‘আমি এহন জ্যান্ত লাশ’
অশীতিপর বৃদ্ধ রিজিয়া বেগম। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের এই মায়ের বড় অবলম্বন ছিলেন মিজানুর। গত বছরের ৪ আগস্ট পদ্মায় পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনায় মৃত্যু হয় ছেলে, ছেলের বউ ও এক নাতনির। নিখোঁজ থাকে আরেক নাতনি। এই শোকে মিজানুরের বাবাও কিছুদিন পর মারা যান। ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনিদের ছবিই এখন রিজিয়া বেগমের নিত্যসঙ্গী। এই ছবি দেখেন আর কাঁদেন।
urgentPhoto
পাশের ইউনিয়ন সন্ন্যাসীরচরের ফরহাদের পরিণতি আরো ভয়াবহ। ফরহাদসহ পরিবারের চারজনের কারোরই লাশ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া পিনাক-৬ ডুবির ঘটনায় শিবচর পৌর এলাকার মো. নুরুল হক মিয়ার শিকদার মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ে নুসরাত জাহান হিরা ও রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা স্বর্ণার মৃত্যু হয়। দুজনের সঙ্গে নুরুলের ভায়রার মেয়ে চীনের জইনুস মেডিকেল কলেজের ছাত্রী জান্নাতুল নাঈম লাকি থাকলেও তাঁকে আজও পাওয়া যায়নি।
পিনাক-৬ ডুবির ঘটনায় সরকারি হিসাবে অর্ধশতাধিক আর বেসরকারি হিসাবে শতাধিক লোক নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের পরিবারের কাউকেই দেওয়া হয়নি ঘোষিত ক্ষতিপূরণ। আর উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে নিহত ও নিখোঁজদের পরিবারগুলোর অনেককেই মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাদারীপুরের কাওরাকান্দি ঘাট থেকে পিনাক-৬ লঞ্চটি উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মাওয়াঘাটের কাছাকাছি পদ্মা নদীতে ডুবে যায়। সরকারি হিসাবে ওই ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২১টি লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আর ২৮ জনকে শিবচর পৌরকবর স্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।
বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার ছেলে, ছেলের বউ, এক নাতনি মারা গেছে ওই লঞ্চডুবিতে। তিনজনের লাশ পাইছি। আরেক নাতনির লাশ আজো পাই নাই। এই ছেলেই ছিল আমার সংসারের আলো। ওর শোকে ওর বাপও কয়দিন পরই মারা গেছে। আমি এহন জ্যান্ত লাশ।’
সপরিবারে নিখোঁজ ফরহাদের ছোট ভাই শিশু মিয়া বলেন, ‘একটা লাশ পাইলেও মনডারে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আর সরকার টাকা তো দূরে থাক কোনো খবরও নেয় নাই।
নিহত স্বর্ণা ও হিরার বাবা নুরুল হক বলেন, নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের দাবি, নিরাপদ নৌপথের। আর যেন এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার কাউকে না হতে হয়। সরকারকে অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে জোরালো দাবি জানিয়েছেন নুরুল হক।
লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের সরকারি সাহায্য না দেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পরিচালক ভোলানাথ দে বলেন, ‘প্রমাণ ছাড়া কাউকে তো ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায় না। প্রমাণ তো লাগবে।’
পিনাক-৬ দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রধান ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর উর রহমান বলেন, ‘আমরা পিনাক-৬ দুর্ঘটনার পর নৌপথে দুর্ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনতে অনেক সুপারিশ করেছি। পিনাক-৬ আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। তাই সুপারিশ বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। যার প্রমাণ এ বছরের ঈদে নৌ ব্যবস্থাপনা। লঞ্চঘাটগুলোতে পরিদর্শকসহ জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। চালকদের প্রশিক্ষণসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’