আর্য ফিরে আসুক মায়ের আঁচলতলে
মিনার্ভা সেঁজুতি লিপি, অনেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে পড়তেন ২২তম ব্যাচে (১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষ)। তিনি একজন মা। একজন নারীর সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে গর্বের পরিচয় তাঁর মাতৃত্ব। পৃথিবীতে এর চেয়ে মধুর এবং একই সঙ্গে শক্তিমান পরিচয় সম্ভবত আর একটাও নেই!
গত ১০ অক্টোবর এই মা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন :
"আজ আর্য আমার কাছে এসেছিল। এদিন আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বিপি অনেক হাই ছিল ১৬০/১৮০। ডাক্তার টেনশন না করার জন্য মিথ্যা করে বলেছিল বিপি ১৪০/১৬০। বাচ্চা অক্সিজেন পাচ্ছিল না। একদিন পরে সিজার করার কথা ছিল। কিন্তু আলট্রাসোনো করার পর আলট্রাসোনোর ডাক্তার স্বাতী আপার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝেছিলাম, কোনো সমস্যা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, স্বাতী আপা কোনো সমস্যা? আপা না করলেন, কিন্তু আমি আলট্রাসোনো রুম থেকে বের হতে না হতেই স্বাতী আপা ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। আমি বিপ্লবকে বললাম, মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ডা. নার্গিস ফাতেমা রুমে এসে বললেন 'আমরা আজই সিজার করব।’ আমাকে ওটিতে নিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবকে বললাম, ‘আমার যাই হোক, আমার বাবু যেন পৃথিবীর আলো দেখে!
ওটিতে প্রথমে লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়েছিল। কিন্তু যখনই কাটতে যাচ্ছে আমি ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠছিলাম। ডা. নার্গিস আপা ভাবছিলেন আমি বুঝি এমনিই ভয়ে এমন করছি। সেটা ঠিক ছিল না। আমি সত্যি সত্যিই টের পাচ্ছিলাম। কারণ আমিই লোকাল এনেস্থিসিয়া চেয়েছিলাম। আমি আমার বাচ্চার প্রথম কান্না শুনতে চেয়েছিলাম!
এনেস্থিসিয়ার ডাক্তার বুঝতে পেরেছিলেন আমি সত্যিই বুঝতে পারছি। তাই আবার আমাকে জেনারেল এনেস্থিসিয়া দিলেন। ডাক্তার কথা বলতে বলতে ইঞ্জেকশন দিচ্ছিলেন। এটুকুই মনে আছে।
তার পর একসময় কে যেন ডাকছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না। ‘ওয়াদিয়া ওয়াদিয়া তোমার বাবু।’ আমি অনেক কষ্টে চোখ মেলে আমার সোনাপাখিকে দেখতে চাইলাম। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না!
অনেক শব্দ শুনতে পেলাম। আনন্দ ধ্বনি। সবাই হাসছে। আমার চারদিকে আমার প্রিয়জনরা ঘিরে আছে। বিপ্লবকে শুধু বললাম, ‘আমাদের বাবু।’ তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।
সেই আর্য আমার কোলে এলো। আমরা আনন্দে ভাসলাম। সেই সময় আমি আর্যকে জড়িয়ে ধরে সারাক্ষণ বলতাম, 'এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিয়া ভেবে হইতাম সারা, সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!’
আজ আমার সেই সোনাইয়ের জন্মদিন। আজ আমাদের অনেক আনন্দের দিন হতো। আজ আমরা অনেক ঘুরে বেড়াতে পারতাম। আজ আমার ঘর বেলুনে বেলুনে ভরে যাওয়ার কথা। আজ সন্ধ্যাবেলায় Happy Birth day লেখা কেক আসত আমার ঘরে। আর্যর বন্ধুরা আজ আর্যকে ঘিরে থাকত। এসবের কিছুই আজ হবে না।
তারপরও আজ আমার পঙ্খীরাজ ঘোড়ার জন্মদিন! আমার টাট্টুঘোড়ার জন্মদিন। আমার সাহসী রাজপুত্র লালকমলের জন্মদিন, যে তরোয়ালের এক কোপে ক্যান্সার জীবাণুকে পরাস্ত করতে পারবে! আজ আমার প্রাণভোমরার জন্মদিন!
