আদিবাসী পুরাণ
চন্দ্র, সূর্য আর টিয়ার গল্প
চন্দ্র ও সূর্য। ওরাওঁ ভাষায় বিড়ি নাদ ও চান্দু নাদ। কীভাবে সৃষ্টি হলো এ দুটি? এমনটাই ছিল প্রশ্ন। উত্তরে দিনাজপুর কালিয়াগঞ্জের ওরাওঁ গ্রামের নিপেন টিগ্গা গল্পের মতো করে বললেন কাহিনীটি-
‘পৃথিবী সৃষ্টি করল ধরমেশ। তখন আকাশ ও মাটি ছিল খুবই কাছাকাছি। মানুষ চলাফেরা করার সময়ই আকাশ ঠেকত মাথায়। একবার মানুষের কোনো এক অপরাধে ধরমেশ বেশ বিরক্ত হলেন।
ধরমেশের নির্দেশে আকাশ অনেক ওপরে উঠে গেল। এতে চলাফেরায় মানুষের সুবিধা হলো বটে কিন্তু চারপাশ হলো অন্ধকার।
বনের মধ্যে ছিল এক মহুয়া গাছ। সে গাছে ফুল যতক্ষণ ফুটে থাকত, ততক্ষণ পৃথিবী আলোকিত থাকত। আর যখন ফুল শুকিয়ে যেত, তখন আবার অন্ধকার নেমে আসত।
সবাই ভাবল, গাছটিই অন্ধকারের মূল কারণ। আলো উদ্ধারের জন্য কাটা হোক গাছটিকে- সবাই মিলে এমন সিদ্ধান্ত নিল।
একদিন গাছটিকে কাটা হলো। কিন্তু অবাক কাণ্ড! তারপরও সেটি মাটিতে পড়ছে না। এ নিয়ে সবাই চিন্তিত। এমন সময় দৈববাণী এলো। গাছটিতে রয়েছে একটি চিলের বাসা। সে চিলটিকে না মারলে গাছটি মাটিতে পড়বে না।
ঠিক তাই ঘটল। চিলটিকে মারার পর পরই গাছটি মাটিতে পড়ে গেল। পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল গোটা পৃথিবী।
সে দেশের রাজা এসব জানত না। গাছ পড়ার শব্দে তিনি ভাবলেন- শত্রুরা তার রাজ্য আক্রমণ করেছে। তিনি সৈন্য নিয়ে বনে এসে দেখলেন, বড় মহুয়া গাছটি মাটিতে পড়ে আছে। রাজা ক্ষিপ্ত হলেন।
হুঙ্কার ছাড়লেন- কারা গাছটি কাটল। তিনি সৈন্যদের আশপাশের মানুষকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। ফলে উভয় পক্ষে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সে যুদ্ধে রাজার সৈন্যরা হলো পরাজিত।
অতঃপর গাছটিকে দুই ভাগ করে কাটা হলো। নিচের দিকের বড় অংশটিতে দেখা মিলল সূর্যের আর ওপরের দিকের ছোট অংশটিতে চন্দ্র।
কিন্তু তাদের জীবন দান হবে কীভাবে?
আবারও দৈববাণী এলো। চাষির ছেলের রক্তে প্রাণ পাবে চন্দ্র আর সূর্য। তাই করা হলো। এক চাষির আদরের ছেলেকে চুরি করে এনে হত্যা করে তার রক্ত ঢেলে দেওয়া হলো গাছের কাটা অংশে। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্য জীবিত হয়ে আকাশে উঠে গেল।
সে থেকেই ওরাওঁদের কাছে সূর্য পুরুষ এবং সে বেশি রক্ত পান করেছিল বলে তেজি ও লাল। আর চন্দ্র মহিলা এবং সে কম রক্ত পান করেছিল। তাই চন্দ্র স্নিগ্ধ ও সাদা।’
একবার আমাদের পায়ের ছাপ পড়ে রংপুরের এক রাজবংশী গ্রামে। তাদের মুখে শুনি বিশ্বাসের নানা কথা। সাপের প্রসঙ্গ আসতেই রাজবংশীরা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- ‘ঢোঁড়া সাপের বিষ নাই কেন? উত্তর না মিলতেই একটি কাহিনীর শুরু-
মা-মনসা একদিন সকল সর্পকুলকে ডেকে বিষ প্রদান করলেন। সে সময় তিনি লক্ষ্মীন্দরকে কামড়ানোর নির্দেশ দিলেন ঢোঁড়া সাপকে। এ কারণে তাকে সবার চেয়ে বেশি বিষও দেওয়া হলো। বিষ পেয়ে লক্ষ্মীন্দরকে কামড়াতে ঢোঁড়া সাপ যাত্রা শুরু করল। পথিমধ্যে পরল গঙ্গা। এই গঙ্গা পার হতে হবে। গঙ্গায় ছিল অনেক মাছ। মাছ খাওয়ার লোভ সামলাতে পারল না ঢোঁড়া সাপ। সে কচুপাতায় বিষ রেখে মাছ খেতে খেতে গঙ্গা পার হতে থাকল। এদিকে কচু পাতায় রাখা বিষ পিঁপড়ে, শিংমাছ, টেংরামাছ, কাঁকড়া খেয়ে সাবার করল। ঢোঁড়া সাপ ফিরে এসে দেখে, কচুপাতায় বিষ নেই। বিষ হারিয়ে সেই থেকে ঢোঁড়া সাপ বিষহীন সাপ। তার এই লোভের কর্মে মনসাদেবী হন মনঃক্ষুণ। মনসা অভিশাপ দেন, ‘এখন থেকে সমস্ত লোক তোকে পায়ে মাড়াবে।’ সেই থেকে তাই ঘটে আসছে। ঢোঁড়া সাপের বিষ খেয়েছিল বলেই পিঁপড়ে, শিংমাছ, টেংরামাছ, কাঁকড়া ইত্যাদির কাটায় আজও বিষ রয়েছে।
আবার সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত রয়েছে, উশার সওদাগরের উপাখ্যান। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর গনেশ মার্ডির জবানিতে শোনা উপাখ্যানটি-
