মনিপুরীদের ‘থাবল চুম্বা’: নৃত্যের তালে খোঁজে জীবনসঙ্গীকে

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ভানুবিল মাঝেরগাঁওয়ে উদযাপিত হলো মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘থাবল চুম্বা’ উৎসব। নানা বয়সী অবিবাহিত তরুণ-তরুণীরা ভাব বিনিময় করতে দলবেঁধে বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করে উন্মুক্ত মঞ্চে। তারা বিশেষ ধর্মীয় গানের সঙ্গে নৃত্যের তালে খুঁজতে থাকে জীবনসঙ্গীকে। সুনিপুণ এমন নৃত্য মুগ্ধ করে সব বয়সী মানুষকে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যার পর গানের সুর শুনে মনের টানে ছুটে আসে মণীপুরী তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সের লোকজন। সবাই জড়ো হলে রাত ১০টার দিকে মূল আর্কষণ ‘থাবল চুম্বা’ উৎসবে শুরু হয় নৃত্য।

ভানুবিল মাঝেরগাঁওয়ের উন্মুক্ত মাঠে মঞ্চ করে প্রতি বছরের মতো এ বছরও আয়োজন করা হয় ‘থাবল চুম্বা’ অনুষ্ঠানের। তৈরি করা বৃত্তাকার প্যান্ডেলের মঞ্চে প্রথমে নৃত্য করতে নামে নিজ গ্রামের অবিবাহিত তরুণীরা। এরপর নৃত্য করতে প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তরুণরা। পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে মিল রেখে দোলপূর্ণিমার রাতে ‘থাবল চুম্বা’ নামের মিলন মেলায় প্রায় দুই শতাধিক তরুণ- তরুণী একসঙ্গে নৃত্য করে।
নৃত্যে অংশগ্রহণকারী অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রসেনজিৎ শর্মা, চিংকেই সিংহ, কুঞ্জবর্তী সিংহ, পূর্ণিমা দেবী ও মল্লিক সিংহ অভিমত প্রকাশ করেন জানান, রোমাঞ্চকর এ অনুষ্ঠানে বছরে একবার তাদের চিরাচারিত কাঙ্ক্ষিত ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে পেরে আনন্দিত।

অপরদিকে, অভিভাবক বিশ্বজিৎ সিংহ ও মনি সিংহ জানান, ঈশ্বরের সন্তুষ্টি পেতে একইভাবে তরুণ-তরুণীরা আসে তাদের আয়োজনের এ মিলন মেলায়। সেইসঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আসে বহু দর্শনার্থী।
প্যান্ডেলের মধ্যখানের গোল বৃত্তে বসা দেশ-বিদেশে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ষাটোর্ধ্ব একজন শিল্পী ‘থাবল চুম্বা’ অনুষ্ঠানের গান পরিবেশন করেন। ওই শিল্পীর সঙ্গে থাকা আধুনিক বাদকদলের সদস্যরা ছিলেন তরুণ। অনেক দূর থেকে কানে আসে সেই গানের সুর ও বাদ্যযন্ত্রের টান।

ভানুবিল মাঝেরগাঁও কমিউনিটি বেইজ টুরিজমের পরিচালক নিরঞ্জন সিংহ রাজু জানান, মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরুরা জানান, তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবনসঙ্গীকে খোঁজার জন্য মূলত ‘থাবল চুম্বা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন। এটা যুগযুগ ধরে হয়ে আসছে। নিজ এলাকায় আয়োজনস্থলে অভিবাবকরা তাদের তরুণী কন্যাকে নিয়ে যান। অন্যদিকে, নিজ এলাকা ছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে তরুণরা আসে পছন্দের জীবনসঙ্গীকে বেছে নিতে। একে অপরের হাত ধরে নৃত্যের ফাঁকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কথোপকথন ও ভাব বিনিময়। শেষ পর্বে কড়া নিয়ম-রীতিতে হাতের বন্ধন শক্ত করে ড্রাগন আকৃতিতে সৃষ্টিকর্তার নামে উৎসর্গ করা হয় ব্যতিক্রমী এ নৃত্য। এ ধরনের আয়োজনের কারণে ছেলেমেয়েরা তাদের পছন্দের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়াতে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ খুবই কম হয়ে থাকে।
ছোট বড় মিলিয়ে কমলগঞ্জের ১৪টি গ্রামে উৎসব হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে অনেকেই আয়োজন করেনি। ‘থাবল চুম্বা’ নামের উৎসবের আমেজ চলবে ১৫ দিনব্যাপী। একে অপরের বাড়িতে নিমন্ত্রণে যাবে আর সেইসঙ্গে চলবে হোলি খেলা।