পাঁচ পৌরসভায় বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট বর্জন
নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ভোটারদের বাধা, এজেন্টদের বের করে দেওয়া, হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশের পাঁচটি পৌরসভায় ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মেয়র প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই পাঁচটি পৌরসভা হলো বাগেরহাটের মোংলা পোর্ট পৌরসভা, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর পৌরসভা, রাজশাহীর বাগমারার ভবানীগঞ্জ পৌরসভা, পাবনার ঈশ্বরদী পৌরসভা ও মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভা।
এই পাঁচ পৌরসভার নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
আবু হোসাইন সুমন, মোংলা : মোংলা পোর্ট পৌরসভার নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ভোটারদের বাধা, এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোট শুরুর মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় ভোট বর্জন করেছেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীসহ ১২ কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। আজ শনিবার সকাল ১০টার দিকে পৌর শহরের মাদ্রাসা রোড এলাকায় নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মো. জুলফিকার আলী। এ সময় মেয়র পদপ্রার্থীর সঙ্গে বিএনপি সমর্থিত ১২ কাউন্সিলর পদপ্রার্থীও ভোট বর্জন করেন।
এ ছাড়া দুপুর ১২টার দিকে ভোট বর্জন করেন আরো চার স্বতন্ত্র কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাদ্রাসা রোড এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র কাউন্সিলর পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন, ইউনুস আলী, সুমন মল্লিক ও এমরান হোসেন একসঙ্গে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এ ছাড়া মেহেরপুরের গাংনীতেও এক কাউন্সিলর প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
সকালে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী জুলফিকার আলী অভিযোগ করেন, ভোট শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী সমর্থকরা। তারা সাধারণ ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেয়। এ ছাড়া প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলে। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে তাঁর এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন এই মেয়র পদপ্রার্থী।
জুলফিকার আলী আরো অভিযোগ করেন, তিনি প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাননি। ভোটের আগের দিন রাতভর তাঁর কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে দুর্বৃত্তরা হামলা ও মারধর করেছে।
কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. হোসেন ও আলাউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটারদের উপস্থিতি ভালো থাকলেও তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। জোর করে তাঁদের ভোট নেওয়া হয়েছে।’
অপর কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. খোরশেদ আলমের দাবি, র্যাব ও পুলিশের উপস্থিতিতে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
কাউন্সিলর পদপ্রার্থী এমরান হোসেন দাবি করে বলেন, ‘ভোটের অনিয়ম তুলে ধরায় প্রেসক্লাব সভাপতিসহ মিডিয়ার অনেক ভাইকেও লাঞ্ছিত করা হয়েছে।’
এদিকে, দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ভোট বর্জন করা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, তাঁদের ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ইভিএমে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার পর প্রতিপক্ষ উটপাখি ও আনারস প্রতীকের লোকজন জোর করে ভোট নিয়ে নেন। এ ছাড়া তাঁদের এজেন্টকে বের করে দেওয়ার পাশাপাশি কর্মী-সমর্থকদের মারধর ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিচ্ছে প্রতিপক্ষ।
তাঁরা আরো অভিযোগ করেন, সকাল ১০টা পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ভোট গ্রহণ চলে। এরপর থেকে তারা কেন্দ্র দখল করে তাদের নিজস্ব ভোটার এনে ভোট দেওয়াচ্ছে। এতে সাধারণ ভোটাররা তাদের নাগরিক অধিকার ও ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এদিকে এসব অভিযোগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী শেখ আবদুর রহমান দাবি করেন, শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে।
মোস্তাফিজ আমিন, ভৈরব : কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়া ও প্রার্থীর সঙ্গে অসাদাচরণ করার অভিযোগ এনে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বিএনপির প্রার্থী নুরুল মিল্লাত। পৌর শহরের বেতিয়াকান্দি এলাকায় আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম।
নুরুল মিল্লাত অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটের কয়েক দিন আগে থেকে নির্বাচনি পরিবেশ ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। আজ ভোট শুরুর প্রথম ভাগ থেকেই ভোট জালিয়াতির নগ্নচিত্র প্রকাশ পায়। শুরুতে নৌকার প্রার্থীর লোকজনের টার্গেট ছিল ধানের শীষের এজেন্টের দিকে।
নুরুল মিল্লাত বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমার প্রায় সব এজেন্টকে একে একে বের করে দেওয়া হয়। কুলিয়ারচর ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে রাসেল মিয়া নামের আমার এক এজেন্টকে মারধর করা হয়। একই কেন্দ্রে কুলিয়ারচর থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) দ্বারা আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের দুই এজেন্টকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
