বাংলাদেশের রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ১
চলচ্চিত্রে প্রতিবাদ আর নির্মাণশৈলীর নতুনত্ব
এক
উপন্যাস, কবিতা, নাটক, চিত্রকলার মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবাদ। রাজনীতিমনস্ক চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের কাজে কখনো সরাসরিভাবে, কখনো রূপকের মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য এবং সমালোচনা তুলে ধরেছেন। চলচ্চিত্র ব্যবহৃত হয়েছে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে, সমাজে টিকে থাকা অন্যায় আর শোষণের জটিল রূপ সম্পর্কে দর্শকদের মনে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। বাণিজ্যিক উদ্দেশে তৈরি বিনোদনধর্মী ছবি বহু দর্শকের কাছেই প্রিয় এবং এই ধরনের ছবির প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করার যুক্তি নেই। তবে অনেকে মনে করেন বিনোদন প্রদানই হলো চলচ্চিত্রের মূল কাজ। মনে করা হয় কোনো চলচ্চিত্র যদি দর্শককে বিনোদনের মাধ্যমে আকৃষ্ট করতে না পারে তাহলে সেই চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতিও দর্শক মনোযোগী হবে না। এমন ধারণার সাথে যৌক্তিকভাবে দ্বিমত পোষণ করা যায়। বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি হবে তা স্বাভাবিক কিন্তু সব চলচ্চিত্রেই যে বিনোদনধর্মী উপাদান থাকতে হবে এমন ধারণা অগ্রহণযোগ্য। বিনোদননির্ভর বাণিজ্যিক ছবিতে সমাজের জটিল সমস্যাগুলো থেকে দর্শকের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে রাখা হয়। কারণ আনন্দ প্রদানই এই ধরনের ছবির মূল লক্ষ্য, দর্শককে বিচলিত বা ক্ষুব্ধ করা নয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো কখনো সেখানে উপস্থাপিত হলেও আনন্দদায়ক উপাদান প্রাধান্য দেওয়ার কারণে দর্শক-মনে তা যথেষ্ট অস্বস্তি তৈরি করতে পারে না। আবার কখনো খুবই শক্তিশালী কোনো নায়কের অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার অতিরঞ্জিত ঘটনা দেখানোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার অবাস্তব সমাধান।
কিন্তু সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণে মানুষকে আগ্রহী করে তোলা সমাজের স্বার্থেই জরুরি। রুশ কবি মায়াকোভস্কি যেমন বলেছিলেন, ‘শিল্পকলায় মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিবরণই শুধু প্রতিফলিত হয় না, শিল্পকলা মানুষের সংগ্রামে একটি হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে।’ আর রুশ বিপ্লবের পর বিপ্লবী চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করা প্রসঙ্গে লেনিন সেই সময়ের সাংস্কৃতিক কমিশার লুনাচারস্কিকে বলেছিলেন সব ধরনের আর্টের মধ্যে চলচ্চিত্রই তাদের কাছে সেই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার ব্যাপারে চলচ্চিত্রের সক্ষমতা লেনিন অনুধাবন করেছিলেন সঠিকভাবে। রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তৈরি চিন্তাশীল চলচ্চিত্রে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা গুরুত্ব পায় না কারণ বিনোদনের আধিক্য দর্শককে নিষ্ক্রিয়ভাবে আনন্দ উপভোগেই মগ্ন করে তুলবে। বিনোদনের সুখানুভূতির কারণে সামাজিক অন্যায়ের কদর্য এবং অনুভূতিহীন দিকগুলো দর্শককে পীড়িত করতে পারবে না। আর সমাজে টিকে থাকা সমস্যার উপস্থাপন দর্শককে আঘাত করতে কিংবা উৎকণ্ঠিত করতে সক্ষম না হলে সেই সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে দর্শকের সক্রিয় বিরোধিতা তৈরি হবে তাও আশা করা যায় না। কোনো ছবিতে যদি সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা উপস্থাপন করাই মূল উদ্দেশ্য হয়, সে ক্ষেত্রে দর্শককে গতানুগতিকভাবে বিনোদন দেওয়া হলে সেই ছবির উদ্দেশ্য এবং বক্তব্য যথেষ্ট কার্যকর না হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে বক্তব্য ও নির্মাণশৈলীর দিক থেকে চিন্তাশীল চলচ্চিত্র এবং শুধুই আর্থিক মুনাফা অর্জনের জন্য তৈরি বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের মধ্যে দেখা যায় সুস্পষ্ট পার্থক্য।
