কবিতা
কবির বর্ষা দর্শন
খুব সকালের বৃষ্টি
নির্মলেন্দু গুণ
পিতৃনাম ভুল হতে পারে—
ভুলে যেতে পারি প্রিয় প্রেমিকার নাম,
কিন্তু ডা. বরেণের দেওয়া প্রেসক্রিপশন
ইষ্টনামের চেয়ে বেশি সযতনে
জপ করি প্রভাত, দুপুরে, রাতে
প্রতিদিন দিনে তিনবেলা।
আমি জানালাটা খুলে দিয়ে আকাশে তাকাই।
তখন হঠাৎ আমার দৃষ্টি ও শ্রবণে হানা দেয়
মধ্য আষাঢ়ের রিমঝিম বৃষ্টি, জলধারা...
বুঝি আমার মতোই ভালো ঘুম
হয়নি বেচারির, এই তপ্ত পৃথিবীকে
জলদানে তৃপ্ত করেছ সে, রাত জেগে।
দেখে খুব মায়া হলো আমার।
বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম—
নিজের প্রতি অযত্ন করো না সোনা,
ডাক্তারের কথামতো প্রতিটি ওষুধ,
তুমি নিয়মিত ঘড়ি দেখে খাবে।
তোমার আকাশ ভাঙার কষ্ট আমি বুঝি।
বৃষ্টি
রেজাউদ্দিন স্টালিন
বৃষ্টি কি খুব অন্ধ নাকি সংজ্ঞাহীন
ঘরহীন সব মানুষগুলোর কী দুর্দিন
হঠাৎ করে উত্তরীয় উড়িয়ে তার
দশদিগন্তে কাঁসর বাজে ধুন্ধুমার
মেঘবিমানের লক্ষ্য শুধু বজ্রপাত
দ্বৈরথে কার মৃত্যু হবে—রক্তপাত
ভাসিয়ে নেবে উপত্যকা ফসল মাঠ
পাঠশালাতে তলিয়ে যাবে শিশুর পাঠ
আনন্দে কেউ শুনতে পারে টপ্পাগান
কিন্তু যাদের উপার্জনে পড়বে টান
চোখের জল আর বৃষ্টি তখন সমার্থক
কাকভেজা ঐ রিকশা এবং ভ্যানচালক
তাদের কথা ভাবতো যদি শ্রাবণ মাস
রামধনুটা রাখতো বুকে নীল-আকাশ
সব মানুষের জন্য হতো আনন্দের
জগৎব্যাপী বাসত ভালো বৃষ্টিদের
বরষার কবিতা
শামসেত তাবরেজী
বিন্দুমাত্র ভরসা নাইরে বেহুদা বরষা নামে,
এর-ওর খায় যেখানে যা পায় ডানে কিংবা বামে।
পথঘাট বটে পিচ্ছিল আর কর্দম ছোড়াছুড়ি,
মেঘে-মেঘে ঘুরে বেড়ায় কবিরা—ফোটে নাই আজো কুঁড়ি!
তবু কি আওয়াজ গুটিমুকুলের ভীতুস্যেরাও হাসে,
হায় রে বরষা ভরসাবিহীন—গলা ধরে প্রভু-দাসে
চিল্লায় আর যা-মনে আসে ব’লে যায় অবিরত,
কদম্ব-হ্লাদ গড়াগড়ি খেয়ে বাচ্চা বানায় তত!
ফরসা বরষা রোদ-ঝিকমিক ভ্যাপসা তাপিত দিন,
কবিতায় বটে বৃষ্টি নামছে সপ্তাহে সাত দিন!
বৃষ্টি, আজ কেন হবে লাশ?
সাখাওয়াত টিপু
কে তুমি কোমল জল, বলো : বরফের কলা
বৃষ্টি যেন বিঁধে আছে মিকাইল, গাঙুরের ফলা
না উত্তুরে, বহুদূরে এখন কেবল গাইবে বাতাস
লাল হয়ে ইতিহাসে ভেসে যাবে মানুষের লাশ!
আজ ঝড়ে বর্ণ মুছে যায়, কে তুমি সুসুপ্ত চোরাটান
খোলা মুনাফার মতো ঝরে ঝরে যাও, কি একাকী প্রাণ!
না হয় চিনব পরে, ওহে ক্লায়োকেশি ওহে বজ্রপাত
এমন সন্দিগ্ধ চোখে খেলে কোন বাণিজ্য সম্পাত?
যত দূরে যাও, উড়ে উড়ে ছিন্ন ছিন্ন গোপন কণায়
প্রাণ আর ভূমি ছাড়া তুমি রোজ গড়াবে কোথায়?
কেন তুমি লণ্ডভণ্ড? আলোর স্ফটিক নাকি মিকাইল
একবার বলো তুমি : বস্তুর ভেতর আলেখ্য নিখিল!
