উপকূলে জেলেদের খাদ্য সহায়তার কার্ড বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ
মা ইলিশ সংরক্ষণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ঘরে চাল নেই, পেটে ভাত নেই জেলেদের। জেলেরা সরকারি খাদ্য সহায়তার চালও পায়নি যথা সময়ে। খাদ্য সহায়তার কার্ড পাওয়া, না পাওয়া নিয়েও রয়েছে জেলেদের নানা অভিযোগ।
বাগেরহাটের মোংলাসহ আশপাশ উপকূলের জেলেরা জাল ও নৌকা ঘাটে রেখে ঘরে বেকার অবস্থায় রয়েছে। তাদের অভিযোগ, তারা যখন অবরোধ পালন করছেন, তখন ভিন দেশি জেলেরা সাগর থেকে লুটে নিয়ে যাচ্ছে মা ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা।
সরেজমিন জেলে-পরিবারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাগর-সুন্দরবনে বর্তমানে চলছে মা ইলিশ সংরক্ষণে মাছ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। মোংলার সমুদ্র ও সুন্দরবন উপকূলের জেলেদের অন্য কোনো কাজের সুযোগ নেই। তাই বেকার হয়ে ঘরে বসে সময় কাটছে তাদের। নদীতে জাল ফেলতে না পারায় আয়ও নেই। তাই খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন করছে হাজার হাজার জেলে পরিবার। তাদের এ দুঃখ যেন দেখার কেউ নেই।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে জেলে কার্ড দেওয়া হয়, তাতেও রয়েছে স্বজনপ্রীতি। ফলে প্রকৃত জেলেরা সেই কার্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যাদের কার্ড রয়েছে তারাও এখনো পায়নি খাদ্য সহায়তা। জেলেরা খাদ্য সহায়তা পায়নি এর আগের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায়ও। তাই চরম দুঃখ-কষ্টে আছে পশুর নদের পারের জেলে পরিবারগুলো। নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বদলের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে জেলেদের কার্ডের মালিকানাও।
সাগর-নদীতে মাছ ধরেন চাঁদপাই ইউনিয়নের জেলে সুজন সরকার। তিনি বলেন, আমার জেলে কার্ড রয়েছে, একবার মাত্র চাল পেয়েছি। এখন শুনছি আমার কার্ড মেম্বর কেটে দিয়েছে।
চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দুর্জয় হালদার বলেন, যারা জেলে না, এমন লোকও কার্ড পেয়েছে। তাই তাদের বাদ দিয়ে প্রকৃত জেলেদের কার্ড দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কার্ড করার সময় অনেক জেলে সাগরে-সুন্দরবনে থাকায় তারা তালিকাভুক্ত হয়নি। নতুন তালিকায় বাদ পড়াদের অন্তর্ভুক্ত করতে মৎস্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানিয়েছি।
চিলা এলাকার জেলে রোকন সরকার বলেন, ‘চলতি ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় কোনো খাদ্য সহায়তা আমরা এখনও পাইনি। আমরা খুব কষ্টে আছি, সরকারের কাছে সহায়তা পাওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।’
চিলার আরেক জেলে অঞ্জন বলেন, ‘আমাদের পেশা নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা। এখন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় কোনো কাজ নেই। খুব কষ্টে আছি। সরকারের কাছে দাবি, আমরা যেন দ্রুত সহায়তা পাই।’
কানাইনগর গ্রামের জেলে গাবরিয়েল সরদার বলেন, ‘সারা জীবন জেলে পেশায় আছি, আজও কোনো কার্ড পাইনি। জেলেনেতা বিদ্যুৎ বাবু কার্ড করতে ১৮ টাকা চেয়েছিলেন। দিতে না পারায় কার্ড দেননি।’
দক্ষিণ কাইনমারী গ্রামের কমলা সরকার বলেন, ‘আমাদের এখানকার ৯৫ ভাগ লোকই জেলে। অনেকের জেলে কার্ড আছে। কিন্তু চাল পায় না, কী সমস্যা আছে, জানি না। আর যাদের যে চাল দেওয়া হয় তাতে তাদের চলে না।’
কমলা সরকার আরও বলেন, ‘এখন মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলছে আমাদের দেশে। আর এই সুযোগে ভারতের জেলেরা আমাদের সাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কী লাভ হলো সরকারের এই অবরোধ দিয়ে।’
অনেক জেলেই এমন অভিযোগ করে বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে আমরা ঘরে বসে আছি। সেই সুযোগে ভারতের জেলেরা সাগর থেকে মাছ লুটে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে অবরোধের মানে হলো কী? এ ছাড়া সরকারি খাদ্য সহায়তাও এখনো পাইনি। আমরা বছরের পর বছর ধরে নদীতে মাছ ধরি তারপরও জেলের স্বীকৃতি পাইনি। যারা জেলে না, এমন লোক সহায়তার কার্ড পাচ্ছে। আমাদের দুঃখের কথা সবাইকে বলি কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয় না।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, জেলেদের খাদ্য সহায়তা শিগগিরই দেওয়া হবে, আর জেলেদের জন্য নতুন তালিকা করা হচ্ছে। এটা সম্পন্ন হলে অনেকেই সহায়তার আওতায় আসবে। যারা প্রকৃত জেলে না, তাদের বাদ দেওয়া হবে। আবার সময় মতো প্রকৃত জেলেরা তথ্য না দেওয়ায় বাদ পড়ে থাকতে পারেন।
জাহিদুল আরও বলেন, জেলে কার্ড বিতরণের নানা অনিয়মের অভিযোগের বিষয়টি তারও কানে এসেছে। তাই অনিয়ম রোধে তিনি নিজেই কার্ড নিবন্ধনের কাজ করছেন।
অপরদিকে চলমান নিষেধাজ্ঞার সময় ভিনদেশি জেলেরা এ দেশের সাগরের মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে—জেলেদের এমন অভিযোগের বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখছে। এবং আমরা কোস্ট গার্ডের সঙ্গে যৌথ অভিযান পরিচালনা করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমলেশ মজুমদার বলেন, আমাদের সমুদ্রসীমায় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর টহল বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারপরও যারা এ দেশের সাগরে যখনই ঢুকছে তখনই তাদের ধরে এনে পুলিশে সোপর্দ করছেন নৌবাহিনী-কোস্ট গার্ড সদস্যরা।