স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী এবং স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বিভিন্ন দশকে বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে রাজনৈতিকভাবে অস্থির এবং অনিশ্চিত পরিস্থিতি। টিকে থাকা রাজনৈতিক শোষণ এবং দুর্নীতি মানুষকে পীড়িত এবং ক্ষুব্ধ করেছে। মানুষ হয়েছে প্রতিবাদমুখর, বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা দেখেছি তাদের তীব্র প্রতিবাদ। স্বাধীনতার আগে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ক্ষোভ এবং আন্দোলন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে বর্তমান সময়ের বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। ১৯৬০-এর দশকে সারা বিশ্বেই ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়ে উঠছিল প্রতিবাদী আন্দোলন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সেই সময় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে, কিউবায় সফল হয় ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বিপ্লব এবং ১৯৬২ সালে কিউবানরা রুখে দেয় সিআইএ-সমর্থিত বে অফ পিগ্স্ হামলা, ভিয়েতনামের মানুষ তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে প্রবল শক্তিধর মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। রাজনীতি বিশ্লেষক জেরার্ড শালিঅ্যান্ড উল্লেখ করেছেন ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়েছিল এক বিপ্লবী উচ্ছ্বাসদীপ্ত পরিস্থিতি। কেবল তৃতীয় বিশ্বেই নয়, সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ উদ্দীপিত করেছিল শিল্পোন্নত বিভিন্ন দেশের তরুণদেরও। সেখানেও শুরু হয় বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তৈরি হয় নিজেদের অধিকার সম্পর্কে নতুন সচেতনতা, ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালে সূচিত হয় ছাত্রদের আন্দোলন, উন্নত দেশের সচেতন মানুষ সোচ্চার হয় ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
এমন প্রতিবাদী আবহ বিভিন্ন দেশে শিল্পীদেরও বৈপ্লবিক চেতনায় অনুপ্রাণিত করে, এবং তাদের কাজে দেখা যায় সেই চেতনার প্রভাব। বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্রকাররা এই সময় নতুন ধরনের ছবি নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নতুন ছবিতে সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয় গতানুগতিক নির্মাণশৈলী এবং সেসব ছবির বিষয়বস্তুতেও লক্ষণীয় হয় রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার স্পষ্ট আগ্রহ। ব্রাজিলে সিনেমা নোভো, আর্জেন্টিনায় নুয়েভা ওলা, চিলিতে সিনেমা অফ পপুলার ইউনিটি, ভারতে মৃণাল সেনের ভুবন সোম (১৯৬৭) ছবির মাধ্যমে সূচিত হওয়া নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ নতুন চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু হয় ষাটের দশকেই। তৃতীয় বিশ্বের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর পরিচালকরাও এই সময়ে বক্তব্য ও নির্মাণশৈলীর দিক থেকে ভিন্ন ধরনের ছবি নির্মাণ করতে থাকেন। ষাটের দশকের প্রতিবাদী বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তৈরি হয় জিল্লো পন্টেকর্ভোর দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স (১৯৬৬), জ্যঁ-ল্যুক গদারের লা শিনোয়াজ (১৯৬৭), টমাস গ্যেতিরেজ আলিয়ার মেমোরিজ অব আন্ডারডেভেলপমেন্ট (১৯৬৮), মিগুয়েল লিটিনের দ্য জ্যাকল অব নাহুয়েলটোরো (১৯৬৯), গ্লবার রোশার ব্ল্যাক গড হোয়াইট ডেভিল (১৯৬৪) আর র্তেরা এম ত্রানযি (১৯৬৭), ওসমান সেমবেনের মান্দাবি (১৯৬৮), জর্জ সানজিনের ব্লাড অব দ্য কনডর (১৯৬৯) প্রভৃতি ছবি যেখানে পরিচালকরা প্রদান করেছেন নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের আলোচনায় উল্লিখিত এই ছবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্টুডিও সিস্টেমের মধ্যেও নির্মিত কিছু ছবির বক্তব্য আর বিশেষ করে নির্মাণশৈলীতে লক্ষ করা যায় ভিন্নতা। আর্ট সিনেমা ধারার ছবি না হলেও এই ছবিগুলোতে পরিচালকরা সৃজনশীল নির্মাতা বা অত্যুর হিসেবে তাদের স্বকীয়তা টিকিয়ে রেখেছেন যে সুযোগ অতীতে স্টুডিও সিস্টেমের মধ্যে তৈরি চলচ্চিত্রে পাওয়া যেত না। এই ধারার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হলো আর্থার পেনের বনি অ্যান্ড ক্লাইড (১৯৬৭), মাইক নিকোলসের দ্য গ্র্যাজুয়েট (১৯৬৭), ডেনিস হপারের ইজি রাইডার (১৯৬৯), জন শ্লেসিঞ্জারের মিডনাইট কাউবয় (১৯৬৯) প্রভৃতি। অর্থাৎ ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশে যে বিপ্লবী পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তা স্পর্শ করে হলিউডের দৃষ্টিভঙ্গিকেও।
