বাংলাদেশের রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ২
পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্রে রাজনৈতিক অভিপ্রায়
তিন
বাংলাদেশে গত চার দশকে যে চলচ্চিত্রসমূহ মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির পদ্ধতি পরিহার করে তৈরি হয়েছে, সেই চলচ্চিত্রসমূহ সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন জরুরি এবং জটিল রাজনৈতিক সমস্যা সরাসরি তুলে ধরার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল এমন দাবি করা যায় না। খুব অল্পসংখ্যক বাংলাদেশি চলচ্চিত্রই তৈরি হয়েছে যেখানে বর্তমান সময়ের সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর জন্য যারা দায়ী তাদের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করা এবং তাদের কঠোর সমালোচনা তুলে ধরা ছিল চলচ্চিত্রকারদের মূল উদ্দেশ্য। যে অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে গতানুগতিকভাবে বিনোদনমূলক উপাদান গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র ভাষা ব্যবহারের এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেও প্রায়ই সমকালীন সময় সরাসরি তুলে ধরা হয়নি। সেখানে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে পরোক্ষভাবে, অতীতের কোনো সময় তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। যেমন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করলেও আলমগীর কবিরের রূপালী সৈকতে (১৯৭৯) ছবিটিতে কাহিনীর সময়কাল ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৭০-এর বাংলাদেশ নয়। মসিহ্উদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলী নির্মিত সূর্যদীঘল বাড়ি (১৯৮০) সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র মানুষের দুর্দশার বিবরণ আর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক সমালোচনা তুলে ধরলেও কাহিনীর পটভূমি ভারতভাগের ঠিক আগে পূর্ব বাংলার এক গ্রামের জীবনযাত্রা।
ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতাটির স্পষ্ট সমালোচনা উঠে এসেছে তারেক মাসুদের মাটির ময়নায়। ছবিটি যখন নির্মিত হয় তখন এই সমালোচনা প্রাসঙ্গিক হলেও ছবির কাহিনীতে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম এবং মফস্বল শহরের পরিবেশ। চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক রবার্ট স্ট্যাম উল্লেখ করেছেন তৃতীয় বিশ্বের অনেক চলচ্চিত্রেই অ্যালেগরি বা রূপকধর্মী কাহিনীতে অতীতের কোনো সমস্যাসংকুল সময় দেখানোর মাধ্যমে বর্তমান সময়ে টিকে থাকা একই ধরনের সমস্যার সমালোচনা তুলে ধরা হয়। উপরোক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ছবিকেই সেই ধরনের ছবি হিসেবে বর্ণনা করা যায়। তবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সত্তর দশকে তৈরি বিভিন্ন ছবিতে (যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো, দূরত্ব) সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যার যে তীব্র সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশে তৈরি চলচ্চিত্রে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তেমনভাবে মোকাবিলা করার সুযোগ পরিচালকরা পাননি।
পশ্চিম বাংলার সাম্প্রতিক ছবি শ্রীজিত মুখার্জির ২২শে শ্রাবণ (২০১১) ছবিতে একজন চরিত্রের মুখে শোনা যায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা : ‘ড. বিনায়ক সেনের মতো লোককে যারা যাবজ্জীবন দেয়, তাদের কাছ থেকে আর কি আশা করতে পারি? একটা পচে-যাওয়া সিস্টেম।’ সেই চরিত্র আবার বলে ওঠে : ‘আমাদের দেশের আশি ভাগ মানুষের কাছে গণতন্ত্র মানে শুধুই ভোটাধিকার। বাকি অধিকারগুলো আপনাদের পকেটে।’ বাংলাদেশের সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্রে বর্তমান সময় নিয়ে এই ধরনের সরাসরি এবং তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য আমরা খুব কমই দেখতে পেয়েছি। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং ধর্মীয় অন্ধত্ব বাংলাদেশের একটি টিকে থাকা সমস্যা। ধর্ম নিয়ে কোনো বক্তব্য প্রদান করাও অনেক সময়ই সহজ নয়, কারণ তা স্পর্শকাতর একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত। তারপরও তারেক মাসুদের মাটির ময়না বিভিন্ন দৃশ্যে ধর্ম নিয়ে অযৌক্তিক অনুশাসন, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে মতপ্রকাশ করেছে। ‘এ দেশে ইসলাম তলোয়ার দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি,’ ‘পাকিস্তান কি ইসলাম কায়েম করেছে, নাকি মিলিটারি শাসন কায়েম করেছে?’ ‘প্রকৃত কোনো ধর্মই মানুষকে অন্ধ করে না, বরং তার চক্ষুটা খুলে দেয়’ এই ধরনের বক্তব্য চরিত্রদের কথোপকথনের সময় উপস্থাপনের মাধ্যমে পরিচালক বাংলাদেশের টিকে থাকা একটি সমস্যার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সাহসের সাথে স্পষ্ট করেছেন।
