ঈদ আয়োজন
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের ১০ কবিতা
যা ছিল ফুলের এতোকাল
পুরোটা রাত কাঁধে তুলে নিয়ে সে চলে গেল ধীরে। ওপারে অশান্ত
অকূল-আকুল করা মেঘ। চোখ জুড়ে নিয়ে গেল তোমার বুকের ঘ্রাণ।
অফুরান: তোমার যতোটুকু বাতাস হয়ে তার সারা গায়ে লেগে আছে,
যতোটা ক্ষণ ভেঙে ভেঙে রক্তহীন খুন বয়ে গেছে রাতভর।
পাতার বনে বুক কামড়ে পড়ে থেকে ভোরে, নিজ হাতে চূর্ণ করে
ফুল, পাপড়ি নিংড়ে দেহে নিতে মধু-গন্ধ জল, একদিন গোটা রাত
কাঁধে তুলে সে চলে গেল চোখহীন। ওপারে অশান্ত অকূল-আকুল
করা মেঘ। তোমার উত্তাপ ভেবে সহস্র সন্তান সেখানে
অম্লান জন্ম নেবে... সেইসব জারজেরা অতঃপর
তোমার সকল গন্ধ চোখভরে দেখে দেখে কাটাবে জীবন।
চোখ হারানো মন হারানো একশ' বছর ধরে
মন মরেছে আলোয় ডুবে, মন ভরেছে প্রেমের সমান প্রথম অন্ধকারে...
তোমার আমার নীরব মধ্যেখানে, সন্ধ্যাশীতের কুয়াশাহীন ঘোরে,
একবার সেই অন্ধ শীতের চাঁদে, পথ ভুলানো দিক ভুলানো চোখ মেলে
এক ভোরে...
একজন কেউ চিরটাকাল ছিল।
তোমার আমার হাতের বন্ধ ঘরে, নদীর এপার নদীর ওপার জুড়ে,
একজন কেউ উদাস তারার মতোন, চোখ হারানো মন হারানো একশ'
বছর ধরে...
একজন কেউ আবার বলে গেল
আগুনপোড়া গন্ধ যেমন ফাগুনবনে ঝরে,
তেমন ভীষণ জীবন আমার হবে;
তেমন বিশাল মরে অমর হব।
মন ডুবেছে আলোয় মরে, প্রেম হারালো মনের সমান প্রথম অন্ধকারে...
এক কৃষ্ণ উষ্ণতা
এক পৌষ কুয়াশা, এক মাঘ নিবিড় শিশির।
সহস্র শীতের এক আকাশ রোদ্রহীন দিন
যেমন
তুমি আজীবন আমাকে না জেনে
আমার আড়ালে, অন্তঃঅন্তরালে
যুগ যুগ বেঁচেছিলে।
যেমন
আজীবন তোমাকে না চিনে
ওপারে, তোমার অন্য কিনারে
কালে কালে মরেছি বহুবার।
তোমার এক যমুনা মন, এক কৃষ্ণ উষ্ণতায়
আমার চোখে চোখে ঢেউ তোলে।
যেন
তুমি নতুন কুয়াশা
তোমারই অন্য নামে
শীতের সমস্ত ফুল ফুল হয়ে ফোটে।
অধীর-অকাল-দারুণ-অশান্ত
কেবল একলা তোমার পুনর্জনম হলে, ওপারে এক কুয়াশাঘোর
জোছনা বন্ধ করে, এমন ভীষণ অন্ধকারে তুলব স্মৃতির ঢেউ!
এই অফুরান গন্ধকাতর ঘরে, অনেক দিনের অনেক সন্ধ্যা পরে,
যদি তোমার নামের পুরান রঙে ফিরে আসে নতুন রঙিন ঝড়;
দেশান্তরের হাজার রাতের পর, মরণকালের আলোক স্মরণ করে,
যদি তুমিই কেবল ফিরে আসো ধীরে...
কেবল একলা তোমার পুনর্জনম হলে, ওপারের এক কুয়াশাঘোর
জোছনা বন্ধ করে, এমন ভীষণ অন্ধকারে তুলব স্মৃতির ঢেউ!
এই অফুরান গন্ধকাতর ঘরে, অনেক দিনের অনেক সন্ধ্যা পরে...
