কক্সবাজারে সেনাপ্রধান ও আইজিপি
পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যুর ঘটনায় কক্সবাজার গেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। আজ বুধবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে তাঁরা কক্সবাজার আসেন।
দুই বাহিনীর প্রধান পরে কক্সবাজার সৈকতে অবস্থিত সেনাবাহিনীর রেস্টহাউস জলতরঙ্গতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হোন। এ সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে গত শুক্রবার রাতে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসসহ পুলিশের নয়জন সদস্যকে আসামি করে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করা হয়েছে। আজ বুধবার নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এ মামলা করেন। দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় এ মামলা করা হয়েছে। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা সাংবাদিকদের জানান, আদালত মামলাটি র্যাবকে সুপারভাইজ করতে বলেছেন। সেইসঙ্গে সাত দিনের মধ্যে মামলার কী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, আদালতকে অবহিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া সাংবাদিকদের জানান, মামলার ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসকে।
মামলার বাকি আসামিদের নাম শারমিন জানাননি। তাঁর কাছে প্রশ্ন করা হয়, মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার আগে মামলা কেন?
জবাবে শারমিন বলেন, ‘আমার ভাই মারা গেছেন ৩১ জুলাই রাতে। (টেকনাফ) থানা থেকে আমাদের বলা হয়নি, আমাদের ভাই মারা গেছে। পরদিন সকালে আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছে। তারাও বলেনি, আমার ভাই মারা গেছে। আমরা চাচ্ছি, আমার ভাই হত্যার বিচার দ্রুত কার্যকর করতে। এ জন্য আদালতে মামলা করেছি।’
মামলার আর্জিতে নয় আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ১ নম্বর আসামি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পূর্ব হুলাইন গ্রামের বাসিন্দা ও টেকনাফ থানাধীন বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী (৩১); ২ নম্বর আসামি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারুয়ারতলীর বাসিন্দা ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার সাহা (৪৮); ৩ নম্বর আসামি উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত; ৪ নম্বর আসামি পুলিশ কনস্টেবল সাফানুর রহমান; ৫ নম্বর আসামি পুলিশ কনস্টেবল কামাল হোসেন; ৬ নম্বর আসামি পুলিশ কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন; ৭ নম্বর আসামি সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া; ৮ নম্বর আসামি টুটুল এবং ৯ নম্বর আসামি পুলিশ কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
মামলার আর্জিতে ১০ জন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরো সাক্ষী উপস্থাপন করার কথাও লেখা আছে।
এ ব্যাপারে পরদিন জেলা পুলিশ দাবি করে, মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান শুক্রবার রাতে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অপর একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে সেনা কর্মকর্তা তাঁর কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী গুলি চালান। এতে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান গুরুতর আহত হন। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গত শনিবার সকালে মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন দাবি করেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেয়। এ সময়ে পুলিশ চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তাঁর পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যান।
পুলিশ সুপার জানান, এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। দুজনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ পিস্তলটি জব্দ করেছে। এ ছাড়া গাড়িতে তল্লাশি করে ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাঁজা এবং দুটি বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত রোববার বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ সবাইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখনো দায়িত্বে আছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস।
সিনহা রাশেদ খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় তিনি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন। এসএসএফের সদস্য হিসেবে তিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তায়ও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব প্রয়াত মো. এরশাদ খানের ছেলে। তিনি ১৯৯৯ সালে বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০০১ সালে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি গত ৩ জুলাই ঢাকা থেকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীসহ ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ট্রাভেল ভিডিও তৈরি করতে কক্সবাজার আসেন। প্রায় এক মাস তাঁরা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন।
তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর নিহতের ঘটনায় দুর্ঘটনা হোক বা যা-ই বলেন, ঘটনা তো একটা ঘটেছে। এটা অস্বীকারের কিছু নেই। সরকার এর সঠিক কারণ খুঁজে সামনে এনে দোষীকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। আপনারা সাংবাদিকরা যতদূর শুনেছেন, তা আপনাদের মধ্যে থাক। আমি যা শুনেছি, তা আমার মধ্যেই থাকুক। তদন্তের আগে এ নিয়ে একটি কথাও বলতে চাচ্ছি না।’
এদিকে, ঘটনার তদন্তে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করে সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানিয়েছেন। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন।
নাসিমা আক্তার এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে বিচার চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমের বিচারের আশ্বাস দেন। নাসিমা আক্তার ফোন করে সমবেদনা জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।