মাটির ময়না শুরুতে প্রদর্শনের জন্য সরকারি বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। ধর্মচর্চার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান ছবিতে ছিল না, পরিচালক কেবল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আর ধর্মীয় অন্ধচিন্তার সমালোচনা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ছবিটি যখন শুরুতে প্রদর্শনের অনুমতি পায়নি, ধরে নেওয়া যায় ছবিটির বিষয়বস্তু বিদ্যমান সিস্টেমকে অস্বস্তির সম্মুখীন করেছিল, যেমন ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’র বিষয়বস্তুর কারণে চিন্তিত হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন। সচেতনভাবে সাহসী বক্তব্য তুলে ধরার কারণে ‘জীবন থেকে নেয়া’ আর মাটির ময়না থার্ড সিনেমার বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে। তবে আমাদের দেশে এই ধরনের ছবি খুব কমই তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে তারেক মাসুদের রানওয়ে (২০১১) আর আবু সাইদের অপেক্ষা (২০১১) বর্তমান সময়ের পটভূমিতে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার সমালোচনা তুলে ধরেছে।
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক দুই বছর পর তৈরি আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩) বর্তমান সময়ের বিভিন্ন অনিশ্চিত দিকের মুখোমুখি হয়েছিল। যুদ্ধের ঠিক পরই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তৈরি হওয়া হতাশা যেমন উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধা থেকে হাইজ্যাকারে পরিণত হওয়া তরুণের মনে সৎ ও সঠিক চিন্তা ফিরে আসার মধ্য দিয়ে তিনি দর্শকদের বোধকে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ক্ষুদ্র বাংলাদেশ সবসময় বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের প্রভাবে থাকবে কি না, তা নিয়ে একটি দৃশ্যে দুই চরিত্রের কথোপকথনে পরিচালক নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন : ‘বাংলাদেশকে চিরকাল দুর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়ে থাকতে হবে যদি বাঙালি তার স্বকীয়তা রাখতে না জানে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ সত্যিকারের জয়ের পথে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এর পরের লক্ষ্য একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা।’ রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে এক্সপ্লিসিট টিচিং মেথড নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যখন কোনো চরিত্র দর্শকের উদ্দেশ্যে সরাসরি কথা বলেন, অথবা দুজন চরিত্রের কথোপকথন দেখানো হয় কিন্তু মূলত দর্শককে লক্ষ্য করেই বক্তব্যগুলো উপস্থাপিত হয়। নিজের ছবিতে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য আলমগীর কবির প্রায়ই এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।
চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও আলমগীর কবিরের ছবিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। নিজের ছবিতে তিনি ব্যবহার করেছেন ডকুমেন্টারি দৃশ্য, অ্যানিমেশন, স্থির চিত্র এবং অন্য চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের দৃশ্য যে নির্দিষ্ট পদ্ধতিটির প্রয়োগ তাঁর ছবিকে সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ করে তুলেছে। বিভিন্ন ইউরোপিয়ান আর্ট ছবিতে চলচ্চিত্রের কাল্পনিক জগতে দর্শকের অলসভাবে মোহাবিষ্ট হওয়া বাধাগ্রস্ত করে ছবি দেখার সময় দর্শকের সক্রিয়তা টিকিয়ে রাখার জন্য ছবি সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ করে তোলা হয়। রাজনৈতিক ছবিতে এমন কৌশল তাই সচেতনভাবেই পরিচালকরা ব্যবহার করেন। আলমগীর কবিরের ছবি তাই বক্তব্য ও নির্মাণশৈলী দুই দিক দিয়েই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক। সৈয়দ সালাহ্উদ্দীন জাকীর ‘ঘুড্ডি’ (১৯৮০) নান্দনিক নির্মাণশৈলী, রাজনৈতিক সমালোচনা, অভিনয় এবং কাহিনীর অগতানুগতিকতা, বক্তব্যের গভীরতা বিভিন্ন বিচারেই ছিল সমসাময়িক বাংলাদেশি ছবি থেকে ভিন্ন। ঘুড্ডিতে বিভিন্ন সমালোচনা প্রকাশের জন্য যেমন ঝাঁঝাল এবং বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে, তাও ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন। ছবিটিতে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রসঙ্গের ক্রমাগত উপস্থাপন দর্শককে বারবার মুখোমুখি করে আকস্মিকতার, যে ঝাঁকুনি বাধাগ্রস্ত করে চলচ্চিত্রের কল্পিত কাহিনীর বিভ্রমকে। পরিচালকের এই কৌশলগুলো তাই হয়ে ওঠে মার্কসবাদী নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখ্ট্ প্রবর্তিত ‘ডিসট্যানসিয়েশন’ কৌশলের অনুরূপ। পরিচালক ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করেন বিভিন্ন দৃশ্য যা দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে পরিচালকের পর্যবেক্ষণ আর সমালোচনা তুলে ধরে। ইন্টারনাল মনোলোগের মাধ্যমে একটি দৃশ্যে আমরা শুনতে পাই ছবির প্রোটাগোনিস্ট আসাদের ভাবনা : ‘আমি আসলে খুঁজছি। একাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে খেতাব, প্রতাপ আর ইনডেন্টিংয়ের দরদালানের ভেতর। কি? আমিও তো যুদ্ধ করেছিলাম। এখন মুক্ত?’ বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্তের বিভিন্ন হতাশা তুলে ধরা হয়েছিল শেখ নিয়ামত আলির দহন (১৯৮৫) ছবিতে। আকর্ষণীয় চলচ্চিত্র ভাষাও ছবির বিভিন্ন অংশে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সমাজে সাধারণ মানুষের সমস্যা আর হতাশা টিকে থাকার মূল কারণগুলো হয়তো ছবিতে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ ছিল।
এ ছাড়া বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে ইতিহাসভিত্তিক ছবি, কিন্তু এই ছবিগুলো সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়নি এবং এমন অনেক ছবির নির্মাণশৈলীও নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী করে তোলা হয়নি। ফলে কার্যকর রাজনৈতিক ছবি হিসেবে এই ছবিগুলোকে বর্ণনা করা যায় না। কখনো বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার কাহিনী কিছুটা অগতানুগতিক চলচ্চিত্র ভাষা ব্যবহার করে তুলে ধরার মাধ্যমে পরিচালকরা তাদের কাজ বিনোদনধর্মী ছবি থেকে পৃথক করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এমন অনেক ছবিতেই বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশের সাথে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীরতার সাথে বিশ্লেষণ করা হয়নি। ফলে ছবিতে উপস্থাপিত ভাগ্যহীন অসহায় মানুষরা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছেন। এই ধরনের ছবিতে কখনো সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে গ্রামের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি, কখনো কোনো গ্রাম্য ওঝা বা কোনো মাস্তান। কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা টিকে থাকার জন্য সত্যিকার অর্থে ক্ষমতাশালী যে মানুষরা দায়ী তাদের দিকে পরিচালকরা অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারেননি। যে ধরনের রাজনৈতিক কারসাজির কারণে দারিদ্র্য, শোষণ, অন্ধ বিশ্বাস, দুর্বলের ওপর অত্যাচার সমাজে টিকে থাকছে তা উন্মোচন করার কোনো চেষ্টাও এই ধরনের ছবিতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে কেবল কোনো সমস্যা উপস্থাপন করাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সমস্যার আসল কারণগুলোর গভীর বিশ্লেষণ যা দর্শকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং টিকে থাকা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদী ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় করে তুলবে।