লক্ষণীয়, ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম বাংলার তিনজন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেনও একের পর এক আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলীর ছবি তৈরি করেছেন। সেই সাথে নিজেদের ছবিতে প্রদান করেছেন রাজনৈতিক বক্তব্য। সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২) আর মহানগর (১৯৬৩) ছবিতে আমরা দেখি ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্বলের সাহসী প্রতিবাদ। এই দশকে ঋত্বিক ঘটক তৈরি করেছেন তাঁর বিখ্যাত দেশভাগ ত্রয়ীর ছবিগুলো। দেশভাগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঋত্বিকের ক্ষোভ আর সমালোচনা স্পষ্ট প্রতীয়মান এই ছবিগুলোতে। ভুবন সোম ছবিতে মৃণাল সেন ব্যবহার করেছিলেন অভিনব এবং এক্সপেরিমেন্টাল নির্মাণশৈলী এবং সেই সাথে ছবিতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সামাজিক সমালোচনা। সত্তরের দশকের শুরুতে নিজের কলকাতা ত্রয়ীর ছবিগুলোতে মৃণাল সেন খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করেছিলেন নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য। এই ছবিগুলোর নির্মাণশৈলীকে বৈপ্লবিক করে তোলার লক্ষ্যে মৃণাল সেন ইন্টারভিউ (১৯৭০) আর কলকাতা ৭১ (১৯৭২)-এ ব্যবহার করেছিলেন জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখ্ট্ প্রবর্তিত ‘ডিসট্যানসিয়েশন’ কৌশল। এই ছবিগুলোর কয়েকটি দৃশ্যে ছবির মূল চরিত্ররা সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে কথা বলে। চলচ্চিত্রের কাল্পনিক জগৎ গতানুগতিকভাবে যে বিভ্রম তৈরি করে, তা ভেঙে দিয়ে দর্শকের মনে তীব্র অভিঘাত তৈরির মাধ্যমে তাদের বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করার এই বিশেষ কৌশলটি মৃণাল সেনই প্রথম ভারতীয় ছবিতে ব্যবহার করেন।
১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিবাদের ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল সেই পরিস্থিতি তুলে ধরার কোনো চেষ্টা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তৈরি বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করেই বাঙালি চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে অনাগ্রহী ছিলেন। সেই ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে সেই সময়ের বাঙালি চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের চলচ্চিত্রে প্রভাবশালী আইডিওলজি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। প্রতিবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবর্তে বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলা নিরাপদ ছবিই তাঁরা তৈরি করেছেন। এমনকি রূপকের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রদানেও তাঁরা সচেষ্ট হননি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি চলচ্চিত্রে সেই সময় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল তা পূর্ব পাকিস্তানে তৈরি বাংলা ছবিকে প্রভাবিত করেনি বললেই চলে। ছবির ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তা নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী করে তোলার ক্ষেত্রেও পরিচালকদের আগ্রহ ছিল না। সেই সময়ে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাহসী সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছিল কেবল জহির রায়হানের জীবন থেকে নেওয়া (১৯৭০) ছবিতেই। রূপকধর্মী এই ছবিতে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, চরিত্রদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক, হাস্যরস, মেলোড্রামা, অতিঅভিনয়, সঙ্গীত প্রভৃতি বাণিজ্যিক ছবির উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেগুলো দর্শককে বিনোদন দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। পরিচালক দক্ষতার সাথে এই উপাদানগুলো রূপান্তরের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানি শাসনবিরোধী বক্তব্য। দর্শককে রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রাণিত করা ছিল ছবির মূল উদ্দেশ্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক এক বছর আগে নির্মিত জীবন থেকে নেয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অসীম গুরুত্বপূর্ণ একটি মর্যাদা অর্জন করেছে। ছবিটি তৈরির আগে জহির রায়হান নিজেই উল্লেখ করেছিলেন আমাদের ছবিতে সেই সময় অবধি দেশের রাজনৈতিক জীবন স্থান পায়নি। আর এই রাজনৈতিক ছবি দর্শকদের মন যখন গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল তখন জহির রায়হান বলেছিলেন এমন একটি ছবি তৈরির পর তিনি আর নিচে নামতে পারেন না, আর পেছনে হাঁটতে পারেন না। এখন থেকে তাঁর কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। জহির রায়হানের এই কথা থেকে এমন ধারণা করা সম্ভব যে জীবন থেকে নেয়ার আগে যে ছবিগুলো তিনি তৈরি করেছিলেন বক্তব্য আর নির্মাণশৈলীর বিচারে সেই সব ছবি তাঁর কাছে ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
