পুরোনো লঞ্চের সঙ্গে অব্যবস্থাপনা ও দুর্ভোগ
‘২০ থেকে ৩০ বছর আগের পুরোনো লঞ্চ দিয়ে চলছে ঢাকার সঙ্গে বরগুনার নৌ যোগাযোগ। বরগুনা থেকে এক দুপুরে রওনা দিলে ঢাকায় পৌঁছাতে লাগে ২৪ ঘণ্টা।’
বরগুনা থেকে ঢাকাগামী লঞ্চে বসে বরগুনার এক বাসিন্দা এ কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘বরগুনায় জনগণের পক্ষে কোনো নেতা নেই। যদি থাকত তাহলে কি আর বরগুনার ঘাটে এসব লঞ্চ চলতে পারে? এটা কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো? হাজার জনতার এ দুর্ভোগ দেখার জন্য বরগুনায় কি কেউ নেই?’
বরগুনার নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার সেবার মান নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে অপর যাত্রী ইউসুফ আলী মল্লিক বলেন, ‘বরগুনার আমতলী উপজেলা থেকে যেসব লঞ্চ ঢাকা যায় তাতে শুধু আমতলী ও মির্জাগঞ্জ এ দুটি উপজেলার যাত্রীরা যাতায়াত করে। তারপরও তারা ব্যবসায়িক দিক দিয়ে ভালোভাবে টিকে আছে। তাঁদের লঞ্চের মানও ভালো। অথচ বরগুনা থেকে যেসব লঞ্চ ছেড়ে যায় তাতে বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলাসদরসহ, পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী ও কাঁঠালিয়া উপজেলার হাজারও যাত্রী প্রতিদিন এ রুটেই যাতায়াত করার কথা। শুধু সেবার নিন্মমান এবং লঞ্চ-মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এ রুট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যাত্রীরা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনা-ঢাকা রুটে মোট নয়টি লঞ্চ আছে। নয়টি লঞ্চের মধ্যে একজন মালিকেরই আছে চারটি লঞ্চ। এসব লঞ্চের মালিকরা সিন্ডিকেট করে তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার মধ্য দিয়ে ব্যবসা করে আসছেন। বরগুনার ক্রোক এলাকার একজন স্থানীয় অধিবাসী মো, মাসুদ (৪৭) জানান, সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন মাত্র একটি লঞ্চ ছাড়ছে মালিকরা। ফলে সেবার মানের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। কারো কাছে তাঁদের কোনো জবাবদিহিতাও নেই। তিনি আরো বলেন, ‘যাত্রী সেবার মান ভালো হলে দু’টি লঞ্চ দিয়েও এখানে কুলোতে পারত না মালিকরা। তারা ইচ্ছে করেই যাত্রী সেবার মান ভালো করছে না। তাঁরা পণ্য পরিবহন করেই অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ করতে আগ্রহী।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা-বরগুনা-ঢাকা রুটের একটি লঞ্চের একজন সুকানি (চালক) বলেন, ‘এই রুটে অনেক যাত্রী আছে। কিন্তু নানা কারণে আমরা সময়মতো ঢাকা-বরগুনা পৌঁছাতে না পারায় সেসব যাত্রী বাধ্য হয়েই সড়কপথে যাতায়াত করে থাকে। তারপরও যেসব যাত্রী নৌপথ ভালোবাসেন অথবা অন্যকোনো কারণে বাধ্য হয়ে এসব লঞ্চে ওঠেন তাঁরা সবাই আমাদের ভর্ৎসনা করেন।’ এসব সমস্যার মূলে লঞ্চ-মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতাকেই দায়ী করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, ‘২০-৩০ বছর আগের পুরোনো লঞ্চ দিয়েই চলছে এ রুটের যাতায়াত। কেবিনের মান ভালো নয়, বাথরুম, রেস্টুরেন্ট কোনো কিছুই সময় উপযোগী নয়। মালিকরা যেহেতু বড় কোনো পুঁজি না খাটিয়েই এখানে ব্যবসা করতে পারছেন সেহেতু সেবার মান বাড়াতে তাদেরও আগ্রহ নেই। যাত্রীর চেয়ে এখন তারা পণ্য পরিবহনকেই গুরুত্ব দেন বেশি।’
এ ব্যাপারে বরগুনা প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, ‘বরগুনা রুটের লঞ্চ তো আর এখন যাত্রীবাহী নেই, এসব লঞ্চকে এখন পণ্যবাহী বলাই বোধ হয় ভালো।’ এ বিষয়ে তিনি নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করে বলেন, ‘আমতলী থেকে বিকেল ৫টায় ছেড়ে যদি পরের দিন সকাল ৬টার মধ্যে ঢাকা পৌছানো সম্ভব হয় তবে কেন বরগুনা থেকে বেলা দেড়টায় ছেড়েও পরের দিন ৬টায় ঢাকা পৌছাতে পারবে না ?’
এ বিষয়ে নৌবন্দর, বরগুনার বন্দর কর্মকর্তা মামুন অর রশীদ জানান, বরগুনায় যেসব লঞ্চ চলছে তার মান খুব ভালো না হলেও একেবারে খারাপও না। যাত্রী পরিবহনের চেয়ে পণ্য পরিবহন এবং সময় মেনে না চলার বিষয়ে তিনি বলেন, এই রুটে যাত্রী কম হয় তাই পণ্য পরিবহন করতে হয়। আর পণ্য পরিবহন করতে হলেই বিভিন্ন ঘাটে পণ্য ওঠা নামার জন্য সময় বেশি লাগে। আমতলী-ঢাকা রুটের লঞ্চগুলো কীভাবে পণ্য পরিবহন ছাড়াই যাত্রী সেবার মান ঠিক রেখে ব্যবসা করে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
‘আল্লাহর মর্জি’ নামের বরগুনা-ঢাকা রুটের একটি লঞ্চের একজন সুকানি (চালক) মো. নান্টু মিয়া বলেন, ‘ভোলার লাল মোহন, চরফ্যাশন এবং বোরহান উদ্দিন উপজেলায় একসময় এমন ভাঙ্গাচোরা লঞ্চ চলত। সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা একদিন লঞ্চ মালিকদের ডেকে বলেছিলেন, ‘এসব পুরোনো লঞ্চ আর এ ঘাটে চলবে না। নতুন লঞ্চ এনে চালাতে পারলে চালাও নইলে না।’ তাঁরা নাকি যাত্রা শুরু এবং শেষের সময় সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ঢাকা থেকে কয়টায় ছাড়বা জানি না। এখানে এসে পৌঁছাতে হবে সকাল ৬টার মধ্যে।’ সেদিনের পর থেকেই নাকি পাল্টে গেছে ভোলার রুটের লঞ্চ ঘাটের দৃশ্য। সময়সীমা মেনে সুদৃশ্য বিলাস বহুল একাধিক লঞ্চ চলছে এখন সেসব রুটে।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্বাস হোসেন মন্টু মোল্লা বলেন, ‘বরগুনার অধিকাংশ যাত্রীই আমতলী রুটের লঞ্চেই যাতায়াত করে। বরগুনা রুটের লঞ্চের মান তুলনামূলকভাবে খারাপ হওয়ায় এবং বরগুনা থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে বরগুনা পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার কারণে এ রুট থেকে যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’ এ বিষয়ে বরগুনা ১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সাথে আলাপ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে তিনি জানান।
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ প্রশাসক জাহাঙ্গীর কবীর জানান, বিষয়টি তাঁর নজরে রয়েছে। বিষয়টি তিনি দেখবেন বলেও জানান।