দর্শকদের রাজনৈতিক বোধ উদ্দীপিত করা এবং তাদের প্রতিবাদী করে তোলা যেহেতু রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য তাই রাজনৈতিক ছবির নির্মাণশৈলী অবশ্যই গতানুগতিকতামুক্ত এবং নান্দনিক দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী করে তোলা প্রয়োজন। আমাদের দেশে নির্মিত অনেক সামাজিক সমস্যাভিত্তিক ছবির ন্যারেটিভ অগতানুগতিক করার কোনো চেষ্টা আমাদের চোখে পড়েনি। দেখা যায় এসব ছবিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনী এগিয়ে যায় একরৈখিকভাবে এবং জটিল বিভিন্ন চলচ্চিত্র কৌশল কার্যকরভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ নির্মাণের চেষ্টাও সেখানে নেই। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী কেমন হবে তা কখনোই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে দর্শকের আবেগ স্পর্শ করাই মূল উদ্দেশ্য নয়। উপস্থাপিত বিষয় সম্পর্কে দর্শক যেন সক্রিয়ভাবে চিন্তা করতে পারে রাজনৈতিক ছবি তা নিশ্চিত করতে প্রয়াসী। ফলে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের ভাষা চিন্তাসমৃদ্ধ এবং গতানুগতিকতামুক্ত হওয়া জরুরি। কোনো ছবিতে গতানুগতিক চলচ্চিত্র ভাষা ব্যবহার এবং কখনো বিনোদন প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের বিদ্যমান কোনো সমস্যা তুলে ধরলে সেই ছবি প্রকৃত অর্থে সমাজসচেতন ও রাজনৈতিক হবে না। কারণ গতানুগতিক কায়দায় রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করা হলে তা দর্শকদের কখনোই অস্থির বা উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারবে না। ফলস্বরূপ ব্যর্থ হবে দর্শককে প্রতিবাদী করে তোলার প্রয়াস।
সত্যজিৎ রায়ের বহুল আলোচিত হীরক রাজার দেশে (১৯৮০) ছবিটির কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এই ছবিতে সত্যজিৎ স্যাটায়ারের মাধ্যমে দেশের শাসকদের আচরণের অসঙ্গতি আর সমাজে টিকে থাকা অন্যায় তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। কেউ বলতে পারেন হাস্যরস, সঙ্গীত, ফ্যান্টাসি প্রভৃতি উপাদান ব্যবহারের কারণে হীরক রাজার দেশে তো দর্শককে যথেষ্ট আমোদিতও করে। কিন্তু লক্ষ করতে হবে জনপ্রিয় ছবির এই উপাদানগুলো সত্যজিৎ গতানুগতিকভাবে ব্যবহার করেননি। ছবির বিভিন্ন সংলাপে হাস্যরস থাকলেও বুদ্ধিদীপ্ত ছন্দ সৃষ্টির মাধ্যমে সেই সংলাপ করে তোলা হয় অগতানুগতিক। নিজের দরবারে হতদরিদ্র কৃষক, শ্রমিক আর গ্রামের গায়কের প্রতি হীরকের রাজার নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ, রাজার আদেশে পেয়াদা নিয়ে গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষামন্ত্রীর আগমন এবং জোর করে পাঠশালা বন্ধ করে দেওয়া, ছাত্রদের সামনে অসহায় শিক্ষকের ব্যথাতুর মুখ, শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকের সব বই পুড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি দৃশ্য এবং বিভিন্ন সংলাপ দর্শক-মনে তীব্র অস্বস্তিও সৃষ্টি করে। গুপী-বাঘার গানও হালকা বিনোদন জোগায় না, বরং সেখানে আমরা শুনি পরিচালকের রাজনৈতিক বক্তব্য। হাস্যরসের মাধ্যমেই শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় অত্যাচারী রাজার পতন। রাজনৈতিক সমালোচনা তুলে ধরাই হয়ে ওঠে ছবির মূল লক্ষ্য, আর এই উদ্দেশ্য পূরণে পরিচালক বিনোদনমূলক উপাদান ছবিতে ব্যবহার করেন সম্পূর্ণ অগতানুগতিকভাবে।
চার
শিল্পকলার যেকোনো শাখায় উপস্থাপিত রাজনৈতিক বক্তব্য দর্শকের চিন্তাকে প্রখর করে তোলে, আর এই প্রখরতা সৃষ্টি করে আত্মবিশ্লেষণের আগ্রহ। সমস্যাসংকুল সময়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা মানুষের যে নির্বিকারত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের সমাজ বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপিত প্রশ্ন মানুষের সেই নির্বিকারত্ব বা স্বস্তিকে আঘাত করে। এমন আঘাতের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় যে অপরাধবোধ বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রবণতা সেই মানসিক অনুভূতিটি অবশ্যই বৈপ্লবিক। বাংলাদেশের সমাজ সমস্যাবিহীন নয়, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এখানে টিকে আছে। এই সমস্যাগুলোর আসল কারণ এবং ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা সমাজের মঙ্গলের জন্যই জরুরি। আমাদের চলচ্চিত্র কেবল বিনোদনভিত্তিক হবে, মানুষকে সামাজিকভাবে সচেতন করার জন্য