আওয়ামী লীগ দিয়ে জামায়াতের শোধন!
চলতি বছর সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রায় পাঁচ হাজার নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বিএনপিসহ আরো কয়েকটি দল ধরলে সংখ্যাটি প্রায় ২০ হাজার। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুসারেই জামায়াতের লোকজনদের আওয়ামী লীগে নেওয়া হচ্ছে।
এসব যোগদান অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে। সেই দলটিরই নেতাকর্মীদের যোগদান নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেই কথা উঠেছে।
কুষ্টিয়া দিয়ে শুরু
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই কুষ্টিয়াতে শুরু হয়েছিল এ দলবদল প্রক্রিয়া। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের রোকন নওশের আলী স্থানীয় যুবলীগ আয়োজিত এক নির্বাচনী সভায় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
চলতি বছর ১২ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা আফজাল হোসেন পিন্টু আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
গত ৬ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা জামায়াতের মজলিসে শুরার কর্মপরিষদ সদস্য আব্দুস সালামের নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা দেয়। সংবাদ সম্মেলনে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদু উপস্থিত ছিলেন।
১০ এপ্রিল রাজশাহীর বাগমারায় আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে ফুল দিয়ে উপজেলা জামায়াতের প্রাক্তন সেক্রেটারি এবং ভবানীগঞ্জ মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম শতাধিক সমর্থক নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
বাদ নেই দেশের পূর্বাঞ্চলও
১৪ এপ্রিল কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বাংলা বর্ষবরণের এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সহস্রাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেয়।
গত ২৪ মে নোয়াখালীতে বিএনপি ও জামায়াতের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
৯ মে গাজীপুরের টঙ্গীতে বিএনপি নেত্রী ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর রিনা হালিম এবং স্থানীয় জামায়াত নেতা মাওলানা শরীফ হোসাইনের নেতৃত্বে বিএনপিও জামায়াতের দুই শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
টঙ্গির বোর্ডবাজার এলাকায় শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেলের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এ প্রসঙ্গে জাহিদ আহসানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি শেরবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও ভারতের খেলা দেখায় ব্যস্ত বলে জানান।
৫ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ইউনিয়ন জামায়াতের সহসভাপতি সাব্বিরুল হক তালুকদার শামীমের নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
সংশোধিত হতে আওয়ামী লীগে!
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘কোন দল বা সংগঠনের কেউ নিজেদের ভুল বুঝে নিজেদের শোধরানোর সুযোগ চাইলে, আমি মনে করি, সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। শুধু জামায়াত নয়, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। আওয়ামী লীগ কেবল তাদের শোধরানোর সুযোগ দিচ্ছে।’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে ওই দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ’৭১ পরবর্তী যাদের জন্ম তাঁদের মধ্যে যারা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তারা ভুল করে এ সংগঠনের নেতা হয়েছেন। এখন তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝে সংশোধনের পথে আসতে চান। আওয়ামী লীগ সে সুযোগ না দিলে তাঁরা পথ ভ্রষ্ট হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘জামায়াতের নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে, এটা সত্যি। আর এ ঘটনাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখলে চলবে না।’ তিনি বলেন, ‘জামায়াতের নেতাকর্মীরা এতদিন পর বুঝতে পেরেছে, জামায়াত ইসলামী একটি অসাড় সংগঠন। এ দলের নেতাকর্মী হয়ে নিজেরা এতদিন ভুল করেছে। তাঁরা সেই ভুল থেকে নিজেদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চায়। সুতরাং সেই সুযোগ আওয়ামী লীগ কেন দিবে না?’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামায়াত নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদান একেবারে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশে যোগদানের ঘটনা ঘটছে। যোগদান অনুষ্ঠানগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় নেতা এবং অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দুই জন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সম্পাদকমন্ডলীর দুই জন নেতা নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্তেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে জামায়াত জায়েজ।’ তাঁরা জানান, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ‘সবুজ সংকেত’ না থাকলে যেসব জেলায় জামায়াত নেতারা আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন, সেসব জেলার আওয়ামী লীগ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা প্রশ্নের মুখে পড়তেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হত।
যেহেতু এ ধরণের কোন ঘটনা এখনো দেখা যায়নি, সেহেতু কেন্দ্রীয় ইঙ্গিত রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নেতাদের ঘাড়ে মাথা কয়টা যে দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া জামায়াত নেতাকর্মীকে দলে ভেড়াবেন। যেখানে যারাই যোগ দিচ্ছে, তার আগেই বিষয়টি দলের শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করা হয়। সেখান থেকে সবুজ সংকেত পেলেই কেবল যোগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজি জাফরউল্যাহ বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় জানতে পারছি, জামায়াত করা কিছু নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে এসব যোগদান হচ্ছে কি না এ ব্যাপারে এখনো স্পষ্ট কিছু বলতে পারছি না। হলেও হতে পারে।’
হতাশ অন্য অংশ
আওয়ামী লীগে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের যোগ দেওয়ার বিষয়ে দলের একাংশ হতাশা প্রকাশ করেছে। জামায়াত নেতাদের যোগদানে অখুশী এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ ধরণের ঘটনা আমি একেবারেই মেনে নিতে পারছি না। জামায়াত নেতাদের কী করে আওয়ামী লীগে ভিড়ছে, এটা আমার বোধগম্য নয়। এরা আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শেই বিশ্বাস করে না। এরা কী করে আওয়ামী লীগে নাম লেখায়? এরা এক সময়ে আওয়ামী লীগের গলার ফাঁস হবে।’
জামায়াতের নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে ভেড়ানোর বিষয়টি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকেও ব্যথিত করেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় জামায়াত নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদানের খবর সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই। এটি দুঃখজনক। এটি সুখকর হবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমি জানি না আওয়ামী লীগে জামায়াতের নেতাদের যোগদান কতখানি সত্য। যদি সত্য হয়, এটি দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক থাকতে পারে না। যদিও কেউ যোগদান করে সেটি গোপনীয়। আওয়ামী লীগের মুলধারায়, প্রবাহে এরা স্থান পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’