সাপ নিয়ে ঝাপান গান, মাতল মেহেরপুর

ছোট একটি মঞ্চকে ঘিরে চারপাশে হাজারো দর্শক। মঞ্চের ওপর বাঁশের তৈরি ঢাকনাওয়ালা দুটি ঝাঁপি। বাজানো হচ্ছে বীণ। ঝাপি থেকে বেরিয়ে আসছে বিশাল আকৃতির সাপ। মাঝেমধ্যে ফণা তুলে মারছে ছোবল।
গ্রাম-বাংলায় এ খেলাটিকে বলা হয় ঝাপান খেলা। খা খা লক্ষ্মীলারে খা, কাচা ধইরা খা, মরা পতি লইয়া বেহুলা কান্দেরে, সাপে পায়ে কামড় দিয়া গেল রে, ওরে বিধির কিনা না রে হইল রে। সাপকে বশে আনতে এমন নানা গানের মাধ্যমে বাদ্যের তালে তালে ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর সব গোখরা সাপ। উপস্থিত দর্শকের করতালি একটুও বিচলিত করতে পারে না ফণা তুলে এই নাচিয়েকে। মনিবের ইশারা-ইঙ্গিত তাকে ঠিক বুঝিয়ে দিয়েছে, শুধু মানুষকে আনন্দ দেওয়ার খেলা নয় বরং আজ মর্যাদার লড়াই।
মেহেরপুরের গাংনীর উপজেলার চৌগাছা ক্ষুদ্রঋণ সমবায় সমিতি গতকাল শুক্রবার দিনব্যাপী চৌগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এ খেলার আয়োজন করে।
দিনভর দেশের ১৬টি জেলার ১৬টি দল এই খেলায় অংশ নেয়। হাজারো দর্শকের মুহুর্মুহু করতালিতে ঝাপান খেলা হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর।
বিষধর সাপকে বশে নিয়ে সাপের শরীর কত বেশিক্ষণ ওপরে তুলে খেলা করানো যায় মূলত এটাই ছিল অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা। যার সাপ যত বেশি উঁচু হয়ে বেশি সময় মঞ্চে থাকতে পারে সেই সাপুড়ে বেশি পয়েন্ট পান। খেলা শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
এদিকে ঝাপান খেলা দেখতে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো দর্শক হাজির হয়। বাদ পড়েনি নারী দর্শকরাও। ঢাক-ঢোলের বাদন আর নাচগানে সাপুড়েরা দর্শকদের মন ভরিয়ে তোলেন। সাপুড়েকে নিজে নাচতে হয় আর সাপও তার সঙ্গে হেলেদুলে নাচে।
অনেকে জীবনে প্রথম আবার অনেকে অনেক দিন পর দেখছে এ খেলা। এই ‘ঝাপান খেলা’ দেখে খুবই আনন্দিত হয় দর্শক।
ঝাপান খেলা দেখতে আসা দর্শকরা জানাল, কালের বিবর্তনে লোকাচারের অনেক কিছুই এখন হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঝাপান খেলার কোনো হেরফের হয়নি। সেই মধ্যযুগ হয়ে একবিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে এখনো সমান জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এটি। প্রতিবছর এই ধরনের আয়োজন হলে ভালো হতো।
সাপুড়েদের কাছ থেকে জানা যায়, দেবতার তুষ্টি স্বামী ভক্তি কাহিনী সম্বলিত আবহমান খেলার নাম ঝাপান খেলা। লখিন্দরদের জীবন বাঁচাতে দেবপুরীতে পৌঁছে সাপের সঙ্গে নেচেগেয়ে স্বর্গের দেবতাদের খুশি করে দেবতাদের অনুরোধে মনসা লখিন্দরসহ তাদের অন্য সন্তানদের জীবন ফিরিয়ে দেয়। বেহুলা সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফেরে। সাপের ওপর আক্রমণ নয়, ঝাপান গানের মাধ্যমে সাপকে বশে আনতে পারলে যে কোনো ক্ষতি থেকে মুক্তি হবে এমন বিশ্বাস সাপুড়েদের। জনগণকে এই মন্ত্রে মুগ্ধ করতে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে এই ঝাপান খেলা করে থাকেন।
খেলা শেষে বেশি সময় ধরে খেলা দেখানোয় নির্বাচক কমিটি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার সাপুড়ে লিটন হোসেনকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে। প্রথম রানার আপ হন যশোরের বন্ডবিল গ্রামের ইমাদুল ও দ্বিতীয় রানার আপ হন সিরাজগঞ্জে শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের শহিদুল ইসলাম।
খেলা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ছুরমান ইসলাম, সদস্য সচিব ডা. তৌহিদুল ইসলাম বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। চ্যাম্পিয়ন ও প্রথম রানার আপকে পুরস্কার দেওয়া হয় একটি করে ছাগল। দ্বিতীয় রানার আপ অর্জনকারী সাপুড়েকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় এক হাজার টাকা।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক, মেহেরপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) শেখ মোস্তাফিজুর রহমান, গাংনী থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুল ইসলামসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ঝাপান খেলা উপভোগ করেন।
খেলায় চ্যাম্পিয়ন সাপুড়ে লিটন হোসেন জানান, ছোটবেলা থেকে তিনি এই ঝাপান খেলা করে আসছেন। মানুষকে আনন্দ দেওয়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝাপান খেলায় অংশ নেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন হয়ে খেলার প্রতি দায়িত্ব বেড়ে গেল।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার আসমানখালী গ্রামের সাপুড়ে রবিউল ইসলাম জানান, আকাশ সংস্কৃতির কারণে হারিয়ে যাওয়া ঝাপান খেলাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝাপান খেলায় অংশ নেন।
খেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ডা. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রাম-বাংলার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এ খেলার আয়োজন করা হয়েছিল। বর্তমান প্রজন্ম যাতে এ ধরনের খেলাধুলার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এ জন্য তাঁদের এই প্রচেষ্টা। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে প্রতিবছরই ঝাপান খেলার আয়োজন করা হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক বলেন, গ্রাম-বাংলার হারানো খেলাধুলা আবার ফিরিয়ে আনতে তাঁর সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।