একটি গণযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল আর তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন ছিল পুরনো উপনিবেশী সমাজকাঠামোতে গুরুত্ব পাওয়া চিন্তাগুলো প্রত্যাখ্যান করা। স্বাধীন সমাজে নতুন চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে চলচ্চিত্রও ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা জরুরি ছিল। বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে বাণিজ্যিক ইন্ডাস্ট্রির বাইরে চিন্তাশীল, প্রথাবিরোধী ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচালকদের সাফল্য কতটা তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা চিন্তাশীল এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছবি বিশ্বে পরিচিত। যে প্রশ্নটি জরুরি হয়ে ওঠে তা হলো নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী নির্মাণশৈলী এবং সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যার তীক্ষ্ণ সমালোচনা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গত চার দশকে কতটা গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? বাংলাদেশি সমাজসচেতন ছবির ফর্ম কি যথেষ্ট প্রথাবিরোধী হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে? সমাজে টিকে থাকা রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর মূল কারণ সম্পর্কে দর্শকদের সচেতন করে তোলার কতটা আন্তরিক এবং সাহসী প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্রে? এই প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে গতানুগতিক ধারার বাইরে তৈরি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্টতর হবে। তবে এই পর্যালোচনার পূর্বে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের রূপ সম্পর্কে আমাদের যথাযথ ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রবন্ধের এই পর্যায়ে কোন নির্দিষ্ট উপাদানগুলো কোন চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক করে তোলে সে সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারণার আলোকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন করছি।
দুই
কোন ধরনের চলচ্চিত্র রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে সে সম্পর্কে চলচ্চিত্রকার এবং চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকদের একমত হতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং উপাদান সম্পর্কে পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা। কোনো কোনো তাত্ত্বিক এমন মত দিয়েছেন যে সব চলচ্চিত্রই রাজনৈতিক। এই বক্তব্যটির সাথে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ থাকে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র বিভিন্ন উদ্দেশ্যে তৈরি হয়, বিভিন্ন চলচ্চিত্রের বক্তব্য আর নির্মাণশৈলী ভিন্ন যার কারণে চলচ্চিত্রের প্রকারভেদ আমরা দেখতে পাই। কিন্তু সেই সব ধরনের চলচ্চিত্রই কি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে বর্ণনা করা যৌক্তিক? সের্গেই আইজেনস্টাইনের দ্য ব্যাটলশিপ পোটেমকিন (১৯২৫), আকিরা কুরোশাওয়ার রশোমন (১৯৫০), সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী (১৯৫৫), সালাহ্উদ্দিনের রূপবান (১৯৬৬), জ্যঁ-ল্যুক গদারের ওয়ান প্লাস ওয়ান (১৯৬৮), জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৩), মনসুর খানের কেয়ামত সে কেয়ামত তক (১৯৮৮), স্পাইক লির ডু দ্য রাইট থিং (১৯৮৯), জেমস ক্যামেরনের টারমিনেটর টু : জাজমেন্ট ডে (১৯৯১) এই ছবিগুলো একটি থেকে অন্যটি নির্মাণশৈলী, বক্তব্য আর পরিচালকের লক্ষ্যের দিক থেকে ভিন্ন ধরনের ছবি। কিন্তু সব ছবিই যদি রাজনৈতিক ছবি হয় তাহলে উপরে উল্লিখিত এই ভিন্ন ধরনের প্রতিটি ছবিই রাজনৈতিক ছবি হয়ে উঠেছে এমন দাবি করা কতটা গ্রহণযোগ্য?
