আহমদিয়াদের বার্ষিক জলসা ঘিরে রণক্ষেত্র পঞ্চগড়
আহমদিয়া মুসলিম জামাতের পূর্বঘোষিত বার্ষিক সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড় শহর ও আশপাশ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টা থেকে সোয়া ১১টা পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটে।
বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে ও জেলা শহরের আহমদনগরে তাণ্ডব চালায়। তারা আহমদনগরে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের লোকজনদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালায়।
এ সময় মহাসড়ক দুই ঘণ্টা ধরে অবরোধ করে রাখলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করে। একপর্যায়ে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। এতে পুলিশসহ উভয়পক্ষের কমপক্ষে অর্ধশত আহত হন। গুরুতর আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ঘটনার পর রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবদুল্লাহ সাজ্জাদ, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মজিদ আলী, জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন, পুলিশ সুপার মো. গিয়াসউদ্দিন আহমদ, পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউস সুন্নাহ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এহেতেশাম রেজা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাঈমুল হাছানসহ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। রাত সাড়ে ১১টায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। শহরে ও আহমদনগর এলাকায় পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে জেলা শহরসহ ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটি ও পঞ্চগড় যুব সমাজ নামে কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে জনতা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিল শেষে তাঁরা পঞ্চগড় শহরের শেরেবাংলা পার্ক মোড়সংলগ্ন পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন। অবরোধের ফলে মহাসড়কের উভয় পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে।
এ সময় বিক্ষুব্ধরা আহমদনগর এলাকায় যেতে চাইলে পুলিশ করতোয়া ব্রিজের ওপর তাদের পথরোধ করে। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে আহমদনগরের দিকে রওনা হলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ লোকজন পুলিশের ওপর ইট নিক্ষেপ শুরু করলে পুলিশও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা চলা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ লোকজন আহত হয়। একপর্যায়ে একটি পক্ষ শহরের রাজনগর এলাকা দিয়ে করতোয়া নদী পার হয়ে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের আহমদনগর এলাকায় গিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা চালায়। সেখানে তারা আহমদিয়া মুসলিম জামাতের ১০/১২টি বাড়িঘর, দোকানপাটে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তাদের হামলায় আহমদিয়া জামাতের কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়।
এ সময় আতঙ্কে পঞ্চগড় বাজারের প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তবে কতটি রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছে, তা পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি।
জেলা প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবিলায় মঙ্গলবার রাতে বিক্ষুব্ধদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে জলসা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সালানা জলসা স্থগিতের ঘোষণার পরও বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়ক অবরোধসহ আহমদনগরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। রাত সোয়া ১১টার দিকে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ গোলাম আজম পঞ্চগড় বাজার জামে মসজিদের মাইকে জেলা প্রশাসন কর্তৃক জলসা অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বানসহ কারো প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে সবাইকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন।
আহত মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমি আহমদিয়া মসজিদের ছাদে ছিলাম। ওরা দলে দলে আমাদের ওপর হামলা করে ইট ছুড়তে থাকে। বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একটি ইটের টুকরো আমার মাথায় লাগে।’
আহমদনগর মুসলিম জামাতের প্রেসিডেন্ট তাহের যুগল দাবি করেন, তাদের ৪০ জনের মতো আহত হয়েছেন। মেয়েদের টেনেহিঁচড়ে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং ভাঙচুর চালানো হয়েছে। জলসার অনেক মালামাল ভাঙচুর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তারা প্রায় দুই ঘণ্টা তাণ্ডব চালায়।
পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বণিক জানান, বিভিন্নভাবে আহত হয়ে ২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে মনে হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট জানান, পৌর মেয়র তৌহিদুল ইসলাম ও আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতাদের নিয়ে আমরা অবস্থানরত লোকজনকে প্রশাসন কর্তৃক জলসা স্থগিতের কথা জানাই। কিন্তু তারা নানাভাবে বিভ্রান্ত হয়ে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে রাখে। পরবর্তী সময়ে কিছু লোক করতোয়া নদী পার হয়ে শহরতলীর আহমদনগরে জলসাস্থলে যায়।
পঞ্চগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু আক্কাস আহমদ জানান, রাতে জেলা প্রশাসন জলসা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার আগেই বিভিন্ন স্থান থেকে মুসল্লি ও সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। তাদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও শান্ত করতেই পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় কিছু মানুষ বিকল্প পথে শহরতলির আহমদনগরে গিয়ে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকটি ঘরবাড়ি ও জলসাস্থলের বেশ কিছু উপকরণ ভাঙচুর করে।
পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ জানান, মুসল্লিদের বিচ্ছিন্ন একটি পক্ষ এই হামলা করেছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি, কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, মুসল্লিদের দাবি ছিল, জলসা বন্ধ করলে তারা তাদের অবরোধ তুলে নেবে। আমরা জলসা স্থগিত করার ঘোষণা দেই, তারপরও তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বে সঙ্গে দেখছি।
রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আগামী ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ধাক্কামারা আহমদনগর এলাকায় বার্ষিক সালানা জলসা আহ্বান করে আহমদিয়া মুসলিম জামাত। এটি বন্ধের দাবি জানিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ পঞ্চগড় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। আহমদিয়া মুসলিম জামাতও জলসা বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে।