নৌকায় ভোট দিলেও মার, না দিলেও

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের কাপসণ্ডা গ্রামবাসী অভিযোগ করে বলেছেন, তারা নৌকায় ভোট দেননি, তাই তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, মারধরও করা হয়েছে। এখন আর তারা বাড়িতে উঠতে পারছেন না।
অপরদিকে তালা উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তারা নৌকায় ভোট দিয়ে এখন মার খাচ্ছেন। তাদের গ্রামের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীকে কেন ভোট দেওয়া হয়নি সেই কৈফিয়ত তলব করে মারধর করা হচ্ছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী জেলার নানা স্থানে এভাবেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন এসব বিরোধ নিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। ভোট নিরপেক্ষ হয়নি দাবি করে তারা সংবাদ সম্মেলন করে প্রশাসনের নজর কাড়ার চেষ্টা করছে।
যদিও গ্রামবাসী যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছে তারা তা অস্বীকার করছে।
তালা উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামে নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনায় অনেকে বাড়ি থেকে সরে রয়েছে। তাদের দাবি, তারা নৌকায় ভোট দিয়েছে তাই হামলা চালিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকর্মীরা।
মাদরা গ্রামের শিক্ষক রাজীব সরকার বলেন, ‘আমার মা গীতা রানী সরকারকে মারধর করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, তুমি যে হাত দিয়ে নৌকায় ভোট দিয়েছ সেই হাত ভেঙে দিলাম।’
এ ছাড়া স্থানীয় রেজাউল মেম্বারের মাথায় আঘাত করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে সুশীল মণ্ডল, দিলীপ মণ্ডল, সুদেব গাইন, তাপস সরকার, ভক্ত প্রসাদ ও ললিত গাইনসহ অনেকের বাড়ি ।
মাগুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বাসুদেব সরকার বলেন, ‘আমরা মাদরা গ্রামের প্রায় ৫০০ ভোটার নৌকায় ভোট দিয়ে বাড়ি ছেড়েছি। আমাদের গ্রামে দুই হাজার ৬০০ ভোট । নিজের গ্রাম হওয়ায় ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিরন্ময় মণ্ডল পেয়েছেন দেড় হাজার ভোট। আর নৌকা পেয়েছে ৫০০ এর মতো ভোট। এতে গ্রামবাসীর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন হিরন্ময় এবং তাঁর সমর্থকরা। ’
এলাকার আইনজীবী সহকারী তুষার সরকার বলেন, ‘হিরন্ময়ের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।
এলাকার অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, তারা হাতুড়ি মার্কায় ভোট না দেওয়ায় এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের নৌকায় কেন ভোট দেওয়া হলো এখন হিরন্ময়ের সমর্থকরা তার কৈফিয়ত চাচ্ছে।
তবে হিরন্ময় মণ্ডল এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ‘এটা নৌকা আর হাতুড়ি মার্কার বিরোধ নয়। মঞ্চে অতিথি হওয়া নিয়ে কিছুটা বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল।’
হিরন্ময় মণ্ডল আরো জানান, ভোটের পরদিন ২৩ মার্চ তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ও তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষ সনৎ কুমার মাদরায় কবি গান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের গণেশ দেবনাথ। মঞ্চে তাঁকে প্রধান অতিথির আসনে বসানো নিয়ে আমার সঙ্গে বিরোধ বাধে।’
এ সময় অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি মারামারি পর্যন্ত যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎকে উদ্ধার করে।
হিরন্ময় মণ্ডল আরো বলেন, ‘২৩ মার্চ মাগুরা থেকে আওয়ামী লীগের গণেশ দেবনাথের পক্ষে কিছু লোকজন এসে আমাদের লোকজনকে মারধর করে। তারই জেরে সংঘর্ষ হয়। এখন আমাদের গ্রামের লোকজন মাগুরা এলাকায় যেতে পারছেন না। পাঁচু গোপাল ও ফাল্গুনি সরকার চাকরি করেন। তাদেরকেও চলার পথে বাধা দিচ্ছেন গণেশ দেবনাথের লোকজন।’
তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছগির মিয়া বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি শান্ত। নতুন কোনো সংঘর্ষ যাতে না ঘটে সে জন্য আমরা সতর্ক রয়েছি।’
এদিকে আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, তারা আওয়ামী লীগ করেন এবং নৌকায় ভোট দেন। এবারই তারা নৌকায় ভোট দেননি।
এবার কেন নৌকায় ভোট দেননি এর কারণ জানাতে গিয়ে তারা বলেন, খাজরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদে মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। যাকে এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি একজন রাজাকারের ছেলে। ফলে ক্ষুব্ধ হয়েই তারা নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ভোট দিয়েছেন রুহুল কুদ্দুসের ঘোড়া মার্কায়।
খাজরা গ্রামের এবাদুল ঢালি বলেন, ‘নৌকায় কেনো ভোট দেইনি তার প্রতিশোধ নিচ্ছেন বিজয়ী চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ ডালিম। তার লোকজন আমাদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে। তাদের হাতে আহত হয়েছেন গ্রামের রাবেয়া খাতুন, সুফিয়া খাতুন, রাশিদা বেগম, নাজমা বেগম, রেবেকা খাতুন, মনোয়ারা খাতুন ও নূরজাহান বেগমসহ অনেকেই। এ ছাড়া হামলা হয়েছে আফিল ঢালি, আফজাল ঢালি, বকুল ঢালি, রসুল ঢালি, নান্টু ঢালির বাড়িঘরে।’
আফিল ঢালির বাড়িতে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কাপসণ্ডার আইয়ুব সানা, হাকিম সানা, হান্নান সানা, আজিজ গাজী, আসাদুল ও আশরাফুল গাজী জানান, আফিল ঢালী তাদের জমি জোর করে দখল করে রেখেছিল। তাই ভোটের পরের দিন বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছেন তাঁরা। এর সঙ্গে ভোটাভুটির কোনো সম্পর্ক নেই।