কেউ আতঙ্কে, কারো মাতম
মানবপাচারকারী চক্রের প্রলোভনে পড়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন অনেকে। ভালো কাজ ও জীবনের আশায়। কিন্তু এ জন্য জিম্মি হতে হচ্ছে, এমনকি মৃত্যুও হচ্ছে। মুক্তিপণ দিয়েও স্বজনদের ফিরে পাচ্ছে না অনেক পরিবার, ফিরছে লাশ হয়ে।
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকটি গণকবর পাওয়ার পর নিখোঁজ স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে একটি গণকবর থেকে উদ্ধার করা ২৬টি লাশের মধ্যে ১০টি বাংলাদেশির।
নরসিংদীর কয়েকটি পরিবারে চলছে আহাজারি আর মাতম। স্বজনদের অশ্রু আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নরসিংদীর শিবপুরের মুনসেফচর এলাকার হান্নান মিয়া ও মোয়াজ্জেম সাগর পথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পৌঁছাতে পারেননি। দালালদের হাতে জিম্মি হন থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। দালালদের চাহিদামতো মুক্তিপণ দিতে না পারলেই তাঁদের ওপর নেমে আসত অমানুষিক নির্যাতন। খাবার পানি চাওয়ার মতো তুচ্ছ অপরাধে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় হান্নান মিয়াকে।
এদিকে, নিজের জীবন বাঁচাতে দালালদের কথামতো পরিবারের কাছে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা চান মোয়াজ্জেম। দালালদের কথামতো স্থানীয় দালাল মনিরের হাতে মুক্তিপণের টাকাও তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো তাঁকে ফিরে পায়নি মোয়াজ্জেমের পরিবার। টাকা নিয়ে লাপাত্তা মনির। দালাল মনিরের বাড়ি গিয়ে পাওয়া যানি কাউকে।
মোয়াজ্জেমের বাবা আকবর আলী বলেন, ‘মনির মিয়ার (দালাল) সঙ্গে যোগাযোগ করার পর মনির আর আমার এখানে আসতে রাজি না। মনির আমার কাছ থেকে টাকা নিছে; যেহেতু আমার ছেলে বলছে। পরে হেগোর (এলাকাবাসী) সহযোগিতা লয়া হেগোর লগে পরামর্শ কইরা মনিরের কাছে আমরা টাকা দিছি, দুই লাখ ২০ হাজার। টাকা দেওয়ার পরে রিসিভ (ছেলের সঙ্গে কথা) করায় দিব। আমার লোক আনাইছে। ওই দিন সকাল থেকেই মনির আউট। আর কোনো খোঁজখবর পাইতেছি না। ওনে যে ফোন দিয়ে আমার পুলার লগে কথা কয়াইছে আমার লগে হেই ফোনে কথা কই। হেনে লোকেরা কইতাছে ওরে মিয়া মোয়াজ্জেমের জন্য ট্যাহা দেয় নাইক্যা। আমি কই ভাই আমি তো ট্যাহা দিয়া দিছি। আমরা ট্যাহা পাইছি না। অহন আমরা ট্যাহা পাব আপনে আপনার পোলা পাবেন। কয়ে কাইটা দেয়। আমারে আরো ধমক দ্যায়।’ মোয়াজ্জেমের মতো নিখোঁজ রয়েছেন সদর উপজেলার মাদবদী নুরালাপুর গ্রামের মোমেনও।
থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে দালালদের হাত থেকে বন্দিদশা থেকে ফিরে এসেছেন নরসিংদীর চরাঞ্চলের করিমপুরের আলী হোসেন। তিনি দালালদের লোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নৌযান করে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা থেকে জীবিত ফিরে এসেছেন মিঠু দাশ। সেই স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। কেউ যেন অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা না করে সেই অনুরোধ জানান তিনি।