সব চলচ্চিত্রই রাজনৈতিক এই বক্তব্য সমর্থনকারীদের মূল যুক্তি হলো প্রতিটি চলচ্চিত্রই সেই ছবির নির্মাতার দর্শন আর চিন্তারীতি অনুযায়ী নির্মিত হয় ফলে প্রতিটি ছবিই একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি তুলে ধরে। এই ধারণা সমর্থনকারীদের মতে, যে ছবিগুলো হালকা বিনোদন প্রাধান্য দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা হয়েছে, সেই ছবির নির্মাতারাও হয়তো সচেতনভাবেই দর্শককে সমাজের মূল সমস্যাগুলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। বিনোদন আর আনন্দময় পরিসমাপ্তি দেখানোর মধ্য দিয়ে এই ধরনের চলচ্চিত্র সমাজের নেতিবাচক বিভিন্ন দিক এবং শোষণ সম্পর্কে দর্শককে রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জনের সুযোগ দেয় না। তাই বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার সমালোচনা না করে তা টিকিয়ে রাখার এই প্রচেষ্টা নির্দেশ করে বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি এই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমর্থন। ফলে স্ট্যাটাস কুও টিকিয়ে রাখার এই প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক।
কেবলই বিনোদন জোগানোর মাধ্যমে দর্শকদের সমাজের বিভিন্ন জরুরি সমস্যা ভুলে থাকতে সাহায্য করার ফলে বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র কখনো পরিচালকদের অজান্তেই বিদ্যমান ব্যবস্থার সমর্থনকারী হয়ে যায়। ফলে এক অর্থে তা রাজনৈতিক হয়ে উঠলেও এমন চলচ্চিত্র সচেতনভাবে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রদানকারী চলচ্চিত্রের মতো হয়ে ওঠে না। সেই চলচ্চিত্রকেই রাজনৈতিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া যৌক্তিক যা গতানুগতিক নির্মাণশৈলী প্রত্যাখ্যান করে সচেতন ভাবে এবং নির্মাতা টিকে থাকা সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর তীব্র সমালোচনা তুলে ধরার মাধ্যমে দর্শককে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেন। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে তাই ব্যবসায়িক সাফল্য পরিচালকের মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। মানুষের বিভিন্ন মনোগত সমস্যা নিয়ে আলোচনাও এখানে গুরুত্ব পায় না বরং পরিচালকের মূল লক্ষ্য হয় সমাজে টিকে থাকা সমস্যা সরাসরি বা রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরে এই সমস্যাগুলোর মূল কারণ বিশ্লেষণ করা এবং যারা এই ধরনের সমস্যা টিকিয়ে রাখার জন্য দায়ী তাদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা।
রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে পরিচালকের একটি অবস্থান গ্রহণ করা অবধারিত হয়ে ওঠে, তবে এই অবস্থানটি নিতে হয় সমাজের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করা হলে তা হয়ে ওঠে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র। প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হলেও তা কখনো রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নয়। ১৯৩৫ সালে জার্মান চলচ্চিত্রকার লেনি রাইফেনস্টাল হিটলারের নির্দেশে তৈরি করেছিলেন তাঁর ছবি ট্রায়াম্প অব দ্য উইল। ছবিটিতে পরিচালক ব্যবহার করেছিলেন নতুন ধরনের নির্মাণশৈলী। ফলে নান্দনিকতার দিক দিয়ে ছবিটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও এই ছবিতে মূলত জার্মান নাৎসি পার্টি আর হিটলারের প্রশংসা করা হয়েছিল।
কিন্তু একটি সফল রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক মত এবং অবস্থান পাশাপাশি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে কোন মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য দর্শককে তা বিবেচনার সুযোগ দেওয়া হয়। স্পাইক লির গুরুত্বপূর্ণ ছবি ডু দ্য রাইট থিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিবরণ যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি ছবিটিতে কৃষ্ণাঙ্গদের আচরণের বিভিন্ন নেতিবাচক দিকও প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে ছবিটি পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র হয়ে ওঠেনি, বরং তা সমাজের জটিল একটি সমস্যা সম্পর্কে পরিচালকের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা তুলে ধরেছে যা দর্শকের সচেতনতা বৃদ্ধি করে। মৃণাল সেন তাঁর পদাতিক (১৯৭৩) ছবিতে একদিকে যেমন সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের জন্য বামপন্থী আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, তেমনি নকশালপন্থী রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনাও তুলে ধরেছেন। এই ছবিতে বামপন্থী বিপ্লবের প্রতি মৃণাল নিজের আস্থা অক্ষুণ্ণ রাখলেও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা বামপন্থী সংগঠনের নেতাদের মানসিকতার নেতিবাচক দিকগুলো