১৮ দফা ইশতেহার দিলেন বুলবুল
রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছেন বিএনপি মনোনীত ও ২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। আজ মঙ্গলবার নগরীর মুনলাইট গার্ডেনের সম্মেলন কক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে মেয়র নির্বাচিত হলে কী করবেন তার ফিরিস্তি তুলে ধরেন তিনি।
নগরবাসীর করের বোঝা লাঘব এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনকে সহযোগিতা করার কথা বলে বুলবুল তাঁর ইশতেহারে কোটা প্রথা সংস্কার করে মেধাবীদের চাকরির নিয়োগ প্রাপ্তিতে পূর্ণ সহযোগিতা করার কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে গত মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হলেও সরকারের রোষানলে পরে জেলে যাওয়া, বেশিরভাগ সময় মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে না পারা এবং সরকারের অসহযোগিতার কারণে নগরবাসীর কাঙ্খিত উন্নয়ন করতে না পারার কথা বলেছেন বুলবুল তাঁর এবারের ইশতেহারে।
ইশতেহার ঘোষণার সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মিজানুর রহমান মিনু, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু ও হাবিবুর রহমান হাবিব, দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপূণ রায় চৌধুরী, বুলবুলের প্রধান নির্বাহী এজেন্ট জেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
ইশতেহার ঘোষণার শুরুতেই বুলবুল দাবি করেন, রাজশাহীর যতো উন্নয়ন তার সবই হয়েছে বিএনপি সরকারের আমলে। তিনি বলেন, ‘আধুনিক রাজশাহী সিটি করপোরেশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর হাত ধরে। উন্নয়নের সেই ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয় ২০০৮ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়রের সময়ে।’ তিনি জানান, সেই সময়ে শান্তির শহর রাজশাহীর মানুষের সুখ-শান্তি তিরোহিত হয়ে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়। রাজশাহী মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পরবর্তী নির্বাচনে তাকে মেয়র নির্বাচিত করেন।
বুলবুল জানান, অনেক প্রত্যাশা নিয়ে রাজশাহীবাসী তাঁকে মেয়র নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু সরকার ও তার স্থানীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে তাঁকে প্রায় অর্ধেক সময়ই দায়িত্বের বাইরে অবস্থান করতে হয়েছে। এছাড়া সরকারের অসহযোগিতা কাঙ্খিত উন্নয়ন বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করেছে।
বুলবুল জানান, এবার মেয়র নির্বাচিত হতে পারলে তিনি নগরবাসীর করের বোঝা লাঘব ও সহজসাধ্য করার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরলীকরণ প্রক্রিয়ায় নূন্যতম কর নির্ধারণ করবেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে রাজশাহীতে বন্ধ হওয়া গ্যাস সংযোগ পুনরায় চালুর দাবি আদায় করবেন। চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা বিষয়ে এর আগে গৃহীত প্রকল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যথাযথ উন্নয়ন করার কথা বলেছেন বুলবুল তাঁর ইশতেহারে। শুধু সনদধারী না হয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী, দক্ষ ও মানবিক গুণের অধিকারী হয়ে দেশপ্রেমিক তথা সুনাগরিক হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে সেই লক্ষ্যে মেয়র নির্বাচিত হলে বুলবুল প্রয়োজনীয় মোটিভেশন প্রোগ্রাম চালু করবেন। নগরীতে অবস্থিত আরবান ক্লিনিকসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন করার পাশাপাশি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামগ্রিক অব্যবস্থা দূরীকরণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলেছেন বুলবুল তাঁর ইশতেহারে।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি স্বল্প আয়ের গৃহহীন জনগোষ্ঠির জন্য গৃহীত গৃহ নির্মাণ প্রকল্প চালু রাখবেন এবং এর পরিধি আরও বাড়াবেন। শিক্ষা নগরী রাজশাহীতে সরকারি স্কুল ও কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি কলেজ ও স্কুল স্থাপন করবেন। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির উন্নয়নে এ অঞ্চলে একটি পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথাও বলেছেন বুলবুল তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-বৃত্তি ও পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য কৃতি-শিক্ষার্থীদের স্বর্ণপদক প্রদান করবেন, শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাস ও মাদক থেকে দূরে রাখতে তাদেরকে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করবেন। সেই সঙ্গে চাকরির ক্ষেত্রে চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনকে সহযোগিতা করার কথা বলে বুলবুল তার ইশতেহারে কোটা প্রথা সংস্কার করে মেধাবীদের চাকরির নিয়োগ প্রাপ্তিতে পূর্ণ সহযোগিতা করার কথা বলেছেন।
