‘ওরে একটু বানালি হতো’

‘এ তো জাতীয় প্রতারক, সবাই মিলে ওরে মারলি হতো, ওরে একটু বানালি (প্রহার বা মারধর) হতো। ওকে ছেড়ে দিলে মানুষ ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।’
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট ও জালিয়াতিসহ একাধিক অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া মো. সাহেদকে নিয়ে এসব মন্তব্য করেন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। এরপরই লাঠি দিয়ে একজন সাহেদের গায়ে আঘাত করেন।
আজ বুধবার ভোরে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক ও টক শো ব্যক্তিত্ব মো. সাহেদকে দেবহাটার কোমরপুর ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করার পর সাধারণ মানুষ এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে।
এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ভিডিওতে দেখা যায়, সাহেদকে গ্রেপ্তারের পর লবঙ্গবতী নদীর পাড়ে একটি স্কুলমাঠে নিয়ে আসে র্যাব। এ সময় স্থানীয় উৎসুক জনতার ভিড় বেড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন সাহেদকে লক্ষ্য করে ক্ষোভ ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকে।
স্থানীয় কয়েকজন লোক বলতে থাকে, ‘এ তো জাতীয় প্রতারক, সবাই মিলে মারলি হতো, ওরে একটু বানালি হতো।’
সে সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সাহেদকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এটুকু ছেলে পর্যন্ত বলছে, একটু বানালি হতো।’ এ সময় লাঠি দিয়ে একজন সাহেদের গায়ে আঘাত করে।
এ সময় সাহেদ চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকে। পাশের আরেকজন বলে ওঠেন, ‘থাকগে, ওকে ছেড়ে দে।’ এ সময় অপরজন বলে ওঠেন, ‘ওকে ছেড়ে দিলে মানুষ ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।’
সে সময় উৎসুক একজন বলতে থাকেন, ‘ও সাতক্ষীরা আসলো কীভাবে? বোরকা পরে চলে এসেছে; ওর বাড়ি তো সাতক্ষীরায়।’ এভাবে স্থানীয় সাধারণ মানুষ জড়ো হয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন।

করোনা টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি ও প্রতারণাসহ অর্ধশতাধিক মামলার আসামি ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদকে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
সাহেদ দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর সীমান্ত এলাকার বেইলি ব্রিজের নিচ দিয়ে লবঙ্গবতী নদীপথে নৌকায় করে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি জিন্সের প্যান্ট ও নীল রঙের শার্টের ওপর কালো রঙের বোরকা পরে ছিলেন।
তখন আগে থেকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা সাহেদকে র্যাব সদস্যরা চ্যালেঞ্জ করেন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছেন র্যাবের সাতক্ষীরা কোম্পানি কমান্ডার বজলুর রশীদ। তিনি জানান, সাহেদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও তিনটি গুলি জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর সঙ্গে র্যাব সদস্যদের ধস্তাধস্তি হয়। এ কারণে সাহেদের বোরকা ও প্যান্টে কাদা ভরে যায়।
কয়েক দিন ধরে সাহেদকে গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে আসছিল।
সকাল ৮টার দিকে তাঁকে সাতক্ষীরা থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় রওনা হয় র্যাব। এক ঘণ্টা পর সকাল ৯টার দিকে হেলিকপ্টারটি ঢাকায় তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
এর আগে র্যাব সাহেদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পথ রুখতে তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে। অবশেষে চোরাপথে ভারতে পালানোর সময় গ্রেপ্তার হলো সাহেদ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সাহেদের দাদা এমদাদুল করিম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এ সময় তাঁরা সাতক্ষীরা মহকুমার দেবহাটায় বসবাস শুরু করেন। পরে তাঁরা সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল কামাননগরে বসবাস করতে থাকেন। সাহেদের মা সাফিয়া করিম সাতক্ষীরা জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি মারা যান। এর আগে ১৯৯৮ সালে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়াকালে সাহেদ নানা অপরাধ করে ঢাকায় পালিয়ে যান। সেখানে তিনি গড়ে তোলেন রিজেন্ট হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গত ৬ জুলাই বিকেল থেকে রাত অবধি উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের মূল কার্যালয়ে প্রথমে অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখান থেকে অভিযান শেষে হাসপাতালটির মিরপুর শাখায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় হাসপাতালটির আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করা হয়।

এরপর ৭ জুলাই রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয় র্যাব-১। এ ছাড়া উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের রিজেন্ট গ্রুপের মূল কার্যালয়ও সিলগালা করা হয়। ৭ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়।
রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সাড়ে চার হাজার করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। একজন কম্পিউটার অপারেটর বসে বসে সাড়ে চার হাজার রিপোর্ট তৈরি করেছেন। মনগড়া রিপোর্ট পজিটিভ-নেগেটিভ দিয়েছেন।
তা ছাড়া মোট ১০ হাজার রোগীর করোনা টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করে রিজেন্ট হাসপাতাল। মাত্র চার হাজার ২৬৪টি নমুনা সরকারিভাবে টেস্ট করে রিপোর্ট দেয়। এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতারণার কৌশল গ্রহণ করে রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারো জ্বর থাকলে তাকে পজিটিভ আর জ্বর না থাকলে নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদান করে।