গাজীপুরে ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস’ পালিত
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/03/19/photo-1426780577.jpg)
মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির অস্ত্র প্রথম গর্জে উঠেছিল ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। সেদিন গাজীপুরে (তৎকালীন জয়দেবপুর) জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
সেই সশস্ত্র প্রতিরোধের ৪৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গাজীপুরে দিনটি পালিত হয়। আজ বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে।
কর্মসূচির মধ্যে ছিল সশস্ত্র প্রতিরোধে শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিবসটি উপলক্ষে সকালে শহীদ হুরমত, নিয়ামত, মনু খলিফাসহ শহীদদের কবর জিয়ারত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি।
এ সময় গাজীপুর মহানগরের জয়দেবপুর চৌরাস্তায় শহীদ হুরমতের কবর প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার মিয়ার সভাপতিত্বে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হোসেন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী মোজাম্মেল হক প্রমুখ।
আলোচনা সভায় সেদিনের প্রতিরোধকারী ও মুক্তিযোদ্ধারা দিনটি নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। তাঁদের বিবরণীতে জানা যায়, সে সময় জয়দেবপুরের ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ীতে (বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল। রেজিমেন্টের ২৫-৩০ জন জওয়ান অফিসার ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি। রেজিমেন্টের অধিনায়ক (সিও) ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদ হাসান খান এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। এদের সবাই ছিলেন মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আর বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ এ ক্যান্টনমেন্টের অবস্থানরত বাঙালি কর্মকর্তাদের স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি পাকবাহিনীর জওয়ানরা।
জওয়ানরা পাক সেনাবাহিনীর ঢাকা সদর দপ্তরে অফিসারদের মুজিবের প্রতি আনুগত্যের খবর পাঠায়। আর তাই বাঙালি কর্মকর্তাদের দমিয়ে রাখার জন্য তাঁদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা করেন সদর দপ্তরের পাকিস্তানি কর্মকর্তারা। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ আসে ১৫ মার্চের মধ্যে ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেল ও গোলাবারুদ সদর দফতরে জমা দেওয়ার জন্য।
সদর দপ্তরে অস্ত্র জমা না দেওয়ার কৌশল হিসেবে অস্ত্র নিয়ে গাজীপুর থেকে ঢাকায় যাওয়া নিরাপদ নয় বলে জানিয়ে দেন রেজিমেন্টের অধিনায়ক। কিন্তু সে অজুহাতে সন্তুষ্ট হননি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। এবার নির্দেশ এলো ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব নিজেই ১৯ মার্চ এক কোম্পানি সৈন্যসহ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে আসবেন। অস্ত্র জমা নিতেই যে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের এ কৌশল, তা বুঝতে বাকি রইল না কারো। রেজিমেন্টের কয়েকজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জানিয়ে দেন।
এদিকে জয়দেবপুর (গাজীপুর) সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেবের নেতৃত্বে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সৈন্য আসছে এ খবরে গাজীপুরের সর্বস্তরের জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সারা শহর থেকে হাজার হাজার উত্তেজিত লোক এসে ভিড় জমাতে থাকে জয়দেবপুর বাজারে। সমরাস্ত্র কারখানা এবং বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শত শত শ্রমিক-কর্মচারীও এসে যোগ দেন উত্তেজিত জনতার সঙ্গে। লাঠি, তীর, বল্লমসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জনতা ক্রমশ জঙ্গি রূপ ধারণ করে। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ইট, কাঠ, পাথর দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। রেলস্টেশন থেকে একটি মালগাড়ির ওয়াগন ঠেলে এনে রেলক্রসিংয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব রাস্তা অবরোধের খবর পেয়ে এবং সেনানিবাসে বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈন্যদের সতর্ক অবস্থা দেখে তাদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা বাদ দেন। কিন্তু ঢাকায় ফেরার মুখে জয়দেবপুর রেলস্টেশনের কাছে তিনি বাধার মুখে পড়েন। রাস্তা ফাঁকা করার নির্দেশ দেন। বাধ্য হয়ে বাঙালি সেনারা ফাঁকা গুলি করে। গুলির শব্দ শুনে উত্তেজিত জনতা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাথর নিক্ষেপ শুরু করে।
এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ট্রাক টাঙ্গাইলে রেশন দিয়ে জয়দেবপুরে ফিরছিল। ট্রাকটি জয়দেবপুর মসজিদের কাছে পৌঁছালে জনতা ট্রাকটি আটকে ফেলে। বাঙালি সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে পাঞ্জাবিদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ট্রাকের বাঙালি সৈন্যরাও জনতার সঙ্গে যোগ দেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এটাই ছিল বাঙালিদের প্রথম গুলিবর্ষণের ঘটনা।
জয়দেবপুরের প্রতিরোধ সামাল দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী কোনোমতে ঢাকার পথে রওনা হয়। ওরই মধ্যে জয়দেবপুরে এ সংঘর্ষের খবর পেয়ে ওখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে চান্দনা চৌরাস্তায় স্থানীয় জনগণ জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় পাক সেনাদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে হুরমত, নিয়ামত ও মনু খলিফা শহীদ হন এবং অনেকে আহত হন।
জয়দেবপুরে সশস্ত্র এ প্রতিরোধের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। প্রথম প্রতিরোধের এ ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে বিশাল অবদান রেখেছিল। আর সে কারণেই ঢাকাসহ সারা দেশে সেদিন স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
সভায় আলোচনাকারীরা জানান, প্রতিবছর স্থানীয়ভাবে দিবসটি পালিত হলেও স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
দিনটি উপলক্ষে আজ সন্ধ্যায় গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী মাঠে আতশবাজি, লেজার শো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।