবি প্রযোজনা করছে।
সৃজিত : আশা করি। কিন্তু আমি যেভাবে চাই, সেভাবে মিললেই কেবল আমি ছবি বানাই। শৈল্পিক অভিব্যক্তির নামে এ ক্ষেত্রে আমি কোনো ছাড় দিতে চাই না।