বৃষ্টি যদি লাল হয়, তবে উল্টে যায় দিন আর ফাঁদ
কালো ছাতাটিকে দেখলেই মনে হয় দুনিয়ার ছাদ
পাতালে যাবার আগে, তুমি গাইলে কি গোপন গান
লাফায় শূন্য কি মহাশূন্যে তোমার বিমূর্ত সম্বিধান?
বৃষ্টিশাসিত বরষায়
কুমার চক্রবর্তী
মনে হয় আবরণহীন হই
জলে ও ছায়ায়, অন্তরীক্ষ বৃষ্টির নগর
এই মোহকাল, পরাজিত এবং গোপন
আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যায় ইচ্ছাপ্রত্যাশায়,
দেহ থেকে বের হওয়া শিকড়-বাকড়
জড়িয়ে রেখেছে এই অদৃশ্যতা গূঢ় অভীপ্সায়
যেন আমি ত্বকহীন হই
যেন আমি হই পরিচয়হীন
বৃষ্টিশাসিত বরষায়
বেলি আমার
বকুল আশরাফ
বেলি কি বৃষ্টির ফুল
রাত্রিতে ফোটে, কষ্টের ঠোঁটে?
বেলি কি সাদা-সময়ের গান
সবুজ পাতা মাঠে শুভ্র প্রাণ
বেলি কি জীবন; অভিমানী ভীষণ
ক্ষণজন্মা শরীর ঝরা পথে হাঁটে
বেলি কি—
কষ্টের ঠোঁটে, রাত্রিতে ফোটে?
বেলি কি জ্যোৎস্নার খোঁপা
পাপড়ি মেলা স্বপ্ন থোকা থোকা
হারিয়ে পাওয়া কুড়ানো হারানো ভুল
বেলি কি ক্লান্ত খোলা চুল
বেলি কি শোভা সুবর্ণ মাদকতা
মুহূর্তকাল নিস্তব্ধ নীরবতা
বেলি কি ভূতলে পাতা অপেক্ষার চাদর
হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত আদর
বেলি কি দুঃখ মাখা বর্ষাধোয়া দিন
বেলির কাছে আমার অনেক ঋণ।
তোমার কণ্ঠস্বর
সৈকত হাবিব
এক মন্দ্রিত মেঘ নেমে এলো শহরের প্রান্ত থেকে, যখন উদ্ভাসিত তোমার
কণ্ঠস্বর ভেসে এলো টেলিফোনে। এখন বর্ষা, আজও কালিদাসী মেঘ ভেসে
আসে দূর উজ্জয়িনী থেকে—শোনায় অলকার দূরসংগীত...
এই মেঘ, এই বিধবাশুভ্র মেঘ, আমার শূন্যতাকে নিয়ে যায় মহাশূন্যে।
আর তোমার কণ্ঠ স্পর্শ করে সেই শূন্য—শরীরময় তবু শরীরহীন।
টেলিফোন যেন মেঘ, মেঘের সিঁড়ি হয়ে ঢুকে যায় আমার গভীরে
আর শীত-উষ্ণ এক স্রোত বয়ে যায়।
তবু, সেই মেঘ-টেলিফোন আমি ভালোবাসি; ভালোবাসি এই দূরতম উষ্ণতা
তোমার কণ্ঠস্বর যেন বৃষ্টি, আমাদের মেঘবিরহের গান।
স্বপ্নকাল
সাবিনা ইয়াসমিন
জানি এই নদী
এই শঙ্কার স্রোত
নিঃসঙ্গ নোনা জলের প্রবাহ
বহুদূর যাবে।
আর আমি আমার তৃষ্ণাভর্তি ক্যানু নিয়ে
জোয়ারে জোয়ারে ভাসব
খুঁজে নেবো নোঙরবিহীন
মোহনার প্রসার।
জানি একদিন আষাঢ়ের জলের সাথে
পূর্ণিমা নামবে আমার পিপাসার ডোঙ্গায়
সেদিন চাঁদও শোকার্ত হবে
আঙুল ছোঁয়াবে আমার পবিত্র চিবুকে।
মানচিত্র
মিন্টু হক
আত্মভোলা বাবার হাতে জীর্ণশীর্ণ বড়কাগজে মানচিত্র দেখেছিলাম প্রথম।
সেই থেকে মানসপটে গেঁথে গিয়েছিল কচি বয়সেই। যত্রতত্র খুঁজে ফিরতাম
মানচিত্র। জমিদারবাড়ির খসেযাওয়া পলেস্তরায়, গোধূলিলগ্ন জলসিঁড়ির ক্যানভাসে,
দিগন্তের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে, মনছবির প্রভাবে কেবল রূপসীবাংলার মানচিত্রই দেখেছি।
