‘তোমার নরকে যাওয়ার ভিসা তৈরি করেছি’
পেশায় তিনি রিয়েল এস্টেট এজেন্ট। বাস করেন বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে কানাডার টরেন্টোতে। অথচ বাংলাদেশে সম্প্রতি ব্লগারদের হত্যার যে ঢেউ উঠেছে তাঁকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছেন তিনি। কারণ তার আরেকটি পরিচয় তিনি একজন ব্লগার। আরো খোলাসা করে বললে, এই মুহূর্তে মুক্তমনা ব্লগটি চালাচ্ছেন তিনি।
ফরিদ আহমেদ তাঁর টরেন্টোর বাড়িতে বসেই চালান মুক্তমনা নামের ব্লগটি। এই মুহূর্তে এটা বেশ কঠিন একটা কাজ। কারণ, ধারাবাহিকভাবে এর লেখকদের হত্যা করা হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ফরিদ আহমেদের বন্ধু বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সন্দেহভাজন ধর্মীয় জঙ্গিদের চালানো ওই হামলায় নিজের বুড়ো আঙুল খুইয়েছেন এবং মাথায় তীব্র আঘাত পেয়েছেন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
এ প্রসঙ্গে ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এটা অনেক বড় ক্ষতি। এটা শুধু এ জন্য না যে, আমি আমার বন্ধুকে হারিয়েছি। কিন্তু অনলাইন জগতে বিশেষ করে বাংলাভাষী কমিউনিটিতে মুক্তমনা একটি বড় বিষয়। বাংলাদেশি নাস্তিকদের জন্য এই ব্লগ বিতর্ক করার এবং মতামত প্রকাশের বড় মাধ্যম ছিল। অনেকটা ছাতার মতো।’
কানাডার গণমাধ্যম দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হত্যার মিছিল বন্ধই হচ্ছে না। মার্চ মাসে আরো একজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া এই মাসে নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার পথে আরেক মুক্তমনা লেখককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ফরিদ আহমেদ জানান, যে ব্লগটি গড়ে উঠতে তিনি সহযোগিতা করেছিলেন সেটি এখন বাংলাদেশে অবস্থান করা এর লেখকদের জন্য জীবন-মৃত্যুর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তমনার লেখকরা এখন নিজেদের জীবন নিয়ে সংশয়ের বিষয়ে তাঁকে প্রশ্নও করছেন। কানাডায় নিরাপদ জীবনযাপন করেও তিনি অনুভব করতে পারেন যে এর কোনো সহজ সমাধান নেই। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কী করতে হবে।’
টরেন্টোতে ফরিদের নিজ বাসায় দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলের সঙ্গে তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁকে বেশ বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। মুক্তমনা ব্লগারদের কাছ থেকে তিনি গোপন বার্তাও পাচ্ছেন। ফরিদ আহমেদ হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে আরো কাউকে হত্যা করা হবে।’
মৃত্যুর এই হুমকি এখন মুক্তমনা ব্লগারদের ছাপিয়ে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের দিকেও প্রসারিত হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশের একটি নম্বর থেকে আসা বার্তা দেখান ফরিদ আহমেদ। সেখানে লেখা ‘নরকে যাওয়ার জন্য তোমার ভিসা আমরা তৈরি করে ফেলেছি।’
নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের মে মাসের তিন তারিখে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে সুইডেনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার দুই সপ্তাহের ভিসা আবেদনটি বাতিল হয়ে যায়। ১২ মে তিনি খুন হন। এরপর থেকে ব্লগটির ৩০০ প্রদায়ক ও ৩৫ জন লেখক ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে আছেন। এদের মধ্যে যারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তাঁরাও এখন ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন।
‘এই হত্যার ঘটনাগুলো সবাইকে ভীত করে দিয়েছে। তাই আমি তাঁদের নামগুলো বদলে দিয়েছি। কারণ, তাঁদের জীবনকে তো হুমকির মধ্যে ফেলতে পারি না’ বলেন ফরিদ আহমেদ।
২০০০ সালে পরিবারসহ কানাডায় যান ফরিদ আহমেদ। ২০০১ সালে মুক্তমনার খোঁজ পান তিনি। দেখেন যে, ধর্মীয় গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ করে মত প্রকাশের দারুণ একটি মাধ্যম এই ব্লগ।
স্মৃতি হাতড়ে ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘নিজের সমমনা মানুষ পেয়ে আমি খুব অভিভূত হয়েছিলাম।’ এরপর ২০০৫ সাল থেকে মুক্তমনায় লেখালেখি ও মডারেটর হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি।
অভিজিৎ রায় সম্পর্কে ফরিদ বলেন, ‘তাঁকে যে সত্যিই মেরে ফেলা হয়েছে এই বিষয়টি মেনে নেওয়া আমার জন্য ভীষণ কঠিন।’
অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করলেও মাত্র একবার দেখা হয় দুজনের। অভিজিতের কথা স্মরণ করে ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘তিনি অনেকের বিষয়ে বিতর্ক করতেন। আমি সব সময় ভাবতাম তিনি খুব রুক্ষ একজন মানুষ। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি খুব আশ্চর্য হলাম। তিনি খুবই ভদ্র, নম্র ও মৃদুভাষী ব্যক্তি ছিলেন।’
মুক্তমনার লক্ষ্য শুধু ইসলামকে আঘাত করা নয়, বরং সব ধর্মের সমালোচনা করা বলে ব্যাখ্যা দেন ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না যে, একজন মানুষ হঠাৎ করে নাস্তিক হয়ে যাক। কিন্তু আমরা চাই মানুষ যৌক্তিকভাবে সবকিছু চিন্তা করুন।’ এ ছাড়া বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনা বাড়ানোও তাদের লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
মুক্তমনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানিয়ে ফরিদ আহমেদ বলেন, দিনে দিনে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
মুক্তমনা ব্লগ চালু থাকবে -এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই জানিয়ে ফরিদ আরো বলেন, ‘যদি আমরা এই ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দেই, তাহলে আমরা হার মেনে নিলাম। কিন্তু আমরা তা করব না। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’
মুক্তমনা ব্লগে সাধারণত ইতিহাস ও সাহিত্য নিয়ে লেখেন ফরিদ আহমেদ। ধর্ম বা বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি নিজে অভিজ্ঞ নন বলেও জানান। তবে এই মুহূর্তে তিনি বা তাঁর স্ত্রী আফরোজার বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সবাই জানে যে আমিই মুক্তমনা ব্লগটি চালাচ্ছি, আর এটাই আমাকে হত্যার জন্য যথেষ্ট।’