মা-বাবা ও ভাই-বোন হারানো শিশুটির দায়িত্ব নিলেন ডিসি

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ঘরে ঢুকে স্বামী-স্ত্রী ও তাঁদের দুই সন্তানকে হত্যার ঘটনার পর থেকে ঘটনাস্থল ওই বাড়িতে এখনো কৌতুহলী মানুষের ভিড় কমেনি। সাতক্ষীরা-যশোর সড়কধারের পুরো বাড়ি ও পাড়াজুড়ে থমথমে ভাব বিরাজ করছে।
এদিকে এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া চারমাসের শিশু মারিয়া সুলতানার দায়িত্বভার নিয়েছেন সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস এম মোস্তফা কামাল। তিনি ওই শিশুর চিকিৎসা ও বেড়ে ওঠার সব ব্যয়ভার বহন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শিশুটি বর্তমানে হেলাতলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত আসনের সদস্য নাসিমা খাতুনের কাছে রয়েছে।
ডিসি মোস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমি এই শিশুর দায়িত্ব নিলাম। ওর স্বাস্থ্যসেবা ও বেড়ে ওঠার জন্য যত ব্যয়, সব আমি বহন করব। আপাতত শিশুটিকে হেলাতলা ইউপি সংরক্ষিত আসনের সদস্য নাসিমা খাতুনের জিম্মায় দিলাম।’
এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে শাহীনুর, তাঁর স্ত্রী সাবিনা খাতুন, ছেলে সিয়াম হোসেন মাহী ও মেয়ে তাসনিম সুলতানার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নিকটস্থ ব্রজবাকসা গ্রামে শাহিনুরের মামা আবদুল কাদেরের পারিবারিক গোরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শাহিনুরের ভাই রায়হানুল পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। তাঁকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে এ রোমহর্ষক ঘটনায় কলারোয়া থানায় মামলা করেছেন শাহিনুরের শাশুড়ি ওফাপুর গ্রামের ময়না বেগম। মামলায় তিনি কারো নাম উল্লেখ না করেই বলেন, কে বা কারা ওই চারজনকে গলাকেটে হত্যা করেছে।
কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারান চন্দ্র পাল জানান, মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব সিআইডির ওপর দেওয়া হয়েছে।
মামলা প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, তিনি আজই তদন্তে নামবেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে কলারোয়ার হেলাতলা ইউনিয়নের খলসী গ্রামে সন্ত্রাসীরা মাছের ঘের ব্যবসায়ী মো. শাহীনুর রহমান (৪০), তাঁর স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩০), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহী (৯) ও মেয়ে তাসনিম সুলতানাকে (৬) গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তারা ওই পরিবারের চার মাসের শিশু মারিয়াকে হত্যা না করে ফেলে রেখে যায়।
স্থানীয়রা জানান, ভোরে তাঁরা ওই বাড়ির চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ছুটে যান। পরে দরজা খুলে দেখতে পান, সাবিনা খাতুন, তাঁর দুই শিশুসন্তান তাসনিম ও মাহী একঘরে এবং আরেক ঘরে শাহীনুরের গলা কাটা লাশ।
শাহীনুরের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম জানান, তিনি গোঙানির শব্দ শুনে ছুটে যান। পরে সবাইকে খবর দেন। তিনি জানান, হত্যাকারীরা সিঁড়ির ঘর দিয়ে ঢুকে পরিবারের চারজনকে খুন করে দরজায় শিকল দিয়ে চলে যায়।
হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। সকাল ১০টা পর্যন্ত লাশগুলো ঘরেই ছিল। সেখানে পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিট কাজ করছে বলে সংবাদকর্মী ও অন্য কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
রায়হানুল ইসলাম আরো জানান, তাঁর বড় ভাই শাহীনুর ইসলাম নিজস্ব সাত-আট বিঘা জমিতে পাঙাশ মাছ চাষ করতেন। ২২ বছর ধরে তাঁদের পারিবারিক সাড়ে ১৬ শতক জমি নিয়ে নিকট প্রতিবেশী ওয়াজেদ কারিগরের ছেলে আকবরের সঙ্গে মামলা চলছিল। এ মামলা ও পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে বলে তাঁর ধারণা।
পরিবারের স্বজনেরা জানান, শাহীনুরের বাবা ডা. শাজাহান আলী কলারোয়ার দামোদরকাটী গ্রামের নূর আলীর ছেলে আকবর হোসেনের কাছ থেকে ৩৪ শতক জমি কেনেন। এই জমির ক্রেতা ছিলেন ডা. শাজাহান ও তাঁর প্রতিবেশী ওয়াজেদ আলীর ছেলে আকবর।
ঘটনাস্থলে এসে জানা গেছে, জীবিত থাকা একমাত্র শিশুকন্যা চার মাস বয়সী মারিয়া সুলতানাকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নাসিমা খাতুন নিয়ে যান। পরে তিনি তাকে আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল নিহত শাহীনুরের মা শাহিদা খাতুন (৬০) আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। শাহীনুরদের তিন ভাইয়ের এক ভাই আশরাফুল মালয়েশিয়া থাকেন। তাঁদের বোন আছিয়া খাতুন বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন। তিনি বলছেন, ‘আমার মা ও আরেকটা ভাই এখানে থাকলে তাদেরও খুন করত সন্ত্রাসীরা।