ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে রাতভর র্যাগিংয়ের অভিযোগ
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে রাতভর র্যাগিং করার অভিযোগ উঠেছে। র্যাগিংয়ের শিকার ওই ছাত্রী মোছা. ফুলপরী খাতুন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ভয়ে বাড়িতে চলে যায়।
আজ মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে বাবার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে ওই শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা দপ্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী বলেন, ‘গত ৮ ফেব্রুরুয়ারি ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হওয়ায় আমি ৭ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ৩০৬ নম্বর কক্ষে এলাকার পরিচিত এক আপুর কাছে গেস্ট হিসেবে উঠি। যথাযথভাবে সবাইকে সম্মানপূর্বক কক্ষে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করি। এরপর ১১ ও ১২ তারিখে দুই দফায় ওই হলে উঠলে আবাসিক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা আপুর নেতৃত্বে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাবাচ্ছুম আপুসহ নাম না জানা আরও অন্তত ৭-৮ জন র্যাগিংয়ের নামে আমাকে চরমভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে রাখে। এমনকি তারা আমাকে জীবননাশের হুমকিও দেয়।’
লিখিত অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত নির্যাতনের বিবরণে ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমার বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাবাচ্ছুম আপু আমাকে দেখা করতে ডাকে। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে তার কক্ষে যেতে পারিনি। এরপর থেকেই তারা আমার ওপর চড়াও হতে থাকে এবং তাদের কক্ষে গেলে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, ভয় দেখাতে থাকে। আমাকে হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। তারা অভিযোগ করতে থাকেন তাদের না জানিয়ে কেন হলে উঠেছি। অথচ আমি আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে নয় গেস্ট হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য উঠেছিলাম। এরপর রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টায় অন্তরা আপুসহ তার সঙ্গে থাকা ৭-৮ জন আমাকে গণকক্ষে নিয়ে যেয়ে এলোপাতাড়িভাবে চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। আপু আমাকে কেন মারছেন বলতে গেলে তারা আমার মুখ চেপে ধরে থাকেন এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারে। এছাড়া আমাকে বলতে থাকে, আমরা কি করতে পারি জানিস তুই? আমাদের সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া আছে? আমি কান্না করে তাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা আমাকে পা দিয়ে লাত্থি মারেন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখেন, একটা ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেন। এছাড়া আমাকে বলতে থাকে যাতে এই বিষয়টা কোনোভাবেই বাইরে না যায়। যদি বলিস তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল করে দেবো। ভিডিওগুলো তাদের সংরক্ষণে আছে। এসময় অন্তরা বলেন, যদি তুই প্রশাসনের কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ দিস তাহলে মেরে কুকুর দিয়ে খাওয়াব। এরপর আমাকে রাত সাড়ে ৩টায় ছেড়ে দেয়। আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।’
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী আরও বলেন, ‘আপুরা হুমকি দিয়ে বলছিল, এসব বাইরে বললে একেবারে মেরে ফেলবো। তোকে বিবস্ত্র করে এখান থেকে বের করে দেব। এই কথা বাইরে গেলে ভিডিও ভাইরাল করে দেব। তুই হলের প্রভোস্ট স্যারকে বলবি, সব তোর দোষ, এই হলে থাকবি না। এসব বলে হল থেকে একেবারে চলে যাবি। এই কথা ১৪ তারিখ বলবি। পরে ভয় পেয়ে সোমবার সকালে হল থেকে বাড়ি চলে এসেছি।’
অভিযুক্ত নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা বলেন, ‘তিনি (নবীন ছাত্রী) সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। ও আমাকে চেনেও না। নবীন ওই ছাত্রী ওর এক ভাইকে দিয়ে ওর বিভাগের সিনিয়রকে (তাবাসসুম) হুমকিধমকি দিয়েছিল। রোববার প্রক্টর স্যার, প্রভোস্ট স্যার থাকাকালীন এটা মীমাংসা হয়েছিল। রাতের মধ্যে আর কোনো কিছুই হয়নি। এ ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ‘রোববার রাতের ঘটনা যতটুকু জেনেছি নবীন ওই ছাত্রী অবৈধভাবে এক সিটে থাকতেছে। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাকে হল থেকে বের করে দেয়। বিষয়টি জানার পর ওই ছাত্রীর পারিবারিক অবস্থা শুনে আবার হলে রাখতে প্রভোস্টের কাছে অনুরোধ করি। গত রাতের ঘটনা আমি জানি না। তবে, অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রশাসনের কাছে বিচার দাবির পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেব।’
হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘রোববার ঝামেলা হওয়ার পর আমরা উভয় পক্ষকে ডেকেছিলাম। আমি যতদূর জেনেছি, ওর বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ে। নবীন ছাত্রীটি তার বোনের পরিচিত একজনের কক্ষে থাকছে। মেয়েটা (ভুক্তভোগী) বিষয়টি স্বীকার করেছে। যেহেতু ও আবাসিক না তাই বলেছিলাম কয়েকদিন হলের বাইরে থাকতে। পরে পরিবারের অবস্থা শুনে হলেই থাকতে বলেছিলাম।’
র্যাগিংয়ের বিষয়ে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের হলে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এবারই প্রথম শুনছি। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন আজাদ বলেন, ‘রোববার হল প্রভোস্ট আমাকে বিষয়টি জানানোর পর দুইজন সহকারী প্রক্টরকে পাঠিয়েছিলাম। তারা আর প্রভোস্ট মিলে বিষয়টি সমাধান করে এসেছিল। আমরা বসে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘র্যাগিংয়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। র্যাগিংতো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও র্যাগিং ছিল না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়গুলো অ্যালাউ করে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিষয়টি বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এদিকে বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষ নানাভাবে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে পোস্টার করেছে।’