ভৈরবের ৫৭টি খাল-বিল-নালার শত শত একর ভূমি দখলে
তিন দশকে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ৫৭টি খাল-বিল-নালার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। শ্রেণি পরিবর্তিত হয়ে শত শত একর ভূমি চলে গেছে ভূমিদস্যুদের দখলে। ফলে মৎস্যসম্পদসহ জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকিতে। ভরাট করা জায়গায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় ডুবে যাচ্ছে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি। পয়ঃনিষ্কাশনসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেহাল দশা দেখা দিয়েছে।
এসব দখল হয়ে যাওয়া ভূমি বা খাল-বিল, নদী-নালা উদ্ধারে সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, উল্টো ভূমিদস্যুদের উদারনীতিতে সহযোগিতা করে গেছে স্থানীয় ভূমি কার্যালয়। অপরিকল্পিতভাবে নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় আগামীর ভৈরব রূপান্তরিত হবে একটি অবাসযোগ্য নগরীতে, আশঙ্কা এখানকার বাসিন্দাদের।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও কালী নদীর বুক থেকে জেগে ওঠা ভূখণ্ডটির নাম ভৈরব। নদীপথে কলকাতাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সুবাদে ব্রিটিশ বেনিয়াগোষ্ঠীর শাসনামলে ভৈরব খ্যাতি অর্জন করে। ভারতবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও আঞ্চলিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরে ব্রিটিশদের তৈরি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ এবং মেঘনা নদীর ওপর তৈরি বৃহত্তম রেলসেতু ভৈরবকে আলাদা পরিচিতি এনে দেয়।
কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত দেশের বিশাল হাওরাঞ্চলের প্রবেশমুখ খ্যাত এই নদীবন্দরটি একসময় অসংখ্য খাল-বিল-নালায় পরিবেষ্টিত ছিল। কিন্তু হাল আমলে সে অবস্থা আর নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৯৮৫ সালে হয়ে যাওয়া সর্বশেষ ভূমি জরিপের পর এখানকার প্রায় ৫৭টি খাল-বিল-নালার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। একশ্রেণির ভূমিদস্যু ওই জরিপের সময় এইসব খাল-বিল-নালা ও নিচু ভূমিকে নিজেদের নামে রেকর্ডভুক্ত করিয়ে নেয় নিচু ভূমি ও কৃষিজমি হিসেবে।
পরে শ্রেণি পরিবর্তন করে সেগুলো বিক্রি করে দেয় বিভিন্নজনের কাছে। এখন সেইসব জমি বহু হাত বদল হয়ে নগরায়ণে রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি এসব ভূমি হরিলুটকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে ভূমিদস্যুদের সহায়তা করেছেন ভূমি কার্যালয়েরই একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
আইন ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভূমিদস্যুদের অবৈধভাবে দখল করা এসব খাল-বিল, নদী-নালার ভূমি সরকারি জিম্মায় ফিরিয়ে এনে পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে ভৈরবকে বাসযোগ্য নগরে রূপান্তরে সরকারের উচ্চমহলের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম রিপন, ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন, সমাজকর্মী মাসুদ রানা আকন্দ ও সংবাদকর্মী মো. বিল্লাল হোসেন মোল্লা।
এদিকে উপজেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, স্থানীয় মনামরা খাল, বাগানবাড়ির মেঘনার খাড়ি, গাছতলাঘাটের খাল, চণ্ডীবের দক্ষিণপাড়ার খাল, কালীপুর ও চণ্ডীবেরের মাঝখানের সুতিরবিল, পলতাকান্দার খাল, শম্ভুপুরের আলুকান্দার খাল, কমলপুরের সাতমুখীর বিল, বালাবিল, আমলারপাড়া খাল, তাতারকান্দির খাল, রানীর বাজারের রানীর পুকুর, কাঠপট্টির মেঘনার খাড়ি, পঞ্চবটীর পূর্ব ও পশ্চিমের কানাইখাল, নিউ টাউন, নাটালের পেছনের বিল, আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালের পেছনের ডোবা, রসূলপুরের নবুরবাড়ির খাল, সাদেকপুরের নাপিতবাড়ির খাল এরই মধ্যে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে।