ইশতেহারে বুলবুল উল্লেখ করেন, নির্বাচিত হলে তিনি একটি আধুনিক নগরীর উপযোগী রাস্তাঘাট তৈরি, ড্রেনেজ-ব্যবস্থা, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। শহরের যানজট নিরসনকল্পে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ট্রাফিক-কর্মী বাহিনী গড়ে তুলবেন এবং যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিভিন্ন মার্কেটে বহুতল গাড়ি-পার্কিং ব্যবস্থা তৈরি করবেন।
বুলবুল রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ অন্যান্য টুর্ণামেন্ট এর ভেন্যু স্থাপনের লক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও একটি ইনডোর স্টেডিয়াম স্থাপন করবেন মেয়র নির্বাচিত হলে। এছাড়া তিনি সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সকল মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, গোরস্থান, মন্দির, মঠ, শশ্মান, গীর্জাসহ অন্যান্য উপাসনালয়ের সংস্কার ও সৌন্দর্য্যবর্দ্ধন করবেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধকল্পে নগরীতে পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ করে ‘গ্রীণ সিটি হেলদি সিটি’ শ্লোগান এর বাস্তব রূপায়ন করবেন। মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা নারী ও সিনিয়র-সিটিজেনদের সামাজিক নিরাপত্তাবিধান এবং সিটি করপোরেশনে ওয়ান স্টপ ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করবেন। কর্মজীবী মহিলাদের থাকার জন্য হোস্টেল নির্মাণ এবং তাঁদের শিশু সন্তানদের দেখা-শোনার জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলার কথা বলেছেন বুলবুল তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে।
মাদকাসক্ত যুবসমাজকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত মাদক-নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করে বুলবুল তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। পাশাপাশি নতুন করে কেউ যাতে মাদকাসক্ত না হয়, সেজন্য মনস্তাত্ত্বিক সেবা প্রদান করবেন। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য কারিগরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে তোলা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে উৎসাহী করার কথা বলেছেন বুলবুল তার ইশতেহারে। বিশেষ করে রাজশাহী রেশম কারখানার পুনরায় চালুসহ অন্যান্য প্রকল্প গ্রহণ করার কথা বলেছেন তিনি।
রাজশাহীতে পর্যটনকে আকৃষ্ট করতে দীর্ঘ পদ্মা নদীর বাঁধ সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধন করার ঘোষণা দিয়ে বুলবুল বলেছেন, ‘অন্যান্য ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানসমূহকেও আকর্ষণীয় করে তোলা হবে। জিয়া পার্ক, সিটি পার্কসহ শহীদ কামরুজ্জামান পার্কের আরও সংস্কার এবং অসামাজিক কার্যকলাপ রোধকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে আবর্জনা পরিস্কার ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলেছেন বুলবুল। ইশতেহারে তিনি জানান, নির্বাচিত হলে তিনি পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করবেন। উম্মুক্ত জলাশয় সংস্কার এবং এর পানি ব্যবহারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের সর্বকালের কৃতি সন্তান উল্লে করে বুলবুল জানান, নির্বাচিত হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। রাজশাহীকে মেগা সিটিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে ভবিষ্যতে এর পরিধি বাড়ানোরও কথা বলেছেন বুলবুল।
সিটি করপোরেশনে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য দুই ঈদ এবং পহেলা বৈশাখে উৎসব বোনাস প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এছাড়া করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী মৃত্যুবরণ করলে তাকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা প্রদান করার কথা বলেছেন। পাশাপাশি কর্মরতদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র গঠন করার কথা বলা হয়েছে তাঁর ইশতেহারে।
বুলবুল ঘোষণা দিয়েছেন তিনি নির্বাচিত হলে জনগণের ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।