বিএনপির এই প্রার্থী আরো অভিযোগ করেন, ‘ইভিএমে ভোট প্রক্রিয়া নিয়েও জালিয়াতি করা হয়েছে। প্রথমত, কুলিয়ারচর অগ্রসর পৌরসভা না হলেও ইভিএম দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত সময় মতো প্রচার চালানো হয়নি। আর আজ ভোটের দিন আগে মেয়রকে ভোট দিতে হয়েছে প্রকাশ্যে। পরে কাউন্সিলরদের ভোট দিতে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুদিন আগে আওয়ামী লীগের ইশারায় থানায় মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। মামলায় ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। ভীতি ছড়াতে মামলার আসামি বিএনপির পৌর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শাফিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অবস্থায় ভোটে আস্থা ধরে রাখা যায়নি। সে কারণেই বর্জন ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না।
জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম বলেন, ‘এই সরকার অনেক আগে থেকেই নির্বাচনি সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। ভোট বলতে কিছু নেই। সবই নষ্ট করে ফেলেছে।
কুলিয়ারচর পৌরসভা নির্বাচনে ভোট হচ্ছে ইভিএম পদ্ধতিতে। মেয়র পদে প্রার্থী দুজন। নৌকা প্রতীকের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন সৈয়দ হাসান সারোয়ার। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এ ছাড়া ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব নুরুল মিল্লাত। এর আগে তিনি দুবার এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একবার জয় পান। একবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
এদিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কুলিয়ারচর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটের দীর্ঘ সারি। বিশেষ করে প্রায় তিন শতাধিক নারী ভোটার ভোট দেওয়ার জন্য সারিতে অপেক্ষা করছিলেন। পুরুষ ভোটারদের সারিও ছিল বেশ লম্বা। কেন্দ্রটিতে মোট ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ৪০০। এর মধ্যে সকাল পৌনে ১০টার দিকে ৪ নম্বর বুথে গিয়ে জানা যায়, তখন পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ৪৪ জন। ওই বুথে ভোটার ৩৯০ জন।
সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ফখরুউদ্দিন আকন্দ বলেন, ‘ভোট একটু ধীরগতিতে হলেও ভোটারদের আগ্রহ বেশ আশা জাগানিয়া।’
একই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কাজী সোয়াইব আজমির জানালেন, সকাল ১০টা ১০ মিনিটের মধ্যে কেন্দ্রটিতে ভোট হয়েছে ২৯০টি। এ ছাড়া কুলিয়ারচর ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে গিয়েও ভোটার উপস্থিতির একই চিত্র দেখা যায়।
শ. ম সাজু, রাজশাহী : রাজশাহীর বাগমারার ভবানীগঞ্জ পৌরসভায় কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী আবদুর রাজ্জাক প্রামাণিক। পৌর এলাকায় নিজ বাসভবনে আজ সকালে সংবাদ সম্মেলনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
মেয়রপ্রার্থী আবদুর রাজ্জাক প্রামাণিকের অভিযোগ, আজ সকালে শহিদ সেকেন্দার আলী মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ে ভোট দিতে যান তিনি। কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র থেকে বের থেকে দেয় আওয়ামী লীগের লোকজন। এ ছাড়া নয়টি ওয়ার্ডের কোনোটিতেই তাঁর এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়ায় তিনি ভোট বর্জন করেছেন বলে দাবি করেন। এ ছাড়া এসব অভিযোগে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়েছেন বলেও জানান।
এ বি এম ফজলুর রহমান, পাবনা : ঈশ্বরদী পৌরসভা নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও হামলার অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী রফিকুল ইসলাম নয়ন। আজ দুপুর দেড়টার দিকে সাংবাদিকদের সামনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
এদিকে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী ইসহাক হোসেন হামলার ঘটনা অস্বীকার করে দাবি করেন, ভোটের মাঠে থেকে সরে যেতে বাহানা খুঁজতে অভিযোগ করছেন মেয়র পদপ্রার্থী।
পাবনার ঈশ্বরদী, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও সাঁথিয়া পৌরসভার মধ্যে ফরিদপুর পৌরসভায় ইভিএমে ভোটগ্রহণ চলছে। বাকিগুলোতে চলছে ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ।
রেজ আন উল বাসার তাপস, মেহেরপুর : নানা অনিয়মের অভিযোগে মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভা নির্বাচন বর্জন করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র আশরাফুল ইসলাম। আজ দুপুরে আড়াইটার দিকে ৬ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্রে তিনি এ ঘোষণা দেন।
অভিযোগে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থক ও বহিরাগতরা রাস্তায় ভোটারদের বাধা দেয়। ১, ২,৩, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্রে তারা আমার এজেন্টদের প্রবেশ করতে দেয়নি। আমরা গিয়ে তাদের প্রবেশ করিয়েছি কিন্তু আবারও বের করে দেওয়া হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেটকে অভিযোগ করলেও তাদের কাছ থেকে সদুত্তোর পাওয়া যায়নি।
নিরাপত্তার অভাবে নিজেই ভোট দিতে পারিনি উল্লেখ করে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার পর নৌকার এজেন্ট ও বহিরাগতরা নৌকা প্রতীকে ভোট নিশ্চিত করে নিচ্ছে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট যেহেতু গোপনে দেওয়া যাচ্ছে তা তারা কোনো অভিযোগ করছেন না। এ ছাড়া দুপুরের দিকে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর প্রতীক ছিল না। ইভিএমের প্রতি মানুষের যে আস্থাহীনতা ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে যে এতে কারসাজি করা যায়। সেক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছি তা সুষ্ঠু নিবাচন বলার কোনো সুযোগ নেই। এটি একটি প্রসহনের নির্বাচন এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আমি নির্বাচন বর্জন করছি।’