নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত ঢাকা
বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর সচল জীবনে ঢাকায় এসেছেন বহুবার। সর্বশেষ ১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর অনুষ্ঠানে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। তৎকালীন বর্ধমান হাউসে থাকার সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে রয়েছে কবির নানা স্মরণীয় স্মৃতি।
কবির ঢাকায় থাকাকালীন নিবাস ছিল বর্ধমান হাউসের দোতলার কক্ষটি। বরাবর সেখানেই থাকতেন তিনি। বর্তমানে বাংলা একাডেমির ‘নজরুল কক্ষ’ নামে পরিচিত সেই ঘরটি এখন তালাবদ্ধ। সামনে রয়েছে তাঁর প্রতিকৃতি।
তবে নিচতলায় লেখক ও সাহিত্য জাদুঘরে রয়েছে নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত নানা সংগ্রহ। কাজী নজরুল ইসলামের কিশোর বয়সের ছবি, ধ্রুব চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনেতা রূপে ছবি। চুরুলিয়া গ্রামের জন্মস্থানের সেই কুটির। নজরুল সম্পাদিত অগ্নিবীণা, লাঙল, বাঁধনহারা পত্রিকার প্রচ্ছদ।
ধূমকেতুতে প্রকাশিত রবিঠাকুরের শুভেচ্ছা বাণী। নিষিদ্ধ বইগুলোর নিষেধাজ্ঞা অপসারণের জন্য লিখিত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে লেখা চিঠি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রয়েছে নজরুল মঞ্চ। ২০০৩ সালে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান নির্মিত নজরুলের আবক্ষ মূর্তিটিকে ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে এই মঞ্চটি।
একুশের বইমেলায় যাবতীয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয় এই মঞ্চে। মঞ্চ পরিকল্পনার কাজ করেছেন সৈয়দ লুৎফুল হক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন স্থানে রয়েছে কবির সমাধি। কবির সেই চাওয়া পূর্ণ হয়েছে এর মাধ্যমে, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’। সমাধি চত্বরের সামনেই রয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট পরিচালিত নজরুল কর্নার। সেখানে রয়েছে নজরুলের সকল কাব্যগ্রন্থ, গানের সংকলন, স্বরলিপি, নজরুলকে নিয়ে লেখা গবেষণাগ্রন্থের পরিপূর্ণ সংগ্রহ।
নজরুল ইসলামের ওপর ভিত্তি করে লেখা বইগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশে নজরুল’ বইটি। সেখান থেকেই জানা যায়, বাংলায় এসে কবি কখনো গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ড পাহাড়ে আবার কখনো উত্তর বঙ্গে।
এ ছাড়া রয়েছে কবিকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র, পোস্টার, ভিউ কার্ড রয়েছে নজরুল কর্নারে। অডিও গানের সংগ্রহের মাঝে রয়েছে ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে গাওয়া ‘নিজেরে ধন্য মানি’ অডিও সংকলন।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে কবিকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৯৭২-এর ২৪ মে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি দেওয়া হয় ১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে।
একুশে পদক দেওয়া হয় ১৯৭৬-এর ফেব্রুয়ারিতে। কবিকে নিয়ে পরবর্তীতে জাতীয় জাদুঘরে আলাদা বরাদ্দকৃত স্থান থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শুধু ৩৭ নম্বর গ্যালারির উত্তর পাশে প্রদর্শিত হচ্ছে নজরুলের একটি গানের খাতা এবং কবিতার খাতা।
সেই কবিতার ভাষায় রয়েছে বিদ্রোহের টান,
আরো ফসল ফলাও ভাই, মাঠে ফলুক আরও ধান
ধান নয় এ ক্ষিদের অন্ন, বাঁচায় মোদের প্রাণ।
জাদুঘরের পূর্ব পাশে রয়েছে নজরুলের তরুণ বয়সের ছবি আর শ্যামল চৌধুরীর হাতে গড়া আবক্ষ মূর্তি।
জাতীয় জাদুঘরে আরো ৮৫টি নজরুলবিষয়ক সংগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাঁর বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সনদ, ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেনাবাহিনীর প্রতীক। ব্যক্তিগত ব্যবহার্য বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিত্যদিনের সাক্ষাৎপ্রার্থীর বই, ক্যাসেট রেকর্ডার, জুতা, থালা, কটেশ ক্র্যাফট, টুপি, ধুতি।
ধারাবাহিকভাবে এসবের প্রদর্শনী করা হয় গ্যালারিতে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। তাঁর জীবনের শেষদিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কক্ষে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল)।
ঢাকার ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০ নম্বর বাড়িটিতে এখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি ইন্সটিটিউট করা হয়েছে, এখানেই তিনি জীবনের শেষ সময় কাটিয়েছেন।এ ভবনটি বর্তমানে নজরুল ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।১৯৮৫ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৯৭২ সালের ২৪ মে অসুস্থ কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তখন তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার। সেই সময়ে কবিকে ঢাকার ধানমণ্ডির ২৮ নম্বর রোডে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। এ বাড়িটি বর্তমানে নজরুল জাদুঘর, এ জাদুঘরে আছে কয়েকটি আলমারি ও নজরুলের ১০৯টি আলোকচিত্র।আরো আছে নজরুলকে লেখা বিভিন্ন সময়ের চিঠিপত্র, নজরুলের পাণ্ডুলিপি, নজরুলের হাতের লেখাসহ দুর্লভ জিনিসপত্র। রয়েছে নজরুলের হস্তলিপির ফটোকপি, কাব্যগ্রন্থের দুর্লভ সংস্করণের ফটোকপি, আলোকচিত্র, আদি গ্রামোফোন রেকর্ড, আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের অডিও ক্যাসেট ও কবির স্মৃতিচিহ্ন। এখানে আরো আছে একটি কলের গান।নজরুল জাদুঘরে আরো রয়েছে নজরুল চিত্রকলা গ্যালারি। ছুটির দিনবাদে প্রত্যেক দিন অফিস চলাকালীন সময়ে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে ।
১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট) দেহত্যাগ করেন কাজী নজরুল।