পিলচু বুড়া ও পিলচু বুড়ির ছেলেমেয়েদের একবার খাওয়াদাওয়ায় খুব অভাব দেখা দেয়। তারা তখন মহাজনের খোঁজ করতে থাকল। কিন্তু ওই এলাকায় ছিল না কোনো মহাজন। পিলচু বুড়া ও পিলচু বুড়ি গেল দেবতা মারাংবুরুর কাছে। তিনি বললেন, ‘দরিয়ার ওপারে আছে এক মহাজন। নাম তার উশার সওদাগর।’
উশার সওদাগরের ছিল শত শত শূকর। শূকর পালন ও তা দিয়ে চাষাবাস করতেন তিনি। তাঁর সম্পদশালী হওয়ার মূলে ছিল একটি টিয়া পাখি। এটি উশার সওদাগরের টিয়া মোক্তার। তিনি তাঁর নাম দেন ‘ভজো গোবিন্দ গোপাল’।
যখন রাত নামত, স্বর্গপুরীতে বসত দেবতাদের আসর। তাঁদের আসরে নানা বিষয়ে চলত পরামর্শ। সে সময় উশার সওদাগর টিয়া মোক্তারকে পাঠিয়ে দিতেন স্বর্গপুরীতে। দেবতারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন কখন কোনদিক থেকে বৃষ্টিপাত করা হবে। টিয়া মোক্তার সে খবর শুনে এসে জানিয়ে দিতেন সওদাগরকে। সে বছর তিনি সেদিকে গিয়েই চাষবাস করতেন। এভাবে চাষবাস করে দিনে দিনে তিনি খুব ধনী হয়ে গেলেন।
একবার টিয়া মোক্তারকে স্বর্গপুরীতে পাঠিয়ে সওদাগর গেলেন দূর দেশে। রাতে বসে দেবতাদের বিচারসভা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ‘এ বছর যেসব চাষি আখের চাষ করছে, তারা যদি সেই আখ কেটে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়, তবে সেই ধোঁয়া খেতে স্বর্গপুরী থেকে অনেক শারোখ পাখি নেমে আসবে। সেই পাখিগুলোর মল জমিয়ে ডিরমিতে ভরে রাখলে তা সোনা হয়ে যাবে।’ দেবতাদের এমন সিদ্ধান্ত শুনে টিয়া মোক্তার ফিরে এলেন। কিন্তু তখনো ফেরেননি উশার সওদাগর।
সওদাগরের ছিল অনেক আখক্ষেত। সে বছর ফসলও খুব ভালো হয়েছিল। সওদাগরের দেরি দেখে টিয়া মোক্তার নিজেই দেবতাদের সিদ্ধান্তমতো কাজ শুরু করে। কিষান ও বাগালদের ডেকে বলে, ‘যাও, তোমরা খামার তৈরি করো। কাল থেকে সব আখ কাটতে হবে।’ সবাই তাই করল। একদিন পর টিয়া মোক্তার নির্দেশ করল, সব আখ কেটে খামারে জমা করার। আখ কেটে জমা করা হলো। টিয়া মোক্তার তখন বলল, ‘তাতে আগুল লাগিয়ে দাও।’ তারা তাই করল। বারো দিন বারো রাত ধরে সে আখ পুড়তে লাগল। আখের ধোঁয়া খেতে সে সময় স্বর্গপুরী থেকে নেমে এলো শত শত শারোখ পাখি।
কয়েকদিন ধরে থাকল তারা। পাখিগুলো যে মল ত্যাগ করল, টিয়া মোক্তারের নির্দেশে কিষানরা তা এক জায়গায় জড়ো করে একটি ডিরমিতে ভরে রাখল।
কয়েকদিন পর ঘরে ফিরলেন উশার সওদাগর। আখক্ষেত শূন্য পেয়ে তিনি ডাকলেন কিষানদের। কিষানরা বলল, ‘তোমার টিয়া মোক্তার সব আখ কাটিয়েছে। কাটা আখ বারো দিন বারো রাত আগুনে পুড়েছে। পোড়া আখের ধোঁয়া খেতে স্বর্গ থেকে নেমে আসে শারোখ পাখি। টিয়া মোক্তারের নির্দেশে সে পাখির পায়খানাগুলো জড়ো করে ডিরমিতে ভরে রাখা হয়েছে। ওই যে সেই ডিরমি।’
সওদাগর হুঁকো টানছিলেন। কিষানদের কথা শুনে তিনি টিয়া মোক্তারের ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। অতঃপর হুঁকোর নলচের আঘাতে সওদাগরের হাতেই মৃত্যু হয় টিয়া মোক্তারের।
টিয়া মোক্তারের মৃত্যুর পর উশার সওদাগর গেলেন ডিরমির সামনে। তার ঢাকনাটা খুলে ভেতরে তাকাতেই তিনি দেখলেন পাখিগুলোর সব মল সোনা হয়ে গেছে। সোনার আলোয় আলোকিত হলো চারপাশ। সওদাগর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। উপকারী টিয়া মোক্তারের জন্য তিনি বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকলেন।
আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে, এ রকম অগণিত রূপকথা, উপকথা ও পুরাকথা। যুগে যুগে যা মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং আছে। আদিবাসী বিশ্বাসের সেই গদ্য ও উপকথাগুলোই সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যময় করেছে আদিবাসী সংস্কৃতিটাকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক