নববর্ষ ঘিরে ব্যস্ত কুলিয়ারচরের মৃৎশিল্পীরা

বাংলা নতুন বছরের বৈশাখি উৎসবের মেলা-বান্নিকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার পালপাড়ার মৃৎশিল্পীদের। নারী-পুরুষ, শিশু-সব বয়সী মৃৎশিল্পের কারিগররা যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বছরের অধিকাংশ সময় তাদের তেমন ব্যস্ততা না থাকলেও, ফাল্গুন থেকে বৈশাখ-এই তিন মাস তাদের ব্যস্ততায় কাটে।
বর্তমানে বেশ কর্মমুখর পালপাড়ার প্রতিটি বাড়ি। বয়সের গণ্ডি ছাড়িয়ে নারী-পুরুষ আর শিশু-কিশোরীরা ব্যস্ত যার যার কাজ নিয়ে। হাতি, ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক, ফল-ফলাদির খেলনা তৈরিতে মনোযোগী সবাই। কাদা-মাটির দলা দিয়ে নির্দিষ্ট ফ্রেমে পুড়ে তৈরি করছেন যার যার শিল্পকর্ম। পরে সেখানে হাতের কারসাজি আর তুলির আঁচড়ে অবিকল রূপায়ণের এক অপূর্ব সমন্বয়ে তৈরি করা হয় কাঙ্ক্ষিত মৃৎশিল্পটি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলা নতুন বছরকে কেন্দ্র করে চৈত্র ও বৈশাখ মাসব্যাপী গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বৈশাখী মেলা বা বান্নি হয়। সেখানকার বেচা-বিক্রির একটি অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো মাটির তৈরি তৈজসপত্র ও শিশুদের খেলনা। আর সেই মেলা-বান্নির ক্রেতার চাহিদা মেটাতে এ সময়টায় পালপাড়ায় কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায়।
তবে তাদের অভিযোগ, কালের আবর্তে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন কৃত্রিম আঁশের তৈরি সামগ্রীর কারণে দিনে দিনে তাদের তৈরি মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে যাচ্ছে। বাজার চাহিদা ভালো না থাকায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকর্ম প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্রেতার চাহিদা কমে যাওয়ায় তারাও আর আগের মতো এই শিল্পের পণ্য তৈরি করেন না। শুধু চৈত্র-বৈশাখ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেলা-বান্নিতে বিক্রির জন্য কিছু খেলনা সামগ্রী তৈরি করেন। তাদের দাবি, প্লাস্টিক সামগ্রী নিষিদ্ধ এবং আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটিকে আবারও জাগিয়ে তোলা যাবে।
কুলিয়ারচর পৌর এলাকার দোয়ারিয়া কুমারপাড়ার (পালপাড়া) ৭৬ বছর বয়সী পরিমল পালের বাবা রজনী পাল তাঁর ১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে চলতেন এ পেশায় কাজ করে। তখন তাঁদের পরিবারে সচ্ছলতাও ছিল। কাজ করলে, টাকার অভাব হতো না কোনো পাল পরিবারের। তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা ছিল প্রচুর। বর্তমানে নিজেসহ এক ছেলে ঠাকুরধন পালকে নিয়ে মাটির কাজ করেন পরিমল পাল। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চাকা ঘুরিয়ে কাজ করলেও ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি তাঁর। সংসারে নেই সচ্ছলতা।
একই অবস্থার কথা জানালেন হীরালাল পাল, মহেন্দ্র কুমার পাল, সুরুজাবালা পালসহ এ পেশার অন্যান্য এলাকার লোকজনও।
এদিকে খুরশিদ আলম, সাইফুল ইসলাম ও মেজবাহ উদ্দিনসহ স্থানীয় লোকজন জানান, এক সময় তাদের এলাকার এই পালপাড়া বেশ জমজমাট ছিল। সারা বছরই ব্যস্ত থাকত এখানকার কারিগররা। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। তাদের প্রয়োজনীয় কোনো দ্রব্য এখন আর পাওয়া যায় না। তাদের দাবি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পটি আবারও চাঙ্গা হলে পাল সম্প্রদায়ের উন্নতির পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্যও রক্ষা হবে।
তবে ভিন্ন কথা জানালেন ভৈরব চকবাজারের দুই মৃৎশিল্প বিক্রেতা আব্দুল করিম ও বাবুল মিয়া। তাঁরা জানান, তাদের বেচাকেনা বেশ ভালো। এই পণ্যের ব্যবসা করে তাঁরা পরিবারপরিজন নিয়ে ভালোই আছেন। তবে অফসিজনে (বর্ষাকালে) তাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলেও, গড়পড়তায় তাঁরা বেশ ভালো আছেন।
মৃৎশিল্প বিক্রেতারা জানান, আগে স্থানীয় কুমারদের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। এখন স্থানীয়সহ ঢাকার সাভার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা এলাকা থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র এনে সারা বছর বিক্রি করেন তাঁরা।