‘সামাজিক অন্যায়ের বিচার আমাকেই করতে হয়’
কিশোর-কিশোরীকে পেটানোর ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের কুণ্ডেরচর আব্দুল মান্নান মল্লিক কান্দি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ থেকে। এই ঘটনায় সালিস করা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত মল্লিককে আটক করেছে পুলিশ।
নির্যাতনের বিষয়টি একটি ‘বিচার’ দাবি করে আটক লিয়াকত বলেন, ‘এ দুর্গম চরে প্রশাসনের লোক আসে না। আমাকেই সামাজিক বিভিন্ন অন্যায়ের বিচার করতে হয়।’
urgentPhoto
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছেন কুণ্ডেরচর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কামাল মল্লিক, স্থানীয় বাসিন্দা আমির হোসেন মল্লিক ও সুজন মল্লিক। ওই তিন ব্যক্তি কিশোর-কিশোরীকে নির্যাতনে অংশ নেন। গ্রামে পুলিশ যাওয়ার পর থেকেই এঁরা পলাতক।
ভিডিওতে দেখা যায়, কিশোর-কিশোরীকে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে। এরপর তাদের জুতা দিয়ে পেটানো হয়। তিনজন ব্যক্তি তাঁদের পেটান। ছয় মিনিট ৪২ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুণ্ডেরচর আবদুল মান্নান মল্লিক কান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীর সঙ্গে প্রতিবেশী এক কিশোরের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তারা দুজন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর ঘাট থেকে তাদের আটক করে কয়েকজন যুবক। আটক করে তাদের আনা হয় কুণ্ডেরচর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত মল্লিকের বাড়িতে। লিয়াকত মল্লিকের নির্দেশে বাড়ির উঠানে তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। পরের দিন তাদের নেওয়া হয় কুণ্ডেরচর আব্দুল মান্নান মল্লিক কান্দি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে গলায় জুতার মালা পরানো হয়। কুণ্ডেরচর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কামাল মল্লিক, স্থানীয় বাসিন্দা আমির হোসেন মল্লিক ও সুজন মল্লিক ওই দুই কিশোর-কিশোরীকে জুতা দিয়ে পেটাতে থাকেন। পরে তাদের হাত বেঁধে বিদ্যালয়ের মাঠে ফেলে রেখে যান। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেন।
কিশোর-কিশোরীদের স্বজনদের অভিযোগ, এ ঘটনাটি কাউকে না জানানোর জন্য তাঁদের পরিবারকে হুমকি দেন কামাল মল্লিক। এমনকি তাদের চিকিৎসার জন্য গ্রামের বাইরে না নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিশোরীর ভাই বলেন, ‘আমার বোন ছোট মানুষ, জীবন সম্পর্কে বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি। সে কোনো অন্যায় কাজ করলে আমাদের জানাতে পারত। আমাদের না জানিয়ে লিয়াকত মল্লিক ও কামাল মল্লিক নেতৃত্ব দিয়ে প্রকাশ্যে ওদের নির্যাতন করেছে। এমনকি তারা দুজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের চিকিৎসার জন্য গ্রামের বাইরে নিতে দেয়নি।’
কিশোরের বাবা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ছেলে কৃষিশ্রমিকের কাজ করে। সে কোনো অন্যায় করলে আমরা রয়েছি, দেশে আইন আছে। কামাল মল্লিকের সঙ্গে এলাকায় আমাদের বিরোধ রয়েছে, এ কারণে সে এভাবে আমার ছেলেকে নির্যাতন করেছে। আমি ঘটনাটি জাজিরা থানায় জানিয়েছিলাম। পুলিশ বলেছে, ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু পুলিশ আর আসেনি। তাদের নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও প্রচার হওয়ার পর পুলিশ এসেছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই কিশোরী বলে, ‘আমাকে বেদম নির্যাতন করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের মাঠে আমাকে নির্যাতন চালানোর সময় আমাকে বাঁচাতে কোনো শিক্ষক ও সহপাঠীরাও এগিয়ে আসেনি। আমি চিৎকার করে সাহায্য চেয়েছি। সবাই দাঁড়িয়ে মজা দেখেছে। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। একটি ছেলেকে ভালোবেসেছি। তাঁকে নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলাম। এখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
নির্যাতনের শিকার কিশোর বলে, ‘আমাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাদের পায়ে ধরেছি, তাতেও তারা আমাদের নির্যাতন করা বন্ধ করেনি।’
অভিযুক্ত কামাল মল্লিক, আমির হোসেন মল্লিক ও সুজন মল্লিক এখন পলাতক। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
কুণ্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত মল্লিক বলেন, ‘এ দুর্গম চরে প্রশাসনের লোক আসে না। আমাকেই সামাজিক বিভিন্ন অন্যায়ের বিচার করতে হয়। ওই ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে অসামাজিক কাজ করার অভিযোগ ছিল। এ ঘটনাটির বিচারও আমি করেছি। ছেলেমেয়ের অভিভাবককে খবর দেওয়া হয়েছিল, তারা উপস্থিত না হওয়ায় তাদের ছাড়াই বিচার করা হয়েছে। স্কুলমাঠে কারা তাদের জুতাপেটা করেছে তা আমার জানা নেই।’
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীকে নির্যাতনের ভিডিওটি থানায় আসার পরে পুলিশ ওই চরে গিয়েছিল। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত মল্লিককে আটক করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ওসি নজরুল। কিশোরের বাবা আসমত আলী খান বাদী হয়ে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন ওসি।