তোমার অমন নতুন শরীর ঢাকবে আমার মলিন বসন্ত,
আমার গায়ে মিলিয়ে যাওয়া দিন-ফুরানো হাওয়ায় তুমি
সেই আরেক জীবন জুড়ে অধীর-অকাল-দারুণ-অশান্ত।
বনহীন মনহীন : উই উইল বি বর্ন এগেইন
এক হাজার একশ বছর পরে,
অজস্র অমাবস্যা চাঁদের ওপারে,
বিশেষ এমন এক দেশ খুঁজে পাবে,
আজন্ম যেখানে জন্ম নেবে খাঁটি সতেজ বিদেশি।
আজীবন তারা বিভাষায় কথা বলবে।
বিজাতির ধর্মই হবে তাদের একমাত্র ধর্ম।
বনহীন
মনহীন
মানুষের সেই দেশ
বৃষ্টি যেখানে আকাশ মেঘ ভুলে, সমুদ্রে জাগে সমুদ্রে হারায়
ফুলহীন
নদীহীন
মানুষের দেশ
অযুত ভোর-সূর্যের অন্য পারে,
আজ থেকে সহস্র বসন্ত পরে,
এমন এক বিষাদ-বৈশাখ খুঁজে পাবে,
সকাল সন্ধ্যা রাত যেখানে জন্ম নেমে শীতের ফুল।
দশদিক ছেয়ে যাবে কুয়াশায়।
এক হাজার একশ বছর পরে,
অজস্র অমাবস্যার চাঁদের ওপারে,
প্রচণ্ড দগ্ধ আগুন
উষ্ণ উজান বাতাসে ভেসে
রঙহীন
আলোহীন
মানুষের দেশে
অবশেষে খুঁজে পাবে
আজকের এই বিপুল বঙ্গদেশের সমস্ত ঘুমন্ত নাগরিক
মনহীন
বনহীন
আজীবন স্মৃতিবিহীন
রক্তহীন রক্তাক্ত এই সব চোখ
রক্তপাত ছাড়াও আরও হাজার উপায়ে মানুষ মরে যেতে পারে।
সহস্র অন্য রঙে দারুণ মৃত্যু হতে পারে প্রতিদিন, প্রতিরাতে।
তবু অজস্র অফুরান রক্ত কেমন অসহায় ম'রে গ'লে পড়ে।
উজাড় উদাস দুনিয়া জুড়ে
পাতার চেয়ে, ফুলের চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরে।
যাকে কোনোদিন ছুঁয়ে দেখি নাই, যার রক্তের গন্ধ জানি না
তার অপেক্ষাতেও ক্লান্ত ভীষণ রক্তাক্ত হতে পারে চোখ।
বড় বেশি মায়া দুনিয়া জুড়ে।
প্রেমের চেয়েও অনেক বেশি মন।
মনের চেয়েও অনেক বেশি প্রেম।
রক্তহীন রক্তাক্ত এই সব চোখে চোখে
সহস্র অন্য রঙে নিদারুণ মৃত্যু হতে পারে প্রতিদিন, প্রতি রাতে।
পয়লা বৃষ্টির পানি যেমন ডুবে যায়
খরা বসন্তে চুলের কোকিল-রঙ আর কয়লা-গন্ধ নিয়ে,
সবুজ পাতার ডালগুলো খালি করে, কাঁঠাল-মুচিরা
কেউ সন্ধ্যায়, কেউ রোদের আলোয় মরে যায়।
আশি বছরের ঠোঁটে পানের রস যেমন রক্তের মতোন, শুকনা কুয়ার রাক্ষস মাটিতে
পয়লা বৃষ্টির পানি যেমন ডুবে ডুবে যায়... রোদের মুখ জ্বলজ্বল করলে ঘন-বিশাল
হয়ে আসে বিশাল দুপুর, মানুষের ছায়া এইটুকুন, পায়ে পায়ে পড়ে থাকে।
তাই চোখের নিচে সবখানে ক্লান্ত ঝিম-ভাব ধরে। নম্রে যাওয়া মনের মতোন বাঁশের মাচায়
এলায়ে আসে একলা শরীর। তখন নাই! জামের ডালে কোনো পাখি নাই, ওপারে আবছা
মায়া-ধূসর পাড়া দেখার কিছু উপায় নাই। ধুলায় আর বাতাসে মাথা হয়ে যায়
ঘাসের ডগার মাঠ, মাঠান্তর।
বাদামের ক্ষেত দেখে এলে যেমন লাগে, নীলচে রাতে যেমন ভালোবাসা-বাসা লাগে,
খুব ভোরে যেমন মনের মতোন প্রাণ জাগে, আর কথা বলতে বলতেই বিকাল যেমন
অন্ধকার হয়ে যায়... ঠিক তেমন করে হয় না। চুল ছড়ানোর ভাষায় কাঠ-কয়লার
রঙে রঙে মানুষের ছায়া পা থেকে মাটিতে ঢলে পড়ে, সুগন্ধের ছোট্ট কাঁঠাল কেমন
বিশাল আহত হয়ে পড়ে গেল! ঘুম খুব গাঢ় হয়ে গায়ে এলে যেমন লাগে,
শেষ রোজার শেষ সন্ধ্যায় আজানের ধরন যেমন…
দ্যাট লাভ ওয়াজ নেভার আ লাভ
এই প্রেম কোনোদিন, কখনোই অন্য প্রেম নয়।
