স্মরণ
সাম্যের কবি নজরুল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের (১৯৯-১৯৭৬) উজ্জ্বল আবির্ভাব। বস্তুত, তাঁর শিল্পীমানসের শিকড় প্রোথিত ছিল নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসমৃত্তিকায়। রাজনীতি-সচেতনতা ও জনমূল-সংলগ্নতা নজরুলের শিল্পীচৈতন্যে এনেছিল নতুন মাত্রা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা-আন্দোলন এবং নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-সম্ভাবনা নজরুলের কবিমানসকে করে তুলেছিল আলোক উদ্ভাসিত। তাই রোমান্টিক অনুভববেদ্যতায় তিনি বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক সমাজের পরিবর্তে কল্পনা করেছেন শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ; অসত্য-অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের সূর্যসম্ভব বাণী।
কাজী নজরুল ইসলাম মূলত রোমান্টিক কবি। তাঁর শিল্পীসত্তার মূল প্রেরণাশক্তি রোমান্টিকতা। রোমান্টিকতার অন্তপ্রেরণায় তিনি কখনো উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী, কখনো বা গেয়েছেন সাম্যের গান। ১৯২৫ সালে ‘সাম্যবাদী’ কাব্য প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ইসলাম সাম্যের কবি হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর ‘সর্বহারা’ (১৯২৬) কাব্যেও সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটে। এ দুই কাব্যে নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে, তা দর্শন-পরিশ্রুত নয়, বরং একান্তই রোমান্টিক মানসপ্রবণতাজাত। ফলে বিদ্রোহের মতো নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তাও মূলত আবেগ আর উচ্ছ্বাসের প্রকাশ। নজরুলের সাম্যবাদ প্রধানত তাঁর নিজস্ব ভাবনাজাত-মানবতাবাদই যার মৌল ভিত্তি। মানুষের মুক্তি, নর-নারীর বৈষম্যমোচন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের উন্নতি, স্বদেশের স্বাধীনতা। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, বিদ্রোহের জন্য মানুষের প্রতিই ছিল তাঁর উদাত্ত আহ্বান। তিনি কল্পনা করেছে এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ—‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, / যেখানে মিলিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান/ গাহি সাম্যের গান ! / কে তুমি? পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো? / কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে’ যাও, বল আরো। /... মিথ্যা শুনিনি ভাই,/ এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।’ নজরুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে কোনো কিছু বড় কিংবা মহৎ হতে পারে না। তাই মানুষকেই তিনি নিবেদন করেন তাঁর সকল শ্রদ্ধা, সকল ভক্তি ও ভালোবাসা।
মানুষকেই তিনি সর্বদেশ সর্বযুগ সর্বকালের পরম-জ্ঞাতি হিসেবে মেনেছেন এবং জেনেছেন। এ-প্রসঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণ—
গাহি সাম্যের গান—
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
কবি মানবতার জয়গানে আজীবন ছিলেন মুখর। মানুষকে ঘৃণা করা বা ছোট ভাবা নজরুল অন্যায় বলে মনে করতেন। তাঁর সাম্যবাদে মানুষে-মানুষে কোনো ভেদ নেই, তাই তিনি স্বীকার করেননি কিংবা মেনে নেননি রাজায়-প্রজায় ভেদ। মানুষকে তিনি কেবল মানুষ হিসেবেই ভেবেছেন, অন্য কোনো পরিচয়ে নয়। তাই তিনি বলেন—
গাম্যের গান গাই—
যেখানে আসিয়া সম-বেদনায় সকলে হয়েছি ভাই।
এ প্রশ্ন অতি সোজা,
এক ধরণীর সন্তান, কেন কেউ রাজা, কেউ প্রজা?
নজরুলের সাম্যবাদে পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রচিত হয় আত্মীয়তার মৈত্রী-বন্ধন। তাই পাপী-তাপী, ধনী-দরিদ্র, পতিতা-বারাঙ্গনা সকলেই কি ভেদাভেদ স্বীকার করেননি। নারী ও পুরুষকে তিনি সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছেন। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেন নাই।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, তিনি যে সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখেন, ঔপনিবেশিক সমাজে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি এই সমাজের পরিবর্তে একটি নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে মৌল আদর্শ হবে তাঁর সাম্যবাদ। তিনি বিশ্বাস করেন, শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠিত হলেই তাঁর সাম্যবাদ আলোর মুখ দেখবে। তাই তিনি শ্রমিক শ্রেণিকে সাম্যবাদ বিনির্মাণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন—
যত শ্রমিক শুষে নিঙড়ে প্রজা
রাজা-উজির মারছে মজা,
এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নজরুলের সাম্যবাদ একান্তই হৃদয়লদ্ধ বিষয়। দর্শন, তত্ত্ব আর মননশীলতার পরিবর্তে নজরুলের সাম্যবাদে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে বাঁধভাঙা আবেগ আর উচ্ছ্বাস। তবু নজরুলের কবিতায় যে সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে, সেখানে, তাঁর সমাজ-সচেতনতা এবং সুষম প্রতিষ্ঠার আত্যন্তিক আকাঙ্ক্ষা স্বতঃই প্রকাশিত। তাঁর এই সাম্যবাদী ভাবনা বাংলা কবিতার ইতিহাসে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে, সন্দেহ নেই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়