ভাবনায় মধ্যবর্তী নির্বাচন!
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা নিয়মিত নিজ নিজ এলাকায় যাচ্ছেন। একই কাজ করছেন সরকারের মন্ত্রীরা। দলের জেলা সম্মেলন প্রায় শেষের পথে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দলকে গতিশীল করে করে তুলতে এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চলছে। তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এটা নির্বাচনী প্রস্তুতি। নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়ার ইচ্ছে আছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর দুই নেতা বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের ভেতরে। সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলেই নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন।
এই দুই নেতা আরো বলেন, বিএনপির একটি অংশ সেই নির্বাচনে অংশ নেবে।
সাংগঠনিক তৎপরতার মোড়কে নির্বাচনী প্রস্তুতি
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী দুই নেতার মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন দিয়ে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রচার করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়তো সম্ভব হবে কিন্তু আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে বশে রাখা সরকারের জন্য একটা সময় কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। বিদেশি শক্তিগুলো আরেকটি নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই সহজে নির্বাচনী ‘বৈতরণী’ পাড়ি দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের কৌশল নিচ্ছে।
সম্মেলন, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ।
দলের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনমুখী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সাংগঠনিক কাজে মন দিয়েছে।
অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এর অংশ হিসেবেই সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বিএনপি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আমার মনে হয় না বিএনপি দেশের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে সমর্থ হবে।’ জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে জাফর উল্যাহ বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনে, দেশের কল্যাণে এ দেশে সব কিছুই হতে পারে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শই হলো এটি।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময় সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে রাখে। যখন যেটি প্রয়োজন, তখন সেটির প্রয়োগ হয়।’
সাংগঠনিক তৎপরতার আড়ালে নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে সংসদ সদস্যরাও নিজ নিজ এলাকায় যাওয়া-আসার মাধ্যমে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্র থেকেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে সংসদ সদস্যরা জানান।
আওয়ামী লীগের রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জয়পুরহাটের সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘দলকে গতিশীল ও সুসংহত করতে আমরা সাংগঠনিক কাজে মনোনিবেশ করেছি।
আমরা জেলা সম্মেলন, উপজেলা সম্মেলন, ইউনিয়ন সম্মেলন করছি।’ তিনি বলেন, ‘দলের সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় যাতায়াত করছেন, গণসংযোগ করছেন। কেন্দ্রীয় নির্দেশে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা শুরু করেছেন।’
রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দিনাজপুরের সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দলকে দৃঢ় করার জন্যই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি জানান, ৬০টি জেলা সম্মেলন শেষ হয়েছে। আর উপজেলা সম্মেলন শেষ হয়েছে ৯০ শতাংশ।
নির্বাচনে অন্যরকম বিএনপি?
ওই নির্বাচনে কেমন বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগ সে ব্যাপারেও কাজ করছেন কয়েকজন নেতা। তাঁদের দাবি, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ আনা বিভিন্ন অভিযোগের বিচারকাজ চলছে। তাঁর দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাজাপ্রাপ্ত হলে খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ হারাবেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান পরিবারের অন্যতম দ্বিতীয় নেতৃত্ব ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুর্নীতির দায়ে দেশের বাইরে থাকায় আপাতত তারেককে নিয়ে ভাবছেন না ক্ষমতাসীনরা।
এ ছাড়া বিএনপির প্রভাবশালী যেসব নেতা বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত, তাঁদের নেতৃত্বে আরেকটি বিএনপি দাঁড় করানোর প্রক্রিয়াও চলছে। প্রায় নিয়মিত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা বিএনপির এসব নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সূত্রে আরো জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীকে দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ। জামায়াত থেকে আলাদা হওয়ার ঘোষণা বিএনপির মূল নেতারা নিজেরাই ঘোষণা করুক সেটাই চাইছে ক্ষমতাসীনরা। এসব কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা কাজ করছেন।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত ১৯ মে শেরপুরে আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ ‘অন্য রকম’ নির্বাচনের ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন একটি অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে।’ এ সময় কৃষিমন্ত্রী ও শেরপুরের সংসদ সদস্য মতিয়া চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, সম্প্রতি শেষ হওয়া ব্যর্থ আন্দোলন কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে বিএনপির সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের ভেতরে আস্থা-বিশ্বাসের সংকট তৈরি করেছে। মনোবল দুর্বল করেছে সাধারণ সমর্থকদের।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বদলানোরও কথাবার্তা চলছে বিএনপির অভ্যন্তরেই। এই মুহূর্তে বিএনপি ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগে আসার জন্য একটি অংশ যোগাযোগও রক্ষা করে চলেছে। বিএনপির তৃণমূলেও রয়েছে দলবদলের একটি প্রস্তুতি। এসব আওয়ামী লীগের জন্য বাড়তি শক্তি সঞ্চয় করছে বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা মনে করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম সরাসরি বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন কোনো ‘ফ্যাক্টর’ নয়। গত তিন মাসের ব্যর্থ ও অবৈধভাবে জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা করে বিএনপি জনবিচ্চিন্ন দল হিসেবে পরিণত হয়েছে।
নাসিম বলেন, এখন বিএনপির ভেতরেই নেতৃত্ব নিয়ে আস্থা-বিশ্বাসের সংকট দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি সব সময় ‘ভাঙা-গড়ার দল’ মন্তব্য করে নাসিম বলেন, সামনেও ভাঙতে পারে। তবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে কোনো পরিকল্পনা নেই।