আজ রূপময় ঋতু বর্ষার দিন
‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে... আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়ই বলছি, আষাঢ় এসেছে ষড়ঋতুর বাংলায়। আজ রূপময় ঋতু বর্ষার দ্বিতীয় দিন। সবুজের সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে এসেছে আষাঢ়। আকাশ ছেয়েছে মেঘের ঘনঘটায়। মেঘদূতের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে আষাঢ় আমাদের মাঝে। গাছের পাতা, টিনের চাল কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে এবং খোলা আকাশের প্রান্তরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার দিন। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার অঙ্গন আষাঢ়বন্দনায় নিবেদিত, উচ্ছ্বসিত। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে বর্ষার রূপবর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি চিরকালীন।
বাংলা সাহিত্যে বর্ষার অনেক প্রভাব রয়েছে। সেই বিদ্যাপতির ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মোর’ থেকে শুরু করে বাংলার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান-কবিতায় বর্ষা ঝরছে অঝোর ধারায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জসীমউদ্দীন সবাই অল্পবিস্তর বর্ষার রূপ বর্ণনা করেছেন। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের বাংলার আধুনিক কবিদের মধ্যেও পড়েছে বর্ষার বিপুল প্রভাব।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আষাঢ়ের বন্দনায় বলেছেন, ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।/ মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া।।/ জয়ধ্বজা ওই-যে তোমার গগন জুড়ে।/ পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে...।’ দাবদাহে হাঁসফাঁস মানুষ কবির মতোই মনে করছে, জলভরা মেঘের আষাঢ় এসেছে দীর্ঘ তাপদহনের জ্বালা-যন্ত্রণার গ্রীষ্মের যবনিকা টানতে। মুক্তি পেতে চলেছে প্রখর দাবদাহে কাহিল মানবকুল, প্রকৃতি ও উদ্ভিদরাজি।
নজরুলের কলমে আষাঢ়, শ্রাবণ, বর্ষা সবগুলোই নানান বিষয়ে নানাভাবে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক বর্ণনার এক সুন্দর বয়ান নজরুলের কলমে উঠে এসেছে। বেশ কিছু কবিতায় এই আষাঢ়কে কবি চমৎকারভাবে সাজিয়েছেন, ‘ইন্দ্রপতন’-এ নজরুল দারুণ বর্ণনায় আষাঢ়কে উপস্থাপন করেছেন, আষাঢ় মাসের এটাই বাস্তব-রূপ-আগমন—তখনো অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু/ অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরুগুরু গুরুগুরু!/ আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী?/ শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃত্তহিত-ধ্বনি।/ বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,/ সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ংকর সাজে।’
মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহকাতর ‘যক্ষ মেঘ’-কে দূত করে কৈলাসে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সে বিরহ-বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চার করে চলেছে প্রতিটি বিরহকাতর চিত্তে, যুগ হতে যুগান্তরে। তিনি বলেন, মেঘ দেখলে সুখী মানুষও আনমনা হয়ে যায়। তাঁর ভাষায়, ‘পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি মরি।/ হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী।/ পথ চেয়ে তাই একলা ঘাটে বিনা কাজ সময় কাটে,/পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরেরই তরী...’ (শেষ বর্ষণ)।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি।’ আষাঢ়ে জলভারানত ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশি আকাশ ছেয়ে রাখে। কখনো বা ‘প্রাণনাথের’ মতো প্রকৃতিতে নামে বারিধারা। আষাঢ়ে প্রকৃতি ‘সজল শ্যাম ঘন দেয়া’ সম্ভাষণ। রূপ-রঙে হয়ে ওঠে ঢল ঢল। আকুতি জানায়, ‘বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে, বিদ্যুৎ ইঙ্গিতে দশদিক হাসায়ে।’
এদিকে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শুধু যুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয়, প্রেমই আসেনি, বর্ষাও এসেছে। বৃষ্টির জন্য কবি অপেক্ষায় থেকেছেন, যেমন মানবহৃদয় অপেক্ষায় থাকে প্রেমিকার জন্য। বর্ষাকে কবি দেখতে চেয়েছেন সবকিছু ছেড়ে ভালোলাগার স্পর্শ করে। তাই তো চাষির মতোই তিনিও বর্ষাকে প্রার্থনা করেছেন : ‘টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে,/ আমিও চাষীর মতো বড়/ ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়, যদি জড়ো/ হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেন্সিল/ হাতে, বকমার্কা। পাতা জোড়া আকাশের খাঁ খাঁ নীল।’ (কবিতা : অনাবৃষ্টি)
চিরকালই কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাস্তব হয়ে উঠেছে এই বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক, অব্যক্ত রয়ে গেছে আরো বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘবৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাঁপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারণ করে, ভাষার সাধ্য কি পৌঁছায় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রং রূপ রস গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্তকাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের কবিতায়। বর্ষাবন্দনায়।