হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে দেশ-বিদেশের অর্ধশত বিশেষজ্ঞ
দৃষ্টিনন্দন ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে সেতু পাবনার পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। গৌরবোজ্জ্বল এই সেতু গত ৪ মার্চ শত বছর অতিক্রম করে। এই উপলক্ষে রেল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দেশ-বিদেশের ৫০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আজ রোববার বিকেলে সেতু পরিদর্শন করে। দলের সদস্যরা সেতুর নির্মাণশৈলী ও এর স্থায়িত্ব দেখে মুগ্ধ হন।
এর আগে দুপুরে পাকশী সড়ক ও জনপথের সম্মেলন কক্ষে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেখানে জাপান, কোরিয়া, হাঙ্গেরি, স্পেন, ভারত, বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্রিজ অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং (আইএবিএসই) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ৫০ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন। প্রতিনিধিদলের নেতা ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সেতু বিশেষজ্ঞ ও ভারতীয় প্রকৌশলী অমিতাব ঘোষাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান তৌফিকুল আনোয়ার, শিক্ষক ডা. হাসিব মোহাম্মদ হাসান, ড. সাইফুর আলী, ড. আব্দুর রউফ, আইএবিএসইএর সদস্য ড. আজাদুর রহমান, জাইকার সদস্য কে নোগামি, ক্যারলি হিরোস, টি ইসিকুতা, এডিজিআই কাজী রফিকুল আলম, এডিজি অপারেশন হাবিবুর রহমান, পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী মাহাবুবুল আলম বক্শী, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) খায়রুল আলম, টঙ্গী-ভৈরব ডাবল লাইন প্রকল্পের জিএম সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, একই প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী সুকুমার ভৌমিক, পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক আফজাল হোসেন বক্তব্য দেন।
সেমিনারের প্রধান অতিথি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে বিশ্বের একটি ঐতিহাসিক ও মডেল সেতু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সামাজিক প্রভাব না থাকলে আগামী ২৫ বছরেও হার্ডিঞ্জ সেতুর কোনো ক্ষতি হবে না। সেতুটিকে আরো বেশি দিন নিরাপদে যাতে ব্যবহার করা যায় সেজন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং সে মোতাবেক বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত স্টাডি ও অ্যাসেসমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছেন। গাইড বাঁধের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে পাথর দিয়ে সেতুকে তাৎক্ষণিকভাবে রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেও সেতুটির ক্ষতি হবে না।
সেমিনারের শুরুতেই সভাপতি ও রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন প্রজেক্ট টাইলের মাধ্যমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণ সংক্রান্ত ইতিহাস উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করেন।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কোনো ক্ষতি হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কোনো প্রভাব হার্ডিঞ্জ ব্রিজ স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ রাশিয়ান পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, আগামী ২৫ বছর নিরাপদে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে পাশে আরো একটি নতুন রেল সেতু নির্মাণ করা হবে। সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাকশীর ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপিঠে শিগগিরই শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ হাতে নেওয়া হবে।
সেমিনার শেষে বেলা ৩টায় বিশেষজ্ঞদল প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পরিদর্শন করে এর বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। সেতু পরিদর্শন শেষে পুনরায় বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রতিনিধিদলের সদস্যদের নিয়ে একটি ট্রেন পাকশী স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
গত ৪ মার্চ পদ্মা নদীর ওপর স্থাপিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর ১০০ বছর পূর্তি হয়। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ উদ্বোধন করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
এটি পাবনার পাকশীর গোড়া থেকে শুরু হয়ে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে ওপারে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার মাথায় গিয়ে ঠেকেছে। ১৮৮৯ সালে ভারত ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার রেল যোগাযোগ সহজ করতে পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। পরে ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি লাভের পর ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস সেতু নির্মাণের দায়িত্ব নেন। সেতুর নির্মাণ শুরু হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। চার কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় রুপি ব্যয়ে ২৪ হাজার শ্রমিক দীর্ঘ পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ সালে ব্রিজটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী রেল চালুর মাধ্যমে এ সেতু উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ভাইসরয় লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ। তাঁর নামেই এ সেতুর নামকরণ করা হয়। শতবর্ষের এই সেতু দেখতে এখনো প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভিড় জমান পাকশীর পদ্মা নদীর তীরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেতুটির একটি স্প্যান (১২ নম্বর) মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ১১ মাস ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। তা পরের বছর (১৯৭২) অক্টোবর মাসে মেরামত করা হয়।