শুভ জন্মদিন আমার পাভেল করচাগিন! বাবা আমার, অনেক অনেক ভালোবাসা তোর জন্য...
এর পর ১৩ অক্টোবর আরেকটি পোস্টে মা লিখেছেন :
‘আর্যর কেমো সেন্ট্রাল লাইন অপারেশন হয়েছে। প্রথম সাইকেলের প্রথম কেমো দেওয়া হয়েছে। কেমো দেওয়া শেষ হতে হতেই বমি করেছিল। ডাক্তার তিন বেলা করে বমির ওষুধ দিয়েছেন। এখন বমি করছে না কিন্তু একদম খেতে চাচ্ছে না আর খুব দুর্বল। প্রথম সাইকেলের দ্বিতীয় কেমো ১৫ অক্টোবর (যেটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে)। কেমো শুরুর দুই ঘণ্টা আগে ব্লাড টেস্ট করতে হবে। কেমোথেরাপি দিলে অনেক সময় প্লাটিলেট কমে যায়। তাই প্রতি কেমোর আগে সব সময় ব্লাড টেস্ট করতে হবে। প্লাটিলেট কমে গেলে ডাক্তার সিদ্ধান্ত দিবেন কী করতে হবে।
আর্যকে বলেছি “বাবা তোমার চুলগুলো আস্তে আস্তে পড়ে যাবে!' আর্য হাসে আর মজা করে আমাকে বলে 'মা তাহলে তো তুমি বাপের তালু (তালুক) পাবা।' আমিও হাসছি! এত হাসছি যে, হাসতে হাসতে চোখের পানি যে কখন গাল বেয়ে ঠোঁটে পড়ে মুখে চলে গেছে টের পাইনি। লবণাক্ত পানি আমাকে মনে করিয়ে দিল আমি সমুদ্রে ভাসছি!"
বুঝতেই পারছেন, এই তো সেদিনই পাঁচ বছরে পা দেওয়া আর্যর ক্যান্সার হয়েছে। ১৮ মাসে তিন সপ্তাহ অন্তর অন্তর তাকে ১২ সাইকেলে তিনটি করে মোট ৩৬টি কেমো ঠিকঠাক মতো দিতে পারলেই, ডাক্তার বলেছেন, নিশ্চিত সুস্থ হয়ে যাবে। এ জন্য খরচ হবে প্রায় ১৫-১৬ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত উঠেছে মাত্র ছয় লাখ টাকা।
আর্যর খুব ইচ্ছে, সে 'বাতিঘর' নামে শিশুদের জন্য পরিচালিত যে স্কুলটা ঢাকায় আছে সেখানে পড়তে যাবে। প্রায় নিয়মিতই নাকি স্বপ্ন দেখে! শিশুদের জন্য 'বাতিঘর' দুর্দান্ত এক স্কুল। স্বপ্ন দেখাটাই স্বাভাবিক। অথচ, তার আগেই, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আর্যর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল।
আর্যর বাঁ চোখ ও পিটুইটারি গ্র্যান্ডের মাঝে জন্মানো টিউমারটি বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। মার্চের শেষের দিকে আর্যকে নিয়ে তার মা-বাবা গেলেন ভারতের ভেলোরে। ভর্তি করানো হলো সিএমসি হাসপাতালে। অনেক কষ্টে। এই হাসপাতালে নাকি দিনে প্রায় ২০ হাজার রোগী রেজিস্ট্রশন করে!
১৫ এপ্রিল আর্যর অপারেশন হলো। ৮০ ভাগ টিউমারই বের করে ফেললেন ডাক্তাররা। কিন্তু, ছোট্ট আর্যকে ধরাশায়ী করার জন্য থেকে গেল বাকি ২০ ভাগ! এর পর ডায়গনোসিস হলো। তার পর বায়োপসি পরীক্ষায় সেকেন্ড গ্রেড কারসিনোমা মানে সেকেন্ড স্টেজের ক্যান্সার ধরা পড়ল! ব্রেইন ক্যান্সার!
