এপারে শোক, ওপারে আনন্দ
এক মাস হয়নি এখনও। মাত্র কদিন আগের কথা। তখনও তারা ছিলেন ছিটমহলের বাসিন্দা। কদিনের ব্যাবধানে এখন মুক্ত স্বাধীন দেশে স্বাধীনতায় বাঁচার আনন্দের স্বাদ উপভোগ করছেন তাঁরা। এর মধ্যেই এসেছে শোকাবহ ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কালো দিনটি। এদিনেই আবার ওপারে বইছে আনন্দের নহর। কারণ একই দিনেই যে ভারতের স্বাধীনতা দিবস।
‘৭৪ এর চুক্তি ছিটবাসীর মুক্তি, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ছিটবাসীর মুক্তি’- বাংলাদেশ ও ভারতের ভুখন্ডের মধ্যে থাকা ছিটমহলের মানুষ গত প্রায় চার দশক ধরে মূলত এই শ্লোগান দুটি ধরেই অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পেতে আন্দোলন করে আসছিলেন। তাদের দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চুক্তির বাস্তবায়ন। সেই দাবি বাস্তবায়নের পর নতুন করে ‘দেশ’ পাওয়া এসব মানুষ মনে করেন ওই দুইজন বিখ্যাত মানুষই প্রথম তাদের মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। তাই এতদিন তাদের যে কোন আন্দোলন কর্মসূচির শুরুতেই উঠে আসতো ওই দুইজনেরই নাম।
তবে এবার প্রথম বাংলাদেশের সাথে সাথে সদ্য বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলবাসীরা পালন করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী বা জাতীয় শোক দিবস। দিবসটি পালনে শনিবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ‘উত্তর গোতামারী ছিটমহল’ তথা গোতামারী গ্রামে পালন করা হয় নানা কর্মসূচি।
শনিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি বাড়ির উঠানে বসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলছে আলোচনা সভা। সভায় বক্তব্য রাখেন স্থানীয় বাসিন্দা ছকবর আলী, প্যানকাট বর্মণ ও আজিজুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। বক্তারা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে যেমন বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, তেমনি সদ্য ইতিহাস হয়ে যাওয়া ছিটমহলের বাসিন্দারাও তাদের বন্দিদশা থেকে কখনোই মুক্ত হতো না।’ তাই তারা আজীবন জাতীয় শোক দিবস পালন করবেন বলেও ঘোষনা দেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ছকবর আলী (৭৪) বলেন, ‘আমরা ৬৮ বছর পর স্বাধীনতা পেয়েছি, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর জন্য। তাই আজ বাংলাদেশি হিসেবেই দিনটিকে আমরা পালন করছি’।
ছিটমহল আন্দোলনের সাবেক নেতা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি আমাদের মুক্তি দিয়েছে। আন্দোলন করতে গিয়ে ওই নাম দুটি আমরা লাখো, কোটিবার উচ্চারন করেছি। আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরাও জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করলাম।’
গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই ছকবর আর আজিজুলরা পরিচিত ছিল কাঁটাতারের ওপারে ভারতের কোচবিহার জেলার মানুষ হিসেবে। তবে ছিটমহল বিনিময়ের সময় তাঁরা বেছে নেন এ দেশের নাগরিকত্ব আর তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মতো তাঁরা পালন করলেন মহান নেতার শাহাদাৎ বার্ষিকী।
অপরদিকে তাদেরই মতো যেসব মানুষ কোচবিহারের ভেতরের ছিটমহলে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাঁরা সেদেশেরই নাগরিকত্ব বেছে নিয়েছিলেন। গতকাল তারা তাই নানা আয়োজনে আর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করলেন ভারতের ৬৯তম মহান স্বাধীনতা দিবস। কোচবিহার জেলার বিভিন্ন এলাকায় থাকা সদ্য বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহলে সদ্য ভারতীয় হওয়া মানুষগুলো আয়োজন করে নানা কর্মসূচি। আর দিনহাটার ‘কিসামত বাত্রিগাছ ছিটমহলে’ কোচবিহার জেলা পুলিশ আয়োজন করে বর্ণঢ্য কর্মসূচি। কোচবিহারের সংবাদকর্মী ও ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দাদের সাথে ফোনে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে এক প্রকার জোর করেই তারা ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালন করতেন। তবে এবার আর ছিটমহল বলতে কোন শব্দ নেই। সবাই পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। তাই এবার তারা স্বাধীনভাবেই করেছিলেন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সকল আয়োজন। গত কয়েকদিন ধরেই উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিল শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মাঝেই।
১৫ আগস্ট সকাল থেকেই দিনহাটা মহকুমার মধ্য মশালডাঙ্গা, পোয়াতুরকাটি, করলাসহ অনেক অধুনালুপ্ত ‘ছিটমহল’ এলাকায় ভারতীয় জাতীয় সংগীত গেয়ে, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে শুরু হয় দিনের কর্মসূচি। এরপর অনুষ্ঠিত হয় খেলাধুলাসহ নানা আয়োজন। দিনটিকে ঘিরে এসব এলাকায় ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
কোচবিহারের সাংবাদিক শুভেন্দু ভট্টাচার্য্য টেলিফোনে জানান, সদ্য বিলুপ্ত হওয়া কিসাতমত বাত্রিগাছ ছিটমহলে স্বাধীনতা দিবস পালনের আয়োজন করে জেলা পুলিশ। দিনের শুরুতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন কোচবিহারের জেলা শাষক পি উল্গানাথন ও পুলিশ সুপার রাজেশ কর যাদব।
মধ্য মশালডাঙ্গার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন টেলিফোনে গতরাতে বলেন, ‘স্বাধীনভাবে স্বাধীনতা দিবস পালনের ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। আর আজ তা পূরণ হলো।’ কিসামত বাত্রিগাছের কলেজ শিক্ষার্থী রওশন সরকার বলেন, ‘মহা ধুমধামে স্বাধীনতা দিবস পালন করলাম আমরা নব ভারতীয়রা।’
আর সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা দিপ্তীমান সেনগুপ্ত গতকাল তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন ‘৪৫ বছর বয়সে আমি সন্তষ্ট। একসময় আমার বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন ছিটমহলের মানুষ একদিন সাধারণ মানুষ হিসেবে স্বাধীনতা দিবস পালন করবেন। আজ এসব মানুষ সরকারি লোকজনের সাথে দিনটি উদযাপন করছেন। সম্ভবত এটাকেই বলে স্বপ্ন সত্যি হওয়া।’