মিঠু দাশ বলেন, ‘এলোপাতাড়ি গুলি আর কি। শটগান দিয়ে গুলি করে থাইল্যান্ডের লোকজন। অন্য শিপ, শিপ আরো চার-পাঁচটা আর কি। আমাদের শিপ একটাই না; আরো চার-পাঁচটা আছিল। ওইগুলা আইছে। আওয়ার সাথে সাথেই আইসাই গুলি। গুলি লাইগা আপনার প্রায় অনেকগুলা পইড়া গেছে। সাত-আষ্টজনের মতো পানির মধ্যে। আর কিছু যেগুলা সাইটে আছিল ওইগুলা সাইটে পইড়া রইছে। আমার সঙ্গে চারজন ছিল। চারজনের মধ্যে তিনজনই মারা গেছে। এ রকম অবস্থা যে গুলি খাইছে, গুলি খাওয়ার পর আমারে কইতাছে ভাই আমারে একটু পানি খাওয়াও। আমি কিছু করতে পারতামছি না। কারণ আমি যদি উঠতে যাই, আমিও গুলি খামু। ওই ঘটনা মনে হইলেই দেখা যায় যে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। রাত্রে যখন ঘুমাই, তখন ওসব কথা যখন মনে পড়ে তখন আর ঘুম ধরে না। যারাই বিদেশ যাক তারা যেন শিপে কিংবা ওভাবে না যায়। অবৈধভাবে যেন না যায়। সবাই যেন বৈধভাবে যায়।’
এদিকে হান্নান মিয়ার মৃত্যুর খবরে পরিবারজুড়ে চলছে শোকের মাতম। নিহত হান্নানের অবুঝ দুই সন্তান এখনো জানে না তাদের বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছে। তাই হান্নান মিয়ার স্ত্রীর আর্তনাদ, যাঁকে ঘিরে তাঁর পৃথিবী সৃষ্টি, সেই হান্নানকে ছাড়া কীভাবে চলবে জীবনঘড়ি।
নিহত হান্নানের স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, ‘খবর আসছে শনিবারের দিন, ওর সঙ্গে যে লোক গেছে হের সঙ্গে দেখা হইছে। কিরে মোয়াজ্জেম তুই এহানে হান্নান ভাই কই। হান্নান ভাই তো নাই, হান্নান ভাইরে তো মাইরে দিছে। কী নিয়ে মারছে, কেরে মারছে। কয় এমন এমন। পানি নিয়ে ঝগড়া হইছে। এরপর গলা কাইটা নদীতে ফেলায় দিছে।’ তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পর কী হবে বাড়ির অবস্থা আপনি বোঝেন না? বাড়ির যে কী অবস্থা হইব, আমার যে দুটি সন্তান আজকে রাইখা গেছে। আমার কীভাবে জীবন যাবে, কীভাবে আমার সন্তানদের জীবন যাবে সেটা কি আপনারা বোঝেন না? আমার তো সব কিছু শেষ হয়ে গেছে আজকা। আমার তো কিছুই রইল না এ জগতে। যারে দিয়ে এই পৃথিবী সৃষ্টি সেই তো নাই। আর জীবন কীভাবে যাবে সেটা আপনারা বোঝেন না? আমার তো ভারসাম্য নাই আমি কী বলব আপনাদের। আমি শুধু আমার স্বামীকে চাই। হয় আমার স্বামীকে দেবে আর না হয় আমার ছেলেমেয়ে ও আমার জীবন কীভাবে যাবে সেটা ওরা বুঝবে।’
কিন্তু যাদের তত্ত্বাবধানে এসব তথ্য থাকার কথা, সেই কর্মসংস্থান ও জনশক্তি বিভাগের কর্মকর্তারা উত্তর দিলেন দায়সারাভাবে। জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা শহিদুল আলম বলেন, ‘নরসিংদীর যে বিষয়টা বলছেন যে বিদেশে গিয়েছে বা মারা গিয়েছে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আমার কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে বা আপনারা জানিয়েছেন। আমরা ওপরে বিষয়টা জানার চেষ্টা করব। জানতে পারলে অন্যত্র আপনাদের আমি বিষয়টা জানাতে পারব। আমাদের সব জায়গায় কিন্তু লেবার উইংটা নাই। আমাদের অ্যাম্বাসি আছে অথচ সেখানে আমাদের লেবার উইং নাই। থাইল্যান্ডে আমরা কোনো সরকারিভাবে কিংবা বেসরকারিভাবে আমরা কোনো কর্মী কখনোই প্রেরণ করি নাই। ওখানে কোনো কর্মী যায় না। ওখানে আমাদের কোনো কর্মসংস্থানের বিষয় নাই। থাইল্যান্ডের যে বিষয়টি এটি সম্পূর্ণ হ্যান্ডেল হচ্ছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়টি জানা থাকতে পারে। এই বিষয়ে আপনাদের অধিকতর জানার জন্য আপনারা প্রয়োজনবোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বা সে রকম কোনো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টা জানতে পারেন।’
নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগম জানান, দালালদের বিরুদ্ধে মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ শংখলার পাদাং বেসার এলাকার কয়েকটি গণকবর পাওয়া গেছে। কয়েকদিন আগে পাওয়া একটি গণকবর থেকেই অন্তত ১০ বাংলাদেশিসহ ২৬টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।