মোটা রাস্তায় সরু সেতু, হুড়মুড়িয়ে পড়ল মানুষ
নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের রাজঘাটে স্নান করলে অধিক পুণ্য পাওয়া যায়—ঘাটে পুণ্যস্নানে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেশির ভাগের ধারণা এমনটাই। এ কারণেই মহাষ্টমী তিথিতে রাজঘাটে মানুষের চাপ বেশি থাকে। কিন্তু এ চাপ সামলানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
আজ শুক্রবার সকালে পদদলিত হয়ে ১০ জন নিহত হওয়ার পেছনে এই অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা।
মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আবদুল কাদির বলেন, প্রতিবছর মহাষ্টমীর স্নানে লাখ লাখ মানুষ আসে। কিন্তু এত মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তা ও সেতুগুলো প্রশস্ত করা হয় না। ১৮ ফুট রাস্তার ওপর বেইলি সেতুগুলো ১৪ ফুট। বেইলি সেতুগুলোতে ঠাসাঠাসি লোকগুলো আজ যেভাবে ধাক্কা দিল, তাতে হুড়মুড় করে পড়ল কতগুলো মানুষ। আর সেই মানুষের ওপর দিয়ে স্রোতের মতো মানুষ ছুটল। আশপাশের দোকানগুলোর ওপর গিয়েও পড়ল অনেক মানুষ। সেতু এবং রাস্তাগুলো আরো প্রশস্ত করা দরকার।
আবদুল কাদির বলেন, স্নানের একদিন আগে থেকেই এ এলাকায় পুণ্যার্থীরা আসতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের থাকার মতো তেমন সুব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু সেবাদান প্রতিষ্ঠান শামিয়ানা টানিয়ে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। সরকারিভাবে বাসস্থানের ব্যবস্থাও করা দরকার।
মানিকগঞ্জ থেকে আসা ২২ বছর বয়সী মালতী দাস পদদলিত হয়ে মারা গেছেন। তাঁর বড় ভাই নিতাই দাসও পদদলিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন।
নিতাই দাস জানান, রাজঘাটে স্নান শেষে ফিরছিলেন তাঁরা। ঠেলাঠেলি করে বেইলি সেতুতে ওঠার পরপরই বিপরীত দিক থেকে হুড়মুড় করে ধাক্কা আসে। সেই ধাক্কায় তাঁরা পেছনের দিকে পড়ে যান। নিতাই চন্দ্র দাস নামের তাদের আরো এক স্বজনও এ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
কুমিল্লা থেকে আসা নিহত রঞ্জিত দাসের স্বজন ভবতোষ বলেন, ‘মানুষ এত বেশি যে চাপ সহ্য করা যাচ্ছিল না। আমিও পড়ে গিয়েছিলাম। আমার ওপর দিয়ে অসংখ্য পায়ের চাপ গেছে। আর কিছুক্ষণ হলে মারা যেতাম। ভগবান বাঁচিয়েছে আমাকে। ’
নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ও লাঙ্গলবন্দ স্নানের পুণ্যার্থীদের সেবাদানকারী প্রেমতলা আশ্রমের কর্মকর্তা ভবানী শংকর রায় অভিযোগ করেন, ১৫টি স্নানঘাট কচুরিপানায় ভরা। এ জন্য স্নান করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া নদীর নাব্যতা কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। ড্রেজিং করার প্রয়োজন আছে।
স্নান উদযাপন কমিটির সভাপতি পরিতোষ কান্ত সাহা বলেন, অতিরিক্ত চাপের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। স্নান এলাকার তিন কিলোমিটারজুড়ে অনেক দেবোত্তর সম্পত্তি জাল দলিল করে ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়ে গেছে। এ কারণে রাস্তা ও ঘাটে জায়গা কমে গেছে। এসব জায়গা উদ্ধার করতে সরকারের সহায়তা জরুরি।
পরিতোষ বলেন, ২০১৩ সালে লাঙ্গলবন্দকে আমব্রেলা প্রজেক্টের আওতায় আনার প্রস্তাব একনেকে পাস করে সরকার ২০ কোটি টাকা বাজেট করেছিল। সেই প্রজেক্টে হোটেল, মোটেল ও নৌ চলাচলের সুব্যবস্থাসহ ব্রহ্মপুত্রের দুই পাড়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম স্থাপনা গড়ে তোলার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু টাকার অভাবে সরকার সেটি স্থগিত রেখেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স করে তাঁদের লাশ নিজ নিজ বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সেলিম ওসমান মনে করেন, হরতাল-অবরোধে মানুষ বের হতে পারেনি। এখন লম্বা এক ছুটি পেয়ে অনেক মানুষ বেরিয়ে এসেছে। পুণ্যার্থীর সংখ্যাও অতিরিক্ত। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে আগামীতে যাতে এমন দুর্ঘটনার শিকার হতে না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।