বর্তমানে রামশংকরপুরের বাদশাবিলের কিছু অংশসহ আগানগর, গজারিয়া ও শিমুলকান্দি ইউনিয়নের ১০টি বিলের মাত্র ৭৫ দশমিক ৬৩ একর ভূমি সমবায়ভিত্তিক বন্দোবস্ত নিয়ে মাছ শিকার করছেন জেলেরা। যা এলাকার মাছের চাহিদা পূরণ এবং জেলে সম্প্রদায়ের জীবনযাপনে খুবই অপ্রতুল।
জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. লতিফুর রহমান বলেন, মনুষ্য এবং প্রাকৃতিক সৃষ্ট কারণে এলাকার খাল-বিল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ ও এখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
এরই মধ্যে বেশ কয়েক প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে উল্লেখ করে লতিফুর রহমান আরো বলেন, অবৈধ দখলে চলে যাওয়া খাল-বিল উদ্ধার করা গেলে মাছের অবাধ বিচরণ সম্ভব হবে এবং মাছের উৎপাদন বাড়বে।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে ভৈরব পৌরশহরে চার একর সমতলভূমি ব্যক্তিমালিকানায় ইজারা দেওয়া হয়। তখনকার সময় ১৫ বছর মেয়াদে ইজারা দেওয়া হতো। সে সময়ে ইজারা নেওয়া ওইসব ভূমি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভূমি কর্মকর্তা জানান, সাব-রেজিস্ট্রি ও উপজেলা ভূমি কার্যালয় আলাদা থাকায় অসাধু ব্যক্তিরা সহজেই ভুয়া দলিল তৈরি করে কেনাবেচা করে ফেলতে পারে। ভূমির দলিল করার আগে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় থেকে তদন্ত হলে এই অপতৎপরতা কমে যেত।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্র আরো জানায়, উপজেলায় বর্তমানে কৃষি খাসজমির পরিমাণ ৫৮৩ দশমিক ৭৩ একর। বন্দোবস্ত দেওয়া আছে ৩৯১ দশমিক ৫৯ একর। আর অকৃষিজমির পরিমাণ ২২ দশমিক ৩৩ একর। এর মধ্যে বন্দোবস্ত দেওয়া আছে দশমিক ০৭২ একর। ২০ একরের বেশি আয়তনের বন্দোবস্তের অযোগ্য (নদী তীরবর্তী) খাসজমির পরিমাণ দুই হাজার ৭১৭ দশমিক ৪০ একর।
ভৈরবের খাল-বিল, নদী-নালা অবৈধভাবে দখল ও ভরাটের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানা বলেন, ‘সরকার খাল-বিল, নদী অবৈধ দখলমুক্ত করার বিষয়ে এখন অনেকটা সোচ্চার। এ জন্য একটি নদীরক্ষা কমিশনও গঠন করেছে। এই নদীরক্ষা কমিশন দখল ও দূষণ নিয়ে বেশ কয়েকটি কর্মশালা করেছে। গত বছর কিশোরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে এ নিয়ে কর্মশালা হয়। সেখানে ভৈরবের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অংশ নেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নদীরক্ষা কমিশনের একটি দল এরই মধ্যে ভৈরবে পরিদর্শন করে দখল ও দূষণের পরিমাণ কী, সেটা দেখে গেছে। এই কমিশন এতই শক্তিশালী যে আমাদের নিয়মিত ত্রৈমাসিক রিপোর্ট কমিশনে জমা দিতে হচ্ছে। এই সপ্তাহেই আমাকে একটি রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছে। আমি সেই রিপোর্টে জানিয়েছি যে কার্যক্রম চালু আছে।’
ইউএনও আরো বলেন, ‘আমরা এখানকার নদী-নালার অবৈধ দখলের একটি তালিকা তৈরি করছি। পাশাপাশি যাঁরা ইজারা নিয়েছেন, তাঁরা শর্তভঙ্গ করছেন কি না, সেটিও দেখছি। এভাবে অবৈধ দখলের তালিকা তৈরি করে আমরা উচ্ছেদ নোটিশ তৈরি করে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে উচ্ছেদের অনুমতি প্রার্থনা করব এবং উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাব।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ইউএনও এখানে অবৈধ দখল আছে স্বীকার করে বলেন, ‘এটি চলতি পথেই আমার নজরে এসেছে। তা ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপেই আমরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’ তবে এই কার্যক্রম চালাতে একটু সময় লাগবে বলে তিনি জানান।