প্রান্তিক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন উদ্যোক্তা চায় কৃষক
বাংলাদেশে কৃষিপ্রধান দেশ হলেও ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের আবাদ একেবারেই কম হতো। ফলে বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে হতো। তবে সময় বদলে গেছে। বর্তমানে দেশে আবাদ বেড়েছে ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের। সেইসঙ্গে কৃষকের চিন্তা ভাবনায় এসেছে নানারূপ পরিবর্তন। এসব ফসলের মানসম্মত বীজ পেতে প্রান্তিক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন উদ্যোক্তা সৃষ্টির আহ্বান জানাচ্ছে কৃষকরা।
সূত্র বলছে, এসব ফসল আমদানিতে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হতো। এই ব্যয় কমিয়ে আনতে সরকার নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে ওই ফসলগুলোর আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে কমেছে আমদানিও। সাশ্রয় হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার ব্যয়। এমনকি এখন কিছু তেল জাতীয় ফসল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হচ্ছে।
জানা যায়, দেশে খাদ্যঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে শুরু করা হয় সবুজ বিল্পব। তখন ততোটা সুবিধা না হলেও আশার আলো দেখতে থাকে এ দেশের কৃষকরা। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আবাদের সূচনা হতে থাকে বিরি ধানের মাধ্যমে। ফিলিপাইনের প্রযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয় বিরি ধান আবাদ। জাতটি বিরি হলেও কৃষকদের কাছে পরিচিতি পায় ইরি হিসেবে। কিন্তু এ আবাদে সিংহভাগ কৃষক অনিহা প্রকাশ করে।
কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুই একজন কৃষকের জমিতে ইরি ধানের আবাদ প্রচলন করে। সার ব্যবহারে কৃষকদের চরম বিরোধিতা থাকলেও রাতের আঁধারে আবাদকৃত জমিতে কৃষি বিভাগের লোকজন সার দিয়ে আসত। কৃষক ফসল ঘড়ে তোলার পর ফলন ভালো পেয়ে পরামর্শের জন্য কৃষকরা ধীরে ধীরে কৃষি বিভাগে যায়। সাফল্যের কারণে সরকার বিভিন্ন ফসলের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে থাকে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের কৃষিবিদরা বিদেশে গিয়ে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নেন। তাঁরাই দেশে ফিরে প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন করতে থাকেন ধানসহ বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত। ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু পুষ্টিতে পিছিয়েপড়া বাংলাদেশের প্রয়োজন দেখা দেয় পুষ্টিযুক্ত ফসলের আবাদ বৃদ্ধির। যে কারণে দেশে খাদ্যে স্বনির্ভরতা আসার পর পুষ্টিসমৃদ্ধ ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয় সরকার।
বৈদেশিক আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হাতে নেওয়া হয় ‘ডাল তেল ও মসলাবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প’। ২০১৭ সালে গৃহিত এ প্রকল্প থেকে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত থাকলেও এর সুফল পেতে শুরু করেছে দেশের কৃষক। প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত বীজ ব্যবহার করে ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে ফলনও। ফলে দেশের ঐতিহ্যবাহী সরিষার তেল আজও পাওয়া যাচ্ছে দেড়শ টাকা কেজি দরে। উৎপাদিত তিল দেশের চাহিদা পূরণ করেও রপ্তানি করা হচ্ছে চীন ও জাপানে। ঔষধি গুণসম্পন্ন এ ফসলটির আরও বেশি চাহিদা রয়েছে ওই সব দেশে। পেঁয়াজ, রসুনের মানসম্মত বীজ দেশের কৃষকের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব মসলার দাম ক্রয় ক্ষমতার ভেতরে রয়েছে।
আরও জানা যায়, প্রকল্পভুক্ত ফুল জাতীয় শস্য থেকে আহরণ করা হচ্ছে মধু। উৎপাদন বাড়ায় ভারতের ডাবর কোম্পানি বাংলাদেশের মধু আমদানি করছে। পাশাপাশি পরাগায়ণ বৃদ্ধির ফলে প্রায় ২০ শতাংশ ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ সফলতা অর্জনে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সেটা অপ্রতুল বলে মনে করেন প্রকল্পভুক্ত বীজ উৎপাদক পাবনার চাষি বাকী বিল্লাহ, খোরশেদ আলম, আজমত আলীসহ অন্যরা। তাদের দাবি প্রকল্পের মেয়াদ আরও বৃদ্ধি করে অধিকতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন করে বীজ উৎপাদক ও বিক্রেতাকে সনদ দিলে বিদেশ থেকে মানহীন বীজ আমদানি বন্ধ হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের উদ্দেশ্য মাঝপথেই ভেস্তে যেতে পারে।
পাবনা সদর উপজেলার সিঙ্গা গ্রামের বীজ উৎপাদন উদ্দ্যোক্তা কৃষক মফিজুল ইসলাম জানান, এরই মধ্যে দেশে চার হাজার ৫০০ জন সফল বীজ উদ্যোক্তা কৃষক তৈরি হয়েছে। বর্তমানে কৃষিকে পারিবারিক কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত করা হয়েছে। উৎপাদিত বীজ বিক্রি করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। বীজ সংরক্ষণে প্রকল্প থেকে আর্দ্রতা পরিমাপক যন্ত্রসহ কৃষকদের দেওয়া হয়েছে মানসম্মত উপকরণ। ফলে ফসলের আর্দ্রতা পরিমাপ করে ন্যায্যমূল্যে ফসল বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছে কৃষকরা।
পাবনার ভাড়ারা ইউনিয়নের কৃষক কুদরতে গণি জানান, এ প্রকল্প থেকে কৃষকরা লাভবান হয়েছে। মানসম্মত বীজ হাতের কাছে পেয়ে যথাসময়ে ফসল আবাদের সুযোগ পাচ্ছে। প্রকল্পটির মেয়াদ আরও বৃদ্ধির মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক একজন করে বীজ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে পারলে পুষ্ঠির চাহিদা পূরণসহ মানসম্মত বীজের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশ এখন পুষ্টিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চলেছে। এবার তেল, ডাল ও মসলাজাতীয় ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। এর মধ্যে তিলসহ অন্য ফসল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।’