পায়দল হাঁটছি, বাবার মুঠোয় ধরা কচি হাত, সরু-বাঁকা মেঠোপথ, খটখটে মাঠের বুক
চিরে মিশেছে গঞ্জের রাস্তায়। হঠাৎ আবিষ্কারের ঢঙে ঈষৎ চিৎকার আর অঙ্গুলি নির্দেশ
করে বললাম—বাবা দেখো, দেখো কত মানচিত্র! হতচকিত বাবা তামাটে মাটির বুকে
ফাটা ফাটা অজস্র দাগের দিকে চেয়ে শেষে আত্মস্থ হয়ে বলল, হুঁ, চল ব্যাটা।
মূর্ত স্মৃতিগুলো বিমূর্ত কোটরে ধাক্কার সঞ্চার করে আজও। আর নেমে আসে কবিতার পঙক্তিতে
পঙক্তিতে। চৌচির চৈত্রের ফাটা ফাটা মাটি, কাঁচা হাতে আঁকা কালো স্লেটে খণ্ড খণ্ড নতুন মানচিত্র।
সুনিপুণ কলাবতী পাতা তপ্তহাওয়া স্নিগ্ধ করে, মেটাত ত্বকের জ্বালা, দেখো ছন্দের ব্যঞ্জনপাখা।
সোমত্ত বয়সে জেনেছি সে বছরটা ছিল খরার। এ প্রকৃতির রুদ্ররূপ।
গ্রীষ্মের তাপদাহে মাটির বুক চিরে চৌচির যখন, নির্নিমিখ চেয়ে থাকা
ছাড়া কি-ই বা আছে করার। অবশেষে অমোঘ পরিক্রমায় স্বস্তি এল, নিসর্গে আর্দ্রতা
আর মাটির বুকে সোঁদাগন্ধ ভরাতে, এলো বরষা, এলো বরষা।
ভেসে ওঠে তামাটে মাটির হাসি, প্রকৃতির বরাভয় ভরষা। এলো বরষা, এলো বরষা।
দুই খণ্ড বর্ষা
রিঙকু অনিমিখ
এক.
আঁকাজোড়া মেঘ দেখলে এখন আর অপেক্ষা করি না
ছাতা রেখেই বেড়িয়ে পড়ি
ভেজা আর না-ভেজারা
রেললাইনের দুই পাড় দিয়ে হেঁটে যায়।
আশ্চর্য এই যে, তখন আর বৃষ্টিও হয় না
দুই.
বৃষ্টি ভালোবাসো বলে খাল কেটে
সমুদ্রকে ডেকে এনেছ বাড়িতে
আজ সারাটাক্ষণ
সে তোমার চোখে চোখে থাকে।
বর্ষা
গিরীশ গৈরিক
আমার মায়ের চোখে একটি রেলস্টেশন ঘুমিয়ে থাকে
মা। চোখ খুলে যেদিকে তাকায়—রেলগাড়িগুলো সেদিকে ধাবিত হয়
আবার সন্ধ্যা হলে পাখির মতো—মায়ের চক্ষুনীড়ে রেলগাড়িগুলো ফিরে আসে।
মা যখন কাঁদে—তখন রেলগাড়িগুলো বন্যায় ডুবে যায়।
গতবছর তো মা আমার বর্ষার আকাশ হলো
আর রেলগাড়িগুলো অবিরত ডুবে যেতে লাগল
অথচ! আমি মায়ের একমাত্র হাবাগোবা রেলগাড়ি
সন্ধ্যার চিত্রকল্প
আলীম হায়দার
চামচিকা চিল সব একাকার হয়ে গেছে
বর্ষার সন্ধ্যার আকাশে
আমার জানালা দিয়ে সব দেখা যায় না
দেখি নীল আকাশ ঢেকে গেছে সাদা মেঘে
মনে হয় ধরে ফেলি, হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলি
গায়ে মাখি সাদা নীল আদর।
জলছবির মতো আকাশটা ছোপ ছোপ হালকা নীল
আকাশের পড়ন্ত কোণে গোধূলি রং খেলা করে
আজানের ধ্বনিতে তাল কেটে যায়
নজরুলসংগীতের গাঢ় গভীর অনুভূতি
এগিয়ে যায় কবিতায় ব্রত চক্রবর্তী।
বিশগজ দূরের মেহগিনি বনে
কু-কি-চি-হি কিচির মিচির
বক শালিক চড়ুই চামচিকার ডানা ঝাপটানোর
পটপট শব্দ।
দুপশলা বৃষ্টি হয়েছে ক্ষণিক আগে
সবাই শান্ত
শুধু পাখিগুলো ছাড়া
সন্ধ্যার আলো দ্রুতই নিভে গেল
ক্ষণিকের জন্য সবাই শান্ত
শুধু মানুষগুলোর ভিতরে অস্থিরতা।