মেয়র আইভীর শেষ অফিস
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আজ মঙ্গলবার শেষ অফিস করেছেন। পরে বিকেলে তিনি পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে।
আসন্ন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিতে আগামীকাল বুধবার দুপুরে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন বলে জানিয়েছেন আইভী।
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো নারায়ণগঞ্জ পৌর সভার চেয়ারম্যান, ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ২০১৬ সালেও তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আইভীর পারিবারিক পরিচয়
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা। তিনি (চুনকা) স্কুলজীবনেই আওয়ামী লীগের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে গুরুর্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের ছাত্র-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৮ সালে আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক-জনতাকে সংগঠিত করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। (মুক্তিযুদ্ধ ক্রমিক নং- ১১৩৮, পৃষ্ঠা নং- ৪৯৯৫, বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত, ২৯ শে মে ২০০৫ খ্রি.)।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতে ২৬ মার্চ আলী আহাম্মদ চুনকার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জে অস্ত্রাগার লুট করেন। যা দিয়ে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের আগরতলার রাজবাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি আগরতলা ও মেঘালয়ের ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থীদের খাবার-দাবার, চিকিৎসা ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব পালন করতেন।
আলী আহাম্মদ চুনকা ১৯৬২ সালে দেওভোগ ইউনিয়ন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিডি মেম্বার নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল শহরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও উন্নত নাগরিক সেবার মান যথেষ্টভাবে বৃদ্ধি করা। ফলে ১৯৭৭ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে তিনি পুনরায় বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯৮৪ সাল) তিনি একাধারে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া বালুর মাঠে প্রথম গণসংবর্ধনা প্রদান করেন এবং “নগরের চাবি” তাঁর হাতে তুলে দেন। তিনি দলের দুঃসময়ে সংগঠক হিসেবে এবং তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।
পরবর্তী সময়ে তাঁরই কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে ২০০৩ সালের ১ মে নারায়ণগঞ্জ ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘নগরের চাবি’ তুলে দেন।
দেওভোগ আলী আহাম্মদ চুনকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আইভীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু। পরে তিনি মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ অর্জন করেন এবং ১৯৮২ সালে এসএসসি পাস করেন। পরে নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এইচএসসি পাস করেন।
১৯৮৫ সালে রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে ওডেসা পিরাগোব মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১৯৯২ সালে ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রি লাভ করে। ১৯৯২-৯৩ সালে ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন।
শৈশব থেকেই অবহেলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি আইভীর ছিল অগাধ মমতা ও ভালোবাসা। জীবনের বিভিন্ন পর্বে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধের প্রতিফলন ঘটেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি।
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী একদিকে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এবং অন্যদিকে সমাজের নিম্নস্তরের অবহেলিত বৃহত্তর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।