এমন ভরা কুয়াশায় শহরের গলিগুলো চোখের সামনে এসে নিভে যায়। কোথায় কোন আকাশে লুকিয়ে থাকে বিশাল-প্রদীপ সূর্য। যে পথ মন্দির, বিদ্যালয়, গির্জা, মসজিদ, মক্তব, বাজার, বেশ্যালয়, রুটি-চা-কাপড়-ফুলের দোকান, উদ্যান সমস্ত ঘুরে গিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রে মেশে, তার সাথে আজীবন তোমার আমার অপরিসীম সম্পর্ক :
তবু এই পথ ধরে যে অভিন্ন যাত্রা আমাদের, তার দুই ভিন্ন ভবিষ্যৎ।
তোমার হাত ধরে আমার যে যাত্রা, চিরকাল তার ভিন্ন ভবিষ্যৎ।
এমন ধূপকাঠি মলিন সন্ধ্যা। শহরের একপ্রান্ত থেকে চাদর গায়ে কড়ামনে শীতে হেঁটে আসে ধীরে। যেই রাত ধার্মিক, প্রেমিক, শ্রমিক, কিশোরী, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়া, গায়িকা, ভালো ছাত্র, চোর, মন্দ শিক্ষক, পোস্টমাস্টার, ইমাম, পুরোহিত, দালাল, কবি- সকল লোকের মাথার ওপর মৃদু মনোহর জোছনা নিয়ে আসে, হাসনাহেনার গন্ধ-সমেত জলজ শিশিরগুলো যতজন, যত লোক দেখতে পায়, তাদের সাথে তোমার আমার অন্ধকার মিলেমিশে একাকার :
তবু সন্ধ্যাবেলা, যত চোখ, যত লোক আমাদের দেখে, তত অজানা আমাদের ভবিষ্যৎ।
প্রতিটা প্রেম নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা।
প্রেমিক কখনো প্রেমিকের মতোন হয় না।
এক প্রেম কোনোদিন, কোনোকালেই অন্য প্রেম নয়।
নতুন স্মৃতির এমন করুণ রোদ
এভাবে অতীত গড়তে নেই ...
করুণ স্মৃতির এমন নতুন রোদ এভাবে পোহানো যায় না...
অতীত অতীত হয়,
স্মৃতি স্মৃতি হয়,
কেবল যদি তার গহন অন্ধকারে
হাজার মাতাল ফুলের উজান ঘ্রাণ, স্রোত ভুলে যাওয়া অপার বিশাল ঢেউ
রাতভরে, নদীর বুকজুড়ে দূর-অদূরে ভেসে চলে আসে...
এভাবে মনে রাখতে নেই...
নতুন স্মৃতির এমন করুণ রোদ এভাবে সওয়া যায় না...
মানুষ মরে গেলেও অন্ধ পাখি গান গায়
মিকাইলের ভারি জলের ধারা, ঝড়ের বাতাস, মেঘের তুলা,
তোমরা নেমে আসো মাটির কোমল ভেতরে।
এখানে গোরস্থানে গোরস্তানে গায়ের সব মাটি মাটি করে আমরা
রাত-দিন গুজরান করি, সব বিকালে সন্ধ্যা নামাই।
মড়া কানে আমাদের কেমন বাঁশি বাজে।
বাঁশি কথা জানে, ঘুমভাঙা কাব্য জানে।
বাঁশের পাতায় শনশন বাতাসেরা
উত্তর-দক্ষিণে যায় আর ফিরে আসে।
সবখানে মানুষ মরে যায়। কাবুল, বিলাত, বান্দরবান,
হুগলি, লাহোর, মার্কিন মুল্লুক, আমাজনের দেশ, আরব
সাগরের সব তীরে প্রতিদিন মানুষের আর মানুষের শরীর
মরে যায়। সবখানে অজস্র গোরস্থান।
হাজার বছর আগে জিব্রাইল ফুরায়ে গেছে। লক্ষ বছর ঘুমাতে চোখ বুজে আছে
শিঙ্গার ইশরাফিল, ক্ষণেক ভাবের রাজা। মাঝখানে যমদূত দ্বীপ-স্থল-মরুতে
গোরস্থান বানায়ে দুনিয়ার দৈত্যমতোন মহাসম্রাট।
মানকচুর পাতার নিচে পানি জমে জমে শুকায়।
দমে দমে মানুষ মরে গেলেও অন্ধ পাখি গান গায়।
দুনিয়ার সব আলো দিনভরে আসে। একজন-তিন-দশ-বারোজন
রাতের পর এই পথ ধরে যায় পুবে, পশ্চিমে মুখ করে ফিরে আসে।
গাছে গাছে পাখির যত পাখা, পাহাড়ের ছায়ায় পাথরের ছাদ,
কুয়া ভরা জল, মোহনায় নদীর ঢেউ, ধুলার খেজুর পাতা মাথায়
আজানের মিনার, ভাষায় ভাষায় যত অক্ষর,
সবার চেয়ে এই দুনিয়ায় গোরস্থানের দরকার।
কবি পরিচিতি
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির। জন্ম সিরাজগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে। প্রকাশিত গ্রন্থ : অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান।
ই-মেইল: muktadir137@gmail.com