স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ধর্মঘট
স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণের দাবিতে দেশব্যাপী কর্মবিরতি, অবস্থান ধর্মঘট ও স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালন করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে চলতি আগস্ট মাস থেকে প্রতি রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শিক্ষকদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। তবে চলমান পরীক্ষাগুলো এই কর্মসূচির আওতার বাইরে থাকবে।
শিক্ষকদের চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, শিক্ষকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মধ্যবর্তী সময়ে ঘোষিত বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করে সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা সিনিয়র সচিবের সমান করা, রাষ্ট্রীয় ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’-এ প্রত্যাশিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী পদমর্যাদাগত অবস্থান নিশ্চিত করা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের মতো গাড়ি ও অন্য সুবিধা শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও নিশ্চিত করা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা অনুষদ ভবনের সামনে অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে তিন ঘণ্টা কর্মবিরতি ও ধর্মঘট পালন করেন তাঁরা। ধর্মঘটের কারণে সব বিভাগের ক্লাস বন্ধ থাকলেও পরীক্ষা যথারীতি চলেছে।
অবস্থান ধর্মঘটে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি খবির উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মাফরুহী ছাত্তারসহ আরো অনেকে। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে নিতে শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি খবির উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষকতা পেশায় অন্য পেশার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। তাই একটি সম্মানজনক বেতন কাঠামো আমাদের নৈতিক দাবি।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : কর্মবিরতি পালিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ ব্যাপারে রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী রোববার পর্যন্ত আমাদের এ কর্মবিরতি অব্যাহত রাখব। আগামী কর্মসূচিতে পরবর্তী সময়ের করণীয় কার্যক্রম ঘোষণা করা হবে।’
দাবি মেনে নেওয়ার আভাস পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘আমরা এখনো অফিশিয়ালি সে রকম কিছু পাইনি। তবে গণমাধ্যম থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে আমাদের সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল মেনে নেওয়া হবে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় : খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে অধ্যাপক ড. আহমেদ আহসানুজ্জামানের সভাপতিত্বে ক্যাম্পাসের অদম্য বাংলার অদূরে শিক্ষকরা একটি প্যান্ডেলে এ কর্মসূচি পালন করেন।
অবস্থান কর্মসূচি থেকে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজের অবমূল্যায়ন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা জড়িত। আরো বলা হয়, শিক্ষকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন শিক্ষানুরাগী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের এই সংবেদনশীল বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
কর্মসূচি চলাকালে আরো বক্তব্য দেন শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি অধ্যাপক ড. সরদার শফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. সারওয়ার জাহান, এফএমআরটি ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আইয়াজ হাসান চিশতী, অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বশীর আহমেদ, ইউআরপি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুল আলম, অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. রেজাউল ইসলাম, ইউআরপি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মোস্তফা সারোয়ার, বিবিএ ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মেহেদী হাসান মো. হেফজুর রহমান প্রমুখ। কর্মসূচির সঞ্চালক ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক মো. সাদিকুল আমিন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষকদের কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় বিভিন্ন অনুষদের পূর্বঘোষিত পরীক্ষা বাদে সব ক্লাস স্থগিত রাখেন শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের ১৮ বিভাগের শতাধিক শিক্ষক কর্মসূচিতে যোগ দেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘এটি শুধু শিক্ষকদের ন্যায্য সম্মান ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল আদায়ের জন্য। ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে যুগপৎ আন্দোলনের সহযোগী যোদ্ধা হয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পাশে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি পূরণ ছাড়াই মন্ত্রিসভায় নতুন বেতন স্কেল পাস হলে তাৎক্ষণিক জাতীয় সম্মেলন ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশন ঘোষণা করেছে তার সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিরও সর্মথন রয়েছে।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এ সময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, দ্রুত এ দাবি না মানলে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে শিক্ষক সমিতি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় : ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও আজ সকাল থেকে ধর্মঘট পালিত হয়। এ সময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার শরীফুল ইসলাম বলেন, অষ্টম বেতন স্কেলে যেখানে জ্যেষ্ঠ সচিবদের বেতন ৮৪ হাজার টাকা এবং সচিবদের বেতন ৭৮ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে সেখানে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের বেতন ৭৫ হাজার এবং অধ্যাপকদের বেতন করা হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। শিক্ষকদের দাবি, জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের বেতন জ্যেষ্ঠ সচিব ও অধ্যাপকদের বেতন সচিবদের সমতুল্য করা হোক।
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এ কর্মসূচিতে বিভিন্ন অনুষদের কয়েক শ শিক্ষক অংশ নেন। অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি ও কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আনিস খান, শিক্ষক সমিতির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. এ টি এম শফিকুল ইসলাম, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাৎ হোসেন খান, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কৃষিবিদ অধ্যাপক ড. সাইফুল হুদা, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মামুনুর রশীদ, কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শোয়াইবুর রহমান, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কুতুব উদ্দীন প্রমুখ। বক্তারা বলেন, বেতন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত পে-স্কেল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য চরম অপমানকর। শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করে দেশ কখনো উন্নতির দিকে যেতে পারে না। এশিয়ার প্রায় দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালু আছে। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন স্কেল কয়েক ধাপ কমিয়ে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। অবিলম্বে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করে শিক্ষকদের প্রাপ্ত মর্যাদা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বক্তারা।
[প্রতিবেদনগুলো পাঠিয়েছেন জাহিদুর রহমান, প্রদীপ সরকার, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা; আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল; কাজল বরণ দাস, পটুয়াখালী; আইয়ুব আলী, ময়মনসিংহ ও ফারুক হোসেন, দিনাজপুর]