প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করেননি। আকালের সন্ধানে (১৯৮০) ছবিতেও মৃণাল সেন সামাজিক সমালোচনা প্রকাশের ক্ষেত্রে শহর এবং গ্রাম দুই স্থানের মানুষদেরই মানসিকতার কিছু নেতিবাচক দিক স্পষ্ট করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট মতের প্রতি অন্ধভাবে পক্ষপাত দেখাবার পরিবর্তে এই ছবিগুলোতে সমাজে বিদ্যমান সমস্যা সংকুল পরিস্থিতি যথার্থভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে দর্শককে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছে। ফলশ্রুতিতে এই ছবিগুলো ভিন্ন হয়ে উঠেছে প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র থেকে এবং কার্যকর হয়েছে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে।
চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক মাইক ওয়েইনের মতে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র সমাজে অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক সম্পদের অসম বণ্টন এবং অসম অভিগম্যতার বর্ণনা তুলে ধরে এবং সেই সাথে প্রকাশ করে কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত সেই ব্যক্তিবর্গের পরিচয় যাঁরা এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে বৈধতা দিতে তৎপর থাকেন। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের এই সংজ্ঞা থেকে দেখা যায় কোনো শাসনব্যবস্থায় টিকে থাকা পীড়নমূলক দিকগুলোর বিরোধিতা করা হয়ে ওঠে এই ধরনের ছবির প্রধান উদ্দেশ্য। আবার কোনো চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রথাগত নির্মাণপদ্ধতি যেমন হলিউডের গতানুগতিক ‘কন্টিনিয়ুটি এডিটিং’ পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন করে তোলা অনেক চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক রাজনৈতিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই ধরনের ছবির কাহিনীতে কোনো রাজনৈতিক বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও কেবল গতানুগতিক চলচ্চিত্রের প্রথাগত ভাষা প্রত্যাখ্যান করার জন্যই এই ধরনের চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক আখ্যা দেওয়া হয়।
কিন্তু শুধু উদ্ভাবনী চলচ্চিত্র ভাষা ব্যবহার করা হলেই কোনো ছবি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে- এই মত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জ্যঁ-ল্যুক গদারকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে ধরা হয়। গদার নিজের ছবিতে সবসময়ই ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন জটিল চলচ্চিত্র কৌশল। চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী নিয়ে সবসময়ই তাঁর ছবিতে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। পাশাপাশি গদার নিজের ছবিতে প্রাধান্য দিয়েছেন রাজনৈতিক এবং ইতিহাসকেন্দ্রিক পরিপ্রেক্ষিতকেও। ষাটের দশকের শেষদিকে প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্রকে কাউন্টার-সিনেমা নামে অভিহিত করেন কোনো কোনো চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রথাবিরোধী নির্মাণশৈলী আর ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্টতা- এই তিনটি দিককে চলচ্চিত্র গবেষক রবার্ট প্যাট্রিক কিন্সমান কাউন্টার-সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে ল্যাটিন আমেরিকায় থার্ড সিনেমা নামে যে বিশেষ প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের সূচনা হয়, সেই থার্ড সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবেও ইতিহাসের সাথে সংযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কাউন্টার-সিনেমা এবং থার্ড সিনেমা দুই ধারার ছবিই রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত। সেক্ষেত্রে বলা যায় একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা এবং ঐতিহাসিক পটভূমি থাকা জরুরি, কেবল গতানুগতিকতামুক্ত নির্মাণশৈলীই কোনো ছবিকে রাজনৈতিক করে তোলার একমাত্র উপাদান নয়। কিন্সমান উল্লেখ করেছেন যে এক্সপেরিমেন্টাল ছবির নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিত মার্কিন চলচ্চিত্রকার স্ট্যান ব্র্যাকহাজের ছবির ফর্ম সৃষ্টিশীল ও প্রথাবিরোধী হলেও সেই চলচ্চিত্রগুলোকে গদারের ছবির মতো রাজনৈতিক ছবি বলে বিবেচনা করা যায় না, কারণ ব্র্যাকহাজের চলচ্চিত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা তুলে ধরার কোনো অভিপ্রায় নেই।