আমাদের চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই এ কথা আমরা বলতে পারি না। সে ক্ষেত্রে কেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বর্তমান সময়ের জরুরি ও গুরুতর সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার প্রচেষ্টা খুব কমই চোখে পড়ে এই প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করা দরকার। পাকিস্তানি শাসনের দমনমূলক এবং বৈষম্য টিকিয়ে রাখা বিভিন্ন দিকের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেই বাঙালিরা প্রতিবাদী হয়েছিল— যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দ্রুতই পুরনো পাকিস্তানি ব্যবস্থার মতো ফিরে আসে সামরিক শাসন। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজে বিভিন্ন পুরনো সমস্যা টিকে থাকা নির্দেশ করে নতুন সমাজেও মানুষের চিন্তার মুক্তি পরিপূর্ণভাবে ঘটেনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা তাই এই সমাজে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
সমকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা এবং মানুষকে পীড়িত করছে এমন সমস্যার যৌক্তিক সমালোচনা চলচ্চিত্রে প্রকাশের চেষ্টাকে সমর্থন করার পরিবেশ তৈরি না হলে সমাজ-সচেতন, বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র আমাদের দেশে তৈরি হবে না। সেন্সরের কারণে রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া এবং সমকালীন সমস্যার সমালোচনা প্রদান করা সম্ভব নয়— এমন আশঙ্কা চিন্তাশীল এবং রাজনৈতিক ছবি নির্মাণে আগ্রহী চলচ্চিত্রকারদের কাজকে বাধাগ্রস্ত করবে। রাজনীতি-মনস্ক পরিচালকদের প্রতিবাদী ছবি তৈরির সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে আবারও উল্লেখ করা যায় পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রের কথা। সত্তরের দশকের শুরুতে পশ্চিম বাংলায় বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নকশালবাদী আন্দোলন চলার সময় মৃণাল সেন তাঁর কলকাতা ত্রয়ীর ছবিগুলোতে শ্রেণিবিভক্ত, শোষণমূলক সমাজ কাঠামোর তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেছিলেন। নকশালপন্থী তরুণদের নির্বিচারে হত্যা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তিনি সেই সময় নিজ চলচ্চিত্রে প্রকাশ করেছিলেন সাহসিকতার সাথে। তখন নকশালপন্থী আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল, কিন্তু মৃণাল সেনের এই রাজনৈতিক চলচ্চিত্রগুলোর সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন সচেতন চলচ্চিত্রকার নিজের কাজে সমাজের কোনো সমস্যার বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে বক্তব্য এবং প্রতিবাদ প্রকাশের সুযোগ পাবেন— সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকারদের জন্য এমন সুযোগ কি গত চার দশকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? সমাজসচেতন চিন্তাশীল চলচ্চিত্র প্রয়োজনীয় বিবেচনা করে এই ধরনের ছবি নির্মাণের জন্য চলচ্চিত্রকারদের কতটা উৎসাহিতই বা করা হয়েছে? উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান সময়ের জরুরি সমস্যা নিয়ে চিন্তাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক ছবি আমাদের দেশে হয়তো নিয়মিতভাবেই নির্মিত হতো।
আর এমন ছবি নির্মাণের অনুকূল পরিবেশ যদি নাই পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে কীভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা যায় রূপকধর্মী ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণের মাধ্যমে জহির রায়হান বহু বছর আগেই তা স্পষ্ট করেছেন। সেই উদাহরণ বর্তমান সময়ের রাজনীতি-মনস্ক পরিচালকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে এমনটাই স্বাভাবিক। সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে— এমন চলচ্চিত্র নির্মাণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের যথেষ্ট আগ্রহও থাকা দরকার। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের নবীন চলচ্চিত্রকাররা সমাজ ও রাজনীতিসচেতন বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মাণে কতটা আন্তরিকতার সাথে সচেষ্ট হবেন তার ওপরই এই ধরনের ছবির সাফল্য ও প্রসার নির্ভর করবে।
(শেষ)