পদ্মা সেতুতে বদলে গেছে শ্যামল ভূমি শরীয়তপুর
পদ্মা সেতুর এক বছরে পাল্টে গেছে শরীয়তপুরের চিত্র। সহজ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। বিনিয়োগ বাড়ছে জেলায়। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামের নারী-পুরুষের। কৃষিতেও এসেছে অর্থনৈতিক পরিবর্তন। শরীয়তপুরে উৎপাদিত সবজি যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। একটি সেতুর কারণে শরীয়তপুরের আর্থ-সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
সোনালী সেতু পদ্মার শ্যামল ভূমি শরীয়তপুর। কৃষিনির্ভর শরীয়তপুর জেলা পদ্মা সেতু চালুর এক বছরে কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শরীয়তপুরের উৎপাদিত সবজি যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কৃষিতে লাভবান হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে আরও বেশি আগ্রহী হচ্ছে কৃষকরা। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আশায় দামও পাচ্ছে ভালো। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ভোগান্তি কমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ ছাড়াও জাজিরায় এগিয়ে চলছে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লীর কাজ। বিসিক শিল্পনগরীতেও বেড়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। জেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প। মাছের খাদ্য উৎপাদনের কারখানাও গড়ে উঠেছে শরীয়তপুরের বিসিকে। প্রত্যন্ত চরাঞ্চল নাওডোবায় গড়ে উঠেছে আধুনিক মানের রেস্তোরাঁ। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে পরিবহণ সেক্টরেও। শরীয়তপুর থেকে রাজধানী ঢাকার পথে চলছে নামিদামি এসি-ননএসি বাস। বিনিয়োগ বেড়েছে পরিবহণ খাতে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান।
একটি সেতু যে একটি এলাকার কতটা পরিবর্তন ঘটাতে পারে তার নিদর্শন গোসাইরহাট উপজেলার কোদাল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল ভোগকাটি ইসমাইল হাওলাদার কান্দি গ্রামে গড়ে ওঠা রপ্তানিমুখি পোশাক কারখানাটি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সাথে সাথেই চালু করা হয় এই পোশাক কারখানাটি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে তৈরি হওয়া পোশাক এখন রপ্তানি করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। চরাঞ্চলের প্রায় দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
পোশাক কারখানাটির শ্রমিক রাবেয়া খাতুন (৩৫) বলেন, আগে পরিবার পরিজন রেখে কাজের জন্য ঢাকায় থাকতে হতো। এতে উপার্জনের একটি অংশ বাসা ভাড়ায় ব্যয় হয়ে যেত। পদ্মা সেতু হওয়ায় এই গ্রামে কারখানাটি হয়েছে। এখন বাড়ি থেকে গিয়ে কাজ করতে পারি। খরচও কমেছে, পরিবারের সাথে থেকে সন্তানদেরকেও লেখাপড়া করাতে পারছি।
জেলার জাজিরা উপজেলার মিরাশার গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আব্দুল জব্বার (৪০) বলেন, আগে আমাদের উৎপাদিত সবজি জেলার পাইকাররা কিনতে আসতো। এখন পদ্মা সেতু হওয়াতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের পাইকাররা বাজারে এসে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আর বাজারে গিয়ে সবজি নিয়ে বসে থাকতে হয় না। সবজি নিয়ে বাজারে গেলেই পাইকার পাওয়া যায়। এতে সবজির দামও ভালো পাচ্ছি।
আর এক কৃষক জালাল আহাম্মেদ (৩৫) বলেন, এখন এখানকার সবজি ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। এতে আমাদের এই এলাকার সবজির চাহিদা বেড়েছে। এতে নতুন নতুন চাষিরা সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছে।
মিরাশার চাষি বাজারের সবজি বিক্রেতা আব্দুল জলিল কাজি বলেন, আগে কৃষকরা বাজারে সবজি নিয়ে এসে বসে থাকত পাইকারদের জন্য। পদ্মা সেতু হওয়ার পরে এখন আর সবজি নিয়ে কৃষকদের বসে থাকতে হয় না। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে বসে থাকে সবজি কেনার জন্য। পদ্মা সেতু হওয়াতে মিরাশার চাষি বাজারে পাইকারদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কৃষকরা সবজির দামও অনেক ভালো পাচ্ছেন।
মিরহা এন্ড নাবা ফ্যাশন নামে পোশাক কারখানাটির মালিক মোজাম্মেল হক মুসা হাওলাদার বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেই আমি পরিকল্পনা করে গ্রামে কারখানাটির কাজ শুরু করি। সেতু চালু হওয়ার পর কারখানাটিতে উৎপাদন শুরু করি। আমার ঢাকায় আরও কয়েকটি কারখানা রয়েছে। এখানে কারখানা করায় আমার উৎপাদন খরচ অনেক কমেছে। শ্রমিকের মজুরিও কম। শ্রমিকরা নিজের বাড়ি থেকেই কাজ করতে পারছে।
জাজিরা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জামাল হোসেন বলেন, আগে ফেরি পারাপারের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হতো এই অঞ্চলের সবজি চাষিদের। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এখন আর কোন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না। সবজির ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে জাজিরার কৃষকরা। জাজিরার উৎপাদিত সবজি এখন ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি ও সুইডেনে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। পদ্মা সেতু এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছে।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান সোহেল বলেন, ঢাকার খুব নিকটে হলেও শরীয়তপুরে শিল্পায়ন হয়নি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন শিল্পকারখানা তৈরি হচ্ছে। আগামীতে আরও বড় আকারে শিল্প কারখানা তৈরি হবে। কর্মসংস্থান হবে জেলার মানুষের।