১৯৬৯ সালে কাইয়ে দ্যু সিনেমা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সিনেমা/আইডিওলজি/ক্রিটিসিজম’ নামে একটি লেখায় ফরাসি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক জঁ-লুই কমোলি আর জঁ-নারবোনি কোন চলচ্চিত্র কীভাবে ক্ষমতাসীন মতাদর্শের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক হয়ে উঠতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নির্মিত হওয়ার কারণে কোনো চলচ্চিত্র অবধারিতভাবেই একটি মতাদর্শ ধারণ করে কারণ চলচ্চিত্রকারদের কিছু নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সুবিধাপ্রাপ্তির মাধ্যমে কাজ করতে হয়। তাঁরা মনে করেছেন এই মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে সব চলচ্চিত্রই এক অর্থে রাজনৈতিক। কিন্তু তার পরও কোনো চলচ্চিত্র কীভাবে প্রথাবিরোধী তথা রাজনৈতিক হয়ে উঠতে পারে কমোলি আর নারবোনি সে সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। ফরাসি চিন্তাবিদ লুই আলথুসারের আইডিওলজি সংক্রান্ত ধারণার আলোকে কমোলি আর নারবোনি মনে করেন, যখন কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়, প্রথম শট থেকেই পরিচালক প্রকৃত অর্থে বাস্তবতা যেমন তা তুলে ধরার পরিবর্তে বাস্তবতার অন্য আরেকটি রূপ যা নির্দিষ্ট আইডিওলজি দ্বারা বর্ণিত তা প্রকাশ করতে থাকেন।
যে গতানুগতিক এবং প্রথাগত পদ্ধতির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে বাস্তবতা তুলে ধরা হচ্ছে কমোলি আর নারবোনির মতে প্রতিবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী একজন চলচ্চিত্রকারকে সে সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কেবল মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি নয়, দেখা যায় মূলধারার চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বাইরে নির্মিত অনেক ছবিও নিজেদের অজ্ঞাতেই প্রভাবশালী আইডিওলজির জন্য সুখকর বক্তব্যই তুলে ধরে এবং এই ধরনের চলচ্চিত্রে যে নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে কাহিনী তুলে ধরা হয় সেই নির্মাণপদ্ধতি দর্শককে সচেতন করার পরিবর্তে বরং সুখানুভূতিতে এবং চলচ্চিত্রের কাল্পনিক জগতের মোহে নিমগ্ন রাখে। ফলে বাস্তবতার প্রকৃত শোষণমূলক রূপ সম্পর্কে দর্শক-মনে কোনো উদ্বিগ্নতা এবং সচেতনতা সৃষ্টি হয় না।
কমোলি ও নারবোনি তাঁদের লেখায় এক ধরনের চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন যে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সরাসরিভাবে আধিপত্যশীল মতাদর্শের বিরোধিতা ও সমালোচনা করা হয়। একইসাথে পরিচালক গতানুগতিকভাবে বাস্তবতা উপস্থাপনের পদ্ধতি থেকে তাঁর ছবির নির্মাণশৈলী ভিন্ন করে তোলেন। ফলে কাহিনী এবং নির্মাণশৈলী দুই দিক থেকেই এই ধরনের চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে প্রথাবিরোধী। কমোলি এবং নারবোনি বর্ণিত এই ধরনের চলচ্চিত্রকেই কার্যকর রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে বর্ণনা করা যায়। এই দুই ফরাসি তাত্ত্বিকের আলোচনা থেকে এই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আধিপত্যশীল মতাদর্শকে সমর্থন দেওয়া চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বলে অভিহিত করা যৌক্তিক নয় বরং প্রভাবশালী মতাদর্শের বিরোধিতার মধ্য দিয়েই একটি চলচ্চিত্র রাজনৈতিক হয়ে ওঠে।
অবশ্য রাজনৈতিক চলচ্চিত্রও বিভিন্ন রকমের হতে পারে। গদার তাঁর বেশির ভাগ ছবিতেই জটিল চলচ্চিত্র ভাষা ব্যবহার করেছেন। চলচ্চিত্র বিষয়ে গভীর ধারণাসম্পন্ন দর্শক ছাড়া অন্যদের পক্ষে গদারের ছবিতে বিভিন্ন দৃশ্য কী অর্থ নির্মাণ করেছে তা বোঝা সহজ নয়। নতুন এবং এক্সপেরিমেন্টাল নির্মাণশৈলী ব্যবহার করার পাশাপাশি তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক সমালোচনা প্রদানের কারণে গদারকে চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক পলিন কায়েল মনে করেন গদারের চলচ্চিত্রগুলো রাজনৈতিক ছবি হিসেবে কার্যকর নয় কারণ এই ছবিগুলোর জটিল ফর্ম ছবির বক্তব্য সাধারণ দর্শকের কাছে দুর্বোধ্য করে তুলেছে। কিউবার চলচ্চিত্রকার টমাস গ্যেতিরেজ আলিয়ার মতে একটি চলচ্চিত্র যদি দর্শকের কাছে বোধগম্য না হয় তাহলে সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো অর্থ হয় না। অবশ্য একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শককে সচেতনভাবে ভাবতে বাধ্য করার কথাও আলিয়া উল্লেখ করেছেন। ‘দ্য ভিউয়ার’স ডায়ালেকটিক’ নামে নিজের গুরুত্বপূর্ণ লেখায় আলিয়া লিখেছেন একটি চলচ্চিত্রকে কেবল দর্শকের আবেগ স্পর্শ করলেই চলবে না, দর্শককে যুক্তির মাধ্যমে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্যও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দর্শকের চিন্তা করার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে বোঝা যায় আলিয়া উদ্ভাবনী নির্মাণশৈলী ব্যবহারও প্রয়োজনীয় মনে করেছেন। ব্রাজিলে গতানুগতিক চলচ্চিত্র বিরোধী নতুন সিনেমা আন্দোলন সিনেমা নোভোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার গ্লবার রোশাও রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের ফর্ম প্রয়োজনহীনভাবে জটিল করে তোলার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান না করে কেবল ফর্মকে অগতানুগতিক করলে ফলপ্রসূভাবে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায় না। আবার গতানুগতিক নির্মাণশৈলী ব্যবহার করেও কার্যকরভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করা সম্ভব নয়। আলিয়ার মতো রোশাও তাই রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে উদ্ভাবনী চলচ্চিত্র ভাষা এবং রাজনৈতিক বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন।
রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাই বিভিন্ন ধরনের মত বিদ্যমান। তবে ক্ষমতাশীল মতাদর্শকে ফর্ম আর কনট্যান্ট দুই দিক থেকেই বিরোধিতা করে নির্মাণ করা ছবিকেই রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করার ব্যাপারে চলচ্চিত্রকার আর চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকদের একমত হতে দেখা যায়। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে বিষয়বস্তু রাজনৈতিক সমস্যা কেন্দ্রিক করার পাশাপাশি ফর্মকে উদ্ভাবনী করার ব্যাপারে চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকরা একমত পোষণ করেছেন। তাঁরা আরো মনে করেন, রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে পরিচালকের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকবে এবং সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার মূল কারণগুলো প্রকাশ করা এবং সেই সমস্যাগুলোর তীব্র সমালোচনা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র দর্শকের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হবে।
চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকদের এমন ধারণা ষাটের দশকের শেষে ল্যাটিন আমেরিকায় শুরু হওয়া থার্ড সিনেমা ধারার চলচ্চিত্রের সাথে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকে সমধর্মী করে তোলে। থার্ড সিনেমার প্রবক্তা আর্জেন্টিনার দুই চলচ্চিত্রকার ফার্নান্দো সোলানাস আর অক্টাভিও গেটিনোর মতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার কারণ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে সেসব সমস্যার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তীব্র সমালোচনা প্রকাশ করা হয়ে ওঠে থার্ড সিনেমার মূল লক্ষ্য। থার্ড সিনেমা তাই সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা এবং স্ট্যাটাস কুও বিরোধী। সোলানাস ও গেটিনো উল্লেখ করেছেন যখন কোনো দেশের সরকার রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করার জন্য একটি চলচ্চিত্রকে মেনে নিতে পারবে না এবং চলচ্চিত্রটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে বুঝে নিতে হবে সেই চলচ্চিত্রটি বক্তব্যের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে সেই চলচ্চিত্রটি হয়ে উঠেছে একটি থার্ড সিনেমা ধারার ছবি। থার্ড সিনেমার জন্য কোনো নির্দিষ্ট নির্মাণশৈলীকে নির্ধারিত করা হয়নি। যেকোনো ধরনের নির্মাণপদ্ধতির মাধ্যমেই থার্ড সিনেমা তৈরি হতে পারে। তবে থার্ড সিনেমার লক্ষ্য যেহেতু বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করা নয় বরং রাজনৈতিক সমালোচনা প্রদান, ফলে থার্ড সিনেমায় যে ধরনের নির্মাণশৈলীই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা যেন রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ করে সেই দিকটি নিশ্চিত করা হয়। থার্ড সিনেমা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করে সম্পূর্ণভাবে। তাই এই ধরনের ছবিতে নির্মাণশৈলী স্বাভাবিকভাবেই হয়ে ওঠে গতানুগতিকতা-মুক্ত। মাইক ওয়েইনের মতে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে থার্ড সিনেমা ধারার ছবিই সবচেয়ে অগ্রসর আর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ছবি। সোলানাস আর গেটিনো থার্ড সিনেমাকে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে বর্ণনা করে এই ধরনের চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ক্যামেরাকে রূপক অর্থে তুলনা করেছেন বন্দুকের সাথে যে অস্ত্র প্রতি সেকেন্ডে ২৪টি ফ্রেম ছুড়তে পারে।
উপরোক্ত বিভিন্ন ধারণা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে দেখা যায় রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হলো সেই ধরনের চলচ্চিত্র যা বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত ছবির আদর্শ আর মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করে নির্মিত হয়, যে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু রাজনৈতিক সমস্যাভিত্তিক, ফর্ম অগতানুগতিক, এবং যে ধরনের চলচ্চিত্রে পরিচালক সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর তীব্র সমালোচনা উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শকের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন।
(চলবে)