এসপি মাসুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার সুপারিশ
টেকনাফে তল্লাশি চৌকি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার সময় কক্সবাজার জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ বি এম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগপত্রে সুপারিশ করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
আলোচিত এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪-এর বিচারক তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে এই সুপারিশ করেন।
বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানান।
সিনহা হত্যা মামলার পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ বি এম মাসুদ হোসেনকে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। এখনো তিনি সেখানেই দায়িত্ব পালন করছেন। অপরদিকে কক্সবাজার জেলার নতুন পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন ঝিনাইদহ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান।
র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘তদন্তে বেরিয়ে আসে সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার পর (এসপির) ঘটনাস্থল পরিদর্শনে না যাওয়া ও সিনহাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করাসহ নানা বিষয় তদন্তকারী কর্মকর্তা আমলে এনেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা মনে করেন, পুলিশ সুপারের অপেশাদারি আচরণ এবং দায়িত্ব পালনে আরো বেশি তদারকি বা যোগ্যবান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল।’
র্যাব কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সিনহাকে হত্যার আগ থেকেই ওসি প্রদীপ কুমার দাস সম্পর্কে যে বিভিন্ন ধরনের তথ্য তৎকালীন সময়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছে সেসব বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন।’
‘এর পাশাপাশি সংবাদিক ফরিদুর মোস্তফাসহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের প্রতি ওসি প্রদীপের যে নির্যাতনের ঘটনা, এসব ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পরও পুলিশ সুপার উদাসীন ছিলেন’, যোগ করেন আশিক বিল্লাহ। তিনি আরো বলেন, ‘সার্বিক ঘটনা বিবেচনায় একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের পুরো ঘটনা তদারকিতে ঘাটতি ছিল বলে তদন্ত কর্মকর্তা খুব স্পষ্টতই মনে করেন।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘এই পরিপেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে বা তাঁর আচরণে কিংবা দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার মর্মে চার্জশিটে একটি সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন।’
গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর মেজর সিনহা হত্যার পর গত ৫ আগস্ট তাঁর বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে।
এরপর ১০ সেপ্টেম্বর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এদিন আবেদনটি শুনানির পর কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালত কিছু পর্যবেক্ষণসহ তা খারিজ করে দেন।
পরে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এসপিকে আসামি করার জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল শুনানি শেষে মাননীয় আদালত তা নামঞ্জুর করে একটি অবজারবেশন (পর্যবেক্ষণ) দিয়েছেন। মামলার তদন্ত চলার সময়ে প্রভাব বিস্তার করলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা তদন্ত কর্মকর্তার রয়েছে বিধায় এ আবেদনখানা নামঞ্জুর করা হলো।’
আজ দাখিল করা আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলজুড়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার যে ‘অবৈধ মাদক বাণিজ্য ও ভয়ভীতি-নির্যাতনের’ পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন সেটি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান জেনে ফেলেছিলেন বলেই তাঁকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন আর একজন পলাতক আছেন।
কারাগারে থাকা ১৪ আসামি হলেন—বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। পলাতক আছেন কনস্টেবল সাগর দে।
এদিকে আজ সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলা বাতিল চেয়ে প্রধান আসামি বরখাস্ত হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর পক্ষে করা রিভিশন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। উভয়পক্ষের যুক্ততর্ক ও শুনানি শেষে আবেদনটির গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় খারিজ করে দেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।