২.
ইশ! পাঁচ বছরের একটা শিশু কী কষ্টই না পাচ্ছে কেমোতে! তবুও তার কী বাঁচার আকুতি-- 'মা, আমি ভালো হতে চাই মা... ডাক্তার বন্ধুদের আমার মাথা ব্যথাটা সারিয়ে দিতে বলো মা...।' শিশুর মন, সে কী বুঝে কত বড় শয়তান রোগ ধরেছে তাকে!
একদিকে আর্য যখন শারীরিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে, আরেক দিকে তখন মানসিক কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক কষ্টেও ভুগছে তার মা-বাবা। এত দিন ধরে সন্তানের চিকিৎসার টাকা জোগান দিতে দিতে তাঁরা আজ প্রায় নিঃস্ব! মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের কত সাধ, সাধ্য নাই তার!
রাষ্ট্র তার সন্তানের চিকিৎসার ভার নেয় না। ওষুধ কোম্পানিগুলো এত বড় রোগের ওষুধের দাম করেছে সাধারণের নাগালের বাইরে। টাকা! টাকা! টাকা! কোথা থেকে আসবে এত টাকা?
কাউকে বলতেও পারছেন না আর্যর মা-বাবা! আর্যর অভিমানী-দুঃখিনী মা ফেসবুকে অতল-সজলস্পর্শী এক গল্প লিখে জানিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীতে যেহেতু অর্থের অনেক অভাব তাঁদের, সেহেতু এই দম্পতি নাকি আর্য-পুত্রকে নিয়ে পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যাবেন!
যদি তা-ই হয়, একবার শুধু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন, আর্যর মা-বাবা সমুদ্রের লোনা জলে ভাসছেন! আর্যও ভাসছে! কোনো এক তীরে আরও এক শিশু আয়লান দেখা যায়! সিরিয়ার সেই শিশু আয়লান, কিছুদিন আগে যার জন্য শোকাতুর হয়েছিল মানবতা!
৩.
মৃত্যু সেই অমোঘ সত্য, যার কাছে প্রতিটি প্রাণেরই পরাজয় নিশ্চিত। তাই বলে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পরাজিত হবে আর্য!
আমরা একগুচ্ছ রঙিন স্বপ্ন ও আশার চাষাবাদ করা মানুষরা চাইলেই আর্যকে মৃত্যুর বিপক্ষে অজেয় বানাতে পারি। চাই কি চাই না, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের সবাইকেই নিতে হবে।
গত ফেব্রুয়ারিতেই তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটির অসামান্য মেধাবী শিক্ষার্থী নুসরাত জেরিন জিনিয়ার সাহায্যার্থে সবার পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সাড়া দিয়েছিলেন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এই উচ্ছ্বল, মায়াময়, প্রাণদীপ্ত ছোট্ট আর্যের সাহায্যার্থেও তিনি আমাদের আবেদনে অবশ্যই সাড়া দেবেন।
আর্য ফিরে আসুক তার পাগলপ্রায় মায়ের আঁচলতলে। আর্য ফিরুক বাতিঘরের শিশু কল্লোলে। আর্য অজেয় হয়ে ফিরুক!
১৮ মাস পর যেন আমরা শুনতে পাই, 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...'
আর্যকে আর্থিক সাহায্য পাঠাতে পারেন-
bKash
০১৭১১-৪৩৩৯৬৫ ও ০১৭৬৬-০৮০৯০৯
নাজমুস সাকিব অনিক (আর্যর খালাতো ভাই)
Bank Account
শুধু বাংলাদেশ থেকে ব্যবহারের জন্য
NAZMUS SAKIB ONIK
A/C NO : 18-1202489-01
STANDARD CHARTERED BANK
Bangladesh.
সারা বিশ্ব থেকে ব্যবহারের জন্য
Susmita Moitra
Indian Bank
A/C NO : 00612477274
IFSC code IDIB000V